তখন বিকেল। সামনের এসকর্ট জিপসিটিকে টানা অনুসরণ করে চলেছে আমাদের গাড়ি। বর্ষা নেই। স্বাভাবিকের থেকে আবহাওয়া বেশ গরম। প্রকৃতি দেখতে মন্দ লাগছিল না। কিন্তু, গুয়াহাটি থেকে শিলং গোটা পথই স্যারের চোখ ওই জিপসিতেই আটকে রইল। ঠিক জিপসি নয়, এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া ওই গাড়িতে মেশিনগান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক জওয়ানের দিকে। বিমানবন্দর থেকে কিছুটা এগিয়েছে আমাদের গাড়ি, স্যার আমাকে বললেন, ‘ওই বেচারা কি এভাবেই সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে?’ আমাকে বার বার অনুরোধ করছিলেন, ‘ওয়ারলেসে খবর পাঠাও না! ওকে বসতে বলতে বলো।’ শেষে এক রকম বাধ্য হয়েই আমি যোগাযোগ করলাম ওয়ারলেসে। কিন্তু, কোন লাভ হলো না। নিয়মে আটকে গেল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর আমরা শিলং পৌঁছলাম। স্যার কিন্তু প্রথমেই ওই জওয়ানের খোঁজ নিলেন। তাঁর নাম এসএ লাপাং। স্যার ডাকছেন শুনে এক লাফে হাজির। কিন্তু, ভেতরের ঘাবড়ানো দশাটা লুকিয়ে রাখতে পারেননি ওই কনস্টেবল। লম্বা, সুঠাম যুবক কাছে আসতেই তাঁর সঙ্গে হাত মেলালেন স্যার। ক্ষমা চাইলেন ওই কনস্টেবলের কাছে। বললেন, ‘আমার জন্য এতটা পথ এভাবে আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হলো!’ এর পর তাঁকে অবাক করে দিয়ে স্যার বললেন, ‘নিশ্চয়ই ক্লান্ত লাগছে? আমার সঙ্গে বসে কিছু খেয়ে যান।’ ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে উঠতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিলেন লাপাং। তার পর বেশ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘স্যার, আপনার জন্য তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে দাঁড়াতে পারি!’
এমনটাই ছিলেন স্যার। স্যার মানে আবুল পকির জয়নুল আবদিন আব্দুল কালাম। তাঁর মৃত্যুর পর এতগুলো ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও আমার ঘোর কাটছে না! গত ৬ বছর ধরে আমি ছিলাম দেশবিদেশের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সফরসঙ্গী। ছায়াসঙ্গীও বলা যেতে পারে। তাঁর বইয়ের সহলেখকও। লাপাংয়ের সঙ্গে কথা বলার পর বরাবরের পছন্দের চা-পকোড়া খেয়েছিলেন তিনি। ছাত্রদের বসিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন না। তাই, ক্লান্ত শরীরেও সময় নষ্ট না করে হলের দিকে রওনা হলেন।
হলে পৌঁছে বরাবরের মতো মাইক্রোফোনটা ঠিক করে দিয়ে ওঁর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বললেন, ‘ফানি গাই, আর ইউ ডুইং ওয়েল?’ ৬ বছর ধরে চেনা বাক্য। একই সংলাপ। কেবল সুর শুনে বুঝতে হবে, মুড কেমন! জবাব দিলাম, ‘ইয়েস অল ফিট, গো এ্যাহেড।’ ব্যস, সেই আমার সঙ্গে শেষ কথা। এর পর তিনি ছাত্রদের সঙ্গে কথা শুরু করলেন। বললেন, ‘কেমন আছ তোমরা? আগেও তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’ হার্ভার্ড-এমআইটি যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা শুরু করতেই হঠাত দেখলাম, স্টেজ থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন তিনি। চোখ বন্ধ। তখন সন্ধে ৬টা ৪০। ওখান থেকে হাসপাতালে পৌঁছতে মিনিট পাঁচেক লেগেছিল। তার কিছু ক্ষণ পরেই জানলাম, দূষণ-হিংসার পৃথিবী ছেড়ে মিসাইল ম্যান তাঁর উড়ানে চেপে রওনা দিয়েছেন নতুন দেশের উদ্দেশে।
দিল্লী থেকে গুয়াহাটি আড়াই ঘণ্টা, সেখান থেকে শিলং ফের আড়াই ঘণ্টা। পাঁচ ঘণ্টার এই সফরে বহু বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল স্যারের সঙ্গে। সকালেই খবর পেয়েছিলেন, পাঞ্জাবে জঙ্গী হানা হয়েছে। খুব চিন্তিত ছিলেন বিষয়টি নিয়ে। শিলং আইআইএম-এ তাঁর ভাষণের বিষয় ছিল ‘ক্রিয়েটিং আ লিভেবেল প্ল্যানেট আর্থ’। স্যার বলছিলেন, ‘মানুষের তৈরি কারণগুলোই এই পৃথিবীকে বাসযোগ্য বজায় রাখার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। যে হারে হিংসা, দূষণ ও মানুষের হঠকারি কাজকর্ম বাড়ছে তাতে আর আর বড়জোর তিরিশ বছর এই দুনিয়ায় থাকা যাবে।’ তখনও কী জানতাম, বক্তা নিজেই মাত্র তিন ঘণ্টা পরেই পৃথিবী ছাড়বেন!
সোমবার বেলা ১২টা নাগাদ দিল্লী থেকে যাত্রা শুরু হয়েছিল আমাদের। বিমানে প্রথমে গুয়াহাটি। সেখান থেকে গাড়িতে শিলং। বর্ষার আকাশে প্রায় আড়াই ঘণ্টার উড়ান। খারাপ আবহাওয়ায় বিমানের নাচানাচি আমার একেবারে সহ্য হয় না। ঝাঁকুনিতে প্রায় জড়সড় হয়ে ছিলাম। আমাকে শান্ত করতে স্রেফ জানালার পাল্লা নামিয়ে দিয়ে স্যার বললেন, ‘ব্যস! এখন আর ভয়কে দেখতে পাচ্ছ না। তাই ভয় পাওয়ার কারণও নেই।’ যাওয়ার সময় তাঁর আসন সংখ্যা ছিল ১-এ। পরনে কালচে ছাই রঙের স্যুট। কিন্তু, ফিরতি পথে স্যারের শরীর মুড়ে গেল তেরঙা পতাকায়! এবং কোন বিশেষ আসনে নয়, কফিনবন্দী হয়ে স্যার ফিরলেন দিল্লীতে।
প্রায়ই তিনি আমায় জিজ্ঞেস করতেন, নিজেকে কীভাবে স্মরণীয় রাখতে চাও? এক দিন আমিই পাল্টা সেই প্রশ্ন করলাম তাঁকে। বললাম, ‘রাষ্ট্রপতি, লেখক, বিজ্ঞানী, মিসাইল ম্যান, ইন্ডিয়া ২০২০- কোন কাজের জন্য নিজেকে অমর দেখতে চান?’ জবাব ছিল, ‘শিক্ষক হিসাবে।’ দু’সপ্তাহ আগের ঘটনা। তিনি বলছিলেন, ‘সেই মানুষই ভাগ্যবান, যে কোন রোগভোগ ছাড়া, কাজ করতে করতে মারা যান। শেষ বিদায় হওয়া উচিত সংক্ষিপ্ত।’ নিজের দু’টি কথাই মৃত্যুর মঞ্চে মিলিয়ে দিয়ে গেলেন আমার গুরু এপিজে আব্দুল কালাম। -সৃজনপাল সিংহ (আনন্দবাজার)