ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পীর তুলিতে অলঙ্কৃত ও হাতে লেখা দেশের প্রথম সংবিধান ছাপা হয় যে মেশিনে তা

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৯ জুলাই ২০১৫

শিল্পীর তুলিতে অলঙ্কৃত ও হাতে লেখা দেশের প্রথম সংবিধান ছাপা হয় যে মেশিনে তা

মোরসালিন মিজান ॥ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়া। দেশ হলো। কিন্তু কেমন হবে এই দেশ? কোন নীতি অনুসরণ করা হবে দেশ পরিচালনায়? উত্তর দিল সংবিধান। সারাবিশ্বে প্রশংসিত হওয়া এই দলিল প্রথম ছাপা হয় বিজি প্রেসে। মূল মেশিনটির নামÑ ক্র্যাবট্রি ডাবল ডিমাই টু কালার অফসেট প্রেস। কাজটি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে এই মুদ্রণযন্ত্র। সময় যত গড়িয়েছে, বয়স তত বেড়েছে। বুড়ো হয়েছে। পরিত্যক্ত অন্য অনেক যন্ত্রের সঙ্গে বহুকাল পড়েছিল বিজি প্রেসে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় গত বছর এটি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ইতিহাসের অমূল্য স্মারক সংরক্ষণ ও আগামী প্রজন্মকে দেখার সুযোগ করে দিতেই এ উদ্যোগ। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও আনুষ্ঠানিকতা শেষে আগামী কিছুদিনের মধ্যে যন্ত্রটি জাদুঘরে হস্তান্তর করা হবে। এর ফলে সদ্য স্বাধীন দেশের প্রথম সংবিধান ছাপার আবেগ অনুভূতি ও গৌরবের ইতিহাসটি নতুন করে সামনে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। জানা যায়, ১৯ আগস্ট মন্ত্রিসভার বৈঠকে মুদ্রণযন্ত্রটি বিজি প্রেস থেকে জাতীয় জাদুঘরের হস্তান্তরের প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাব অনুমোদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর শুরু হয় হস্তান্তর প্রক্রিয়া। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রথমে অসংখ্য মেশিনের মধ্য থেকে সংবিধান ছাপার কাজে ব্যবহৃত মেশিনটি চিহ্নিত করা হয়। পরে সেটি বাইরে বের করে চলে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ। কয়েকদিন আগে বিজি প্রেসে গিয়ে দেখা যায়, পরিত্যক্ত অন্য মুদ্রণযন্ত্রগুলো থেকে ক্র্যাবট্রি ডাবল ডিমাই অফসেট প্রেস আলাদা করে ভবনের পেছনের খোলা জায়গায় রাখা হয়েছে। বেশ বড়সরো কাঠামো। পুরোটাই লোহার। তবে জঙ্গ ধরা। ময়লা বাসা বেধেছিল। সেগুলো দূর করতে কাজ করছে বিজি প্রেসের বেশ কয়েকজন কর্মী। মরিচাধরা লোহা লক্কর ধীরে ধীরে আপন চেহারায় ফিরছে। কাজ তদারকি করছিলেন জাতীয় জাদুঘরের কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম। তিনি জানান, মুদ্রণযন্ত্রটি ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডে তৈরি। ওজন ১৫ টন। উচ্চতা সাড়ে ৭ ফিট। প্রস্থ সাড়ে ৬ ফিট। তখন এর মূল্য ছিল ৭৪ হাজার ৮৪০ টাকা। ১৯৫২ সালের এপ্রিলে যন্ত্রটি দিয়ে কাজ শুরু হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন সংবিধান বিল গণপরিষদে উত্থাপন করেন। ৪ নবেম্বর বিলটি পাস হয়। এরপর ডিসেম্বরে বই আকারে সংবিধান ছাপানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। বহু সংগ্রামের পর পাওয়া সংবিধান ছাপানোর ক্ষেত্রে এর সৌন্দর্যের দিকটি বিশেষ প্রাধান্য পায়। বড় দায়িত্ব। তাই বড় মানুষটিকে বেছে নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই গুরু দায়িত্ব প্রদান করেন কিংবদন্তি শিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকে। শিল্পাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত টিমের অন্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বরেণ্য শিল্পী হাশেম খান, জুনাববুল ইসলাম, আবুল বারক্ আলভী ও সমরজিৎ রায় চৌধুরী। শুধু অঙ্গসজ্জা নয়, পুরো কাজটির সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে ছিলেন শিল্পী হাশেম খান। ঐতিহাসিক কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে সীমাবদ্ধতা অনেক ছিল। তবে দেশপ্রেমের কোন অভাব ছিল না। দেশপ্রেমে আর আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলেই এমন অসাধারণ একটি সংবিধান হাতে লেখা ও ছাপা সম্ভব হয়েছিল। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে অত্যন্ত আন্তরিক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কাজটি সুন্দর করতে শৈল্পিক করতে তিনি আস্থা রেখেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ওপর। তিনি জানান, শিল্পচার্য তাঁকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। স্বাধীনতার মহানায়ক তখন ভারতীয় সংবিধানটি দেখিয়ে বলেন, এই যে দেখ, এমন সুন্দর হওয়া চাই। পারবে না? শিল্পাচার্য সংবিধানটি দেখেন। আশ্বস্ত করেন বঙ্গবন্ধুকে। শুরু হয়ে যায় কাজ। হাশেম খান জানান, ছাপার উন্নত মান নিশ্চিত করতে প্রথমে বেসরকারী মালিকানাধীন পাইওনিয়ার প্রেস কিংবা পদ্মা প্রেসে সংবিধান ছাপানোর কথা চিন্তা করা হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে ছাপিয়ে আনার বিষয়টিও ছিল আলোচনায়। সে সময় সরকারী মালিকানাধীন বিজি প্রেসের সামর্থ্য ছিল সীমিত। কিন্তু খরচ কমাতে শেষ পর্যন্ত বিজি প্রেসে ছাপা সম্ভব কিনা তা খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন সদ্য স্বাধীন দেশ। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে চলছে দেশ গড়ার কাজ। অন্যদের মতো দেশাত্মবোধের চেতনায় উজ্জীবিত বিজি প্রেসের কর্মকর্তা কর্মচারীরাও। তাঁরা যত সীমাবদ্ধতাই থাকুক না কেন, আন্তরিকভাবে কাজ করে ভাল ছাপা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন। জানা যায়, বিজি প্রেসের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। বিশ্বের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠান শ্লেট স্কুল অব আর্ট থেকে প্রিন্টিং টেকনোলজির ওপর কোর্স করা এই কর্মকর্তা কাজটি সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাপার কাজের জন্য তিনি বেছে নেন ওই সময় বিজি প্রেসে থাকা সবচেয়ে আধুনিক মেশিন ক্র্যাবট্রি ডাবল ডিমাই টু কালার অফসেট প্রেস। মূলত এই মেশিনটিতেই ছাপা হয় হাতে লেখা প্রথম সংবিধান। এর বাইরে কিছু কিছু কাজ ক্র্যাবট্রি ব্র্যান্ডের অন্য একটি মেশিনে হয়েছে বলেও শোনা যায়। সংবিধানে হাতে লেখার কাজটি করেন আব্দুর রউফ। অদ্ভুত সুন্দর সে হাতের লেখার সঙ্গে যোগ হয় কারুকাজ। প্রতিটি পৃষ্ঠার মাঝখানে লেখা। চারপাশ অলঙ্করণ করা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একপাতা লেখা শেষ হলে সেটি চলে যেত শিল্পীদের হাতে। তাঁরা অলঙ্করণ করতেন। শিল্পাচার্যের পছন্দ হলে পরে সেটির ছবি তোলা হতো ক্যামেরায়। ছবি তোলার কাজটি করতেন মকবুল হোসেন। সেখান থেকে নেগেটিভ করা হতো। নেগেটিভ থেকে প্লেট তৈরি করে শুরু হতো ছাপার কাজ। প্লেট তৈরি ও মেশিন চালানোর কাজটি করেছেন অফসেট অপারেটর আবু সাঈদ। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধান পাওয়া যায় তাঁর। ঢাকার শ্যামলির বাসায় বসে জনকণ্ঠের সঙ্গে কথা হয় প্রবীণ অপারেটরের। তিনি বলেন, ওই সময় এটি ছিল একমাত্র ডবল কালার মেশিন। শুরুতে সরকারী পোস্টার ম্যাপ ইত্যাদি এখান থেকে ছাপা হতো। তারপর সংবিধান ছাপা হয়। সে সময়ের কথা মনে পড়ে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেশের সংবিধান ছাপা হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খুব গৌরবের ছিল। সবার মাঝেই একটা উত্তেজনা কাজ করছিল। সকলে খুব ভালবেসে কাজটি করেছেন। প্রেসের ছোটখাট ত্রুটি দূর করা, বিদেশ থেকে যন্ত্রাংশ সংগ্রহ, এমনকি নিজেদের তৈরি বিকল্প যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে ছাপার কাজ চলেছে বলে জানান তিনি। তিনি জানান, বইটির আকার ছিল ১৮ ইঞ্চি বাই ২৩ ইঞ্চি। পৃষ্ঠা ছিল ১২০টি। দুই থেকে তিন সপ্তাহ ধরে চলে ছাপার কাজ। ৫০০ কপির মতো ছাপা হয়েছিল বলে জানান তিনি। এতে ১৪ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল বলে জানান তিনি। কিন্তু ছাপা ছিল চমৎকার। দেখে সকলেই অবাক হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ক্র্যাবট্রি ডাবল ডিমাই মেশিনে ছাপা সংবিধানটিকে ভারতের সংবিধানের চেয়েও সুন্দর বলে মন্তব্য করেছিলেন। সংবিধানের এসব কপি পরে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোতে পাঠানো হয়। বিভিন্ন দূতাবাসসহ গুরুত্বপূর্ণ অফিসে দেয়া হয় একটি করে কপি। জানা যায়, এরপর যত দিন গেছে, দেশ এগিয়েছে। বিজি প্রেসে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন মুদ্রণযন্ত্র। আর পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে ইতিহাসের বিরল সাক্ষী ক্র্যাবট্রি ডাবল ডিমাই টু কালার অফসেট প্রেসটিকে। তবে দেরিতে হলেও অমূল্য স্মারক স্বীকৃতি পেয়েছে মুদ্রণযন্ত্রটি। আগস্টে যাচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। এ প্রসঙ্গে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদফতরের মহাপরিচালক এ কে এম মানজুরুল হক বলেন, এক নদী রক্তের বিনিময়ে পাওয়া সংবিধান প্রথম ছাপা হয়েছিল বিজি প্রেসে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। মুদ্রণযন্ত্রটির জন্য জাতীয় জাদুঘর উপযুক্ত জায়গা মন্তব্য করে তিনি বলেন, যন্ত্রটি জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের প্রায় সব প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সুবিধা মতো একটি দিন নির্ধারণ করে মুদ্রণযন্ত্রটি হস্তান্তর করা হবে বলে জানান তিনি। একই বিষয়ে জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, হাতে লেখা সংবিধানের মূল কপি জাতীয় জাদুঘরে আছে। বিজি প্রেসে ছাপা হওয়া সংবিধানের একটি কপি গ্যালারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে। এখন যে মেশিনে ছাপা হয়েছে সেটিও আসছে জাদুঘরে। এর ফরে আমরা আরও সমৃদ্ধ হব। মুদ্রণযন্ত্রটি সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি ইতিহাসকে লালন করা হবে। যন্ত্রটি আকারে অনেক বড় হওয়ায় আপাতত জাদুঘরের বাম পাশে নতুন করে প্রস্তুত একটি স্থানে প্রদর্শন করা হবে। তবে যন্ত্রটি ঘিরে নতুন কিছু পরিকল্পনা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
×