ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তিন দিনব্যাপী সম্মেলন উদ্বোধনকালে জেলা প্রশাসকদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী

পুরনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের উর্ধে থাকুন

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ২৯ জুলাই ২০১৫

পুরনো ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের উর্ধে থাকুন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সব ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের উর্ধে থেকে আইনের আওতায় দায়িত্ব পালন করতে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, শুধু রুটিন কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, পুরনো দিনের আমলাতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। জনগণের কল্যাণে নতুন নতুন উপায় ও কৌশল খুঁজে বের করতে হবে। কেবল একজন সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে নয়, একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবেও আপনাদের ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত এবং সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের অগ্রযাত্রায় শরীক হতে হবে। আপনারা এ কর্মকা-ে নিজেরা আত্মনিয়োগ করবেন এবং আপনাদের সহকর্মীদেরও উৎসাহিত করবেন। চলতি বছরের শুরুতে কিছু রাজনৈতিক দলের ধ্বংসযজ্ঞ, নৈরাজ্য, নাশকতা ও নিরাপরাধ মানুষের প্রতি নৃশংসতা দমনে জেলা প্রশাসকদের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাকৃতিক সমস্যা থেকে মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যা আরও কঠিন ছিল। সেগুলোর বিরুদ্ধে আপনারা যথাযথ পদক্ষেপ নিয়েছেন। দেশকে রক্ষা করেছেন। আপনারা সক্রিয় ছিলেন বলেই এ ধরনের অবস্থা থেকে আমরা উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের কাজ কেউ করতে না পারে সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসকদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, মানুষের জীবনযাত্রা নিরাপদ ও চলাচল নির্বিঘœ করা সরকারের প্রতিটি কর্মচারীর দায়িত্ব। তিনি বলেন, জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। একইসঙ্গে বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টির ‘যে কোন অপচেষ্টা’ কঠোর হাতে দমন করতে হবে। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে তিন দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক সম্মেলন- ২০১৫-এর উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন। উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী একুশটি বিষয়ে বিশেষ নজর রাখার তাগিদ দিয়ে ‘পুরনো ধ্যান-ধারণা বদলে’ জেলা প্রশাসকদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতেও নির্দেশ দেন। দেশপ্রেমিক নাগরিকের মতো দায়িত্ব পালনের জন্য ডিসিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে গ্রহণ করা সরকারের সিদ্ধান্তগুলো তৃণমূলে বাস্তবায়নে মূল ভূমিকাই থাকে জেলা প্রশাসনের ওপর। তাই সরকারী সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যেন কোনভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। দেশের সব জেলার প্রশাসকদের নিয়ে সরকারের নীতি নির্ধারকদের তিন দিনের এই সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব, বিভাগীয় কমিশনার ও প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। এবারের ডিসি সম্মেলনে ২১ দফা নির্দেশনায় প্রাধান্য পায় আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখা, সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি, নারী ও শিশুর অধিকার রক্ষা, সার বিদ্যুত জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা ইত্যাদি। সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইঞা জানান, গত বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে নেয়া সিদ্ধান্তের ৯৩ ভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। ২০১৪ সালে অব্যাহত দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর জেলা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে এটা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে জেলা প্রশাসকগণ তাঁদের দায়িত্ব পালনে বিভিন্ন বাধা ও সমস্যা নিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও নীতি-নির্ধারকগণের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ পাবেন। এতে তাঁরা এসব সমস্যা সমাধানের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা লাভ করবেন। সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইঞা ছাড়াও বক্তব্যে রাখেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এম আবদুল্লাহ, সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক নাজমুল আহসান, হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক সাবিনা আলম ও লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান। এরপর ডিজিটাল সার্ভিস উন্নয়নে অবদানের জন্য রংপুরের বিভাগীয় কমিশনার দেলওয়ার বখত, কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেন, পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক এম সালাউদ্দিন এবং নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান মিয়ার হাতে ‘ডিজিটাল সার্ভিস এ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশপ্রেম নিয়ে দায়িত্ব পালনের জন্য জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, রাষ্ট্র তথা জনগণের স্বার্থ সংরক্ষণই হবে আপনাদের মূল লক্ষ্য। সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থাকলে আপনাদের পক্ষে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে। তিনি বলেন, রুটিন কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। প্রতিটি জেলা কি ধরনের নতুন কাজ হাতে নেয়া যায়, যা ওই জেলার উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে, সেই ধরনের নতুন পন্থা আবিষ্কার করা, কৌশল নির্ধারণ করা এবং বাস্তবায়ন করার দিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। সরকারের নীতি ও কর্মসূচী বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকরা যে জনগণ ও সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করছে, সে কথাও ডিসিদের মনে করিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। ২০২১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে জেলা প্রশাসকদের আরও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২১ সালের আগে যেন মধ্যম আয়ের দেশ গড়তে পারি সে লক্ষ্য নিয়েই সকলকে আরও দ্রুত কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুত, অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে ২০৪১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা পাবে। এক্ষেত্রে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঔপনিবেশিক আমলে জেলা প্রশাসনের জন্ম হলেও বর্তমানেকালের বিবর্তনে আজ সবকিছুরই পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কী ভাবে এই দেশ পরিচালনা করব, উন্নত করব এবং এগিয়ে নিয়ে যাব- সেটাই হচ্ছে বিবেচ্য বিষয়। কাজেই পুরনো ধ্যান-ধারণা পরিবর্তন করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, ক্ষমতার ধারাবাহিকতার কারণেই দেশের উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। দেশের প্রত্যেক মানুষের জন্য বাসস্থান নিশ্চিত করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই দেশে একটি মানুষও নিরক্ষর থাকবে না। কোন জেলায় একটি মানুষও যেন গৃহহীন না থাকে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, একটি জেলার সার্বিক উন্নয়ন নির্ভর করে জেলা প্রশাসনের কর্মীদের ওপর। ভূমি ব্যবস্থাপনা, নির্বাচন পরিচালনা, ভেজালবিরোধী অভিযান, পরিবেশের সুরক্ষা, বৃক্ষ নিধন ও পাহাড় কর্তন রোধ, পাবলিক পরীক্ষা পরিচালনা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি কর্মসূচীর বাস্তবায়নের মতো কাজগুলো তাদের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়। তবে এসব রুটিন কাজের পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদের আরও কিছু কাজ করতে হবে। একেক অঞ্চলের একেকরকম বিশেষত্ব রয়েছে। নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার করা, কৌশল নির্ধারণ এবং তা বাস্তবায়ন করার দিকেও আপনাদের মনোযোগী হতে হবে। জেলা প্রশাসকদের মানুষের প্রতি দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এদেশের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের অর্জিত অর্থই কিন্তু আপনাদের বেতন-ভাতা। আমরা যে যা কিছু ভোগ করি তা তাদেরই অবদান। তাই জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন করা এবং উন্নত জীবন দেয়া আমাদের সকলের কর্তব্য। মাদক আর মানবপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকতেও নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যে ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের ভাগে এসেছে সেই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ইতোমধ্যে বাজেটে ২শ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে যে অর্জন তার সুফল যাতে সেই অঞ্চলের মানুষগুলো পেতে পারে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। গত সাড়ে ছয় বছর মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতিগুলো তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দেশে ধনী-গরিবের আয় বৈষম্য কমেছে। তা আরও কমাতে হবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ডিসিদের ২১টি বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেন। সরকারী সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষের হয়রানি বন্ধ করা, নারী ও শিশু নির্যাতন এবং পাচার, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার, যৌতুক, ইভটিজিং এবং বাল্যবিবাহ রোধ করা, প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশের মতো বিষয় এতে রয়েছে। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানোর লক্ষ্যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে সহায়তা করা, তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করা, নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি, ছাত্রছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার কমানো এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দেন ডিসিদের। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষ যাতে সহজে সুবিচার পায় এবং আদালতে মামলাজট কমে, সেজন্য গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করা, জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটির প্রধান হিসেবে জেলা প্রশাসকদের দায়িত্ব পালন, এসব কমিটিকে সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূ করা এবং জঙ্গীবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করতে জনগণকে উদ্বুদ্ধও করতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং সরকারী ভূমি রক্ষায় সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুত, জ্বালানির সরবরাহ নির্বিঘœ করতে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নিতে হবে। ভেজাল খাদ্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে গণসচেতনতা সৃষ্টি, পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্র্যয় প্রশমনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন এবং এ সংক্রান্ত স্থায়ী নির্দেশনা অনুসারে ‘সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ’ নিতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলন শেষ হবে আগামী বৃহস্পতিবার। জানা গেছে, মোট ৩৯টি মন্ত্রণালয়ের ২৫৩টি প্রস্তাব নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা করা হবে। সম্মেলনে মোট ১৮টি কর্ম-অধিবেশন হবে। বাকি অধিবেশনগুলো মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আজ বুধবার দুপুরে রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করবেন জেলা প্রশাসকরা।
×