ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শাহজাহান মিয়া

খালেদা জিয়া আসলে কোন্্ পথে!

প্রকাশিত: ০৬:৫০, ৩০ জুলাই ২০১৫

খালেদা জিয়া আসলে কোন্্ পথে!

গত কয়েকদিন ধরেই বিএনপিকে নিয়ে নানা ধরনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। দলটি এখন কি করছে, আগামীতে কি করতে পারে এসব কথা। শোনা যাচ্ছে বিএনপি থেকে মা-ছেলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারসহ নানা অভিযোগ তুলে যারা এক সময় মাঠ গরম করত, এসব কারণে যারা বিএনপির রাজনীতি ছিন্ন করেছে তারাও এখন দলে ফিরছেন, কাউকে কাউকে দলে সসম্মানে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। অবশ্য এটা বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়, কিংবা খালেদার জিয়ার জন্য এটা আদর্শিক বা নৈতিকতার প্রশ্ন নয়, এখন আদর্শ এক জায়গায় ঠেকেছে যে করেই হোক ক্ষমতায় যেতে হবে। এক সময় সাকা চৌধুরী কিংবা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদরা সকালের মন্দ বলে বিকেলে ঘরে ফিরেছেন মানে বিএনপিতে ফিরেছেন। সেটা বিএনপির জন্য সমস্যার নয়, কেবল ম্যাডামকে সরি বললেই হলো। একটি জাতীয় দৈনিকে দেখলাম বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতা ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকারের বরাত দিয়ে বলেছে বিএনপি এখন শেখ হাসিনার অধীনেও নির্বাচনে যেতে রাজি। এখন আর তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় না। ঘরে ফেরা বা ঘর থেকে বের করে দেয়া যেভাবেই হোক বিএনপির বর্তমান বেহাল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায় দলটির ভক্তরা। তারা একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন চায়। অবশ্য বেগম জিয়া কি চান সেটা বোঝা দুষ্কর। কিন্তু এখন যেভাবে অহরহ মিথ্যাচার করছেন তাতে কি তৃণমূল নেতাদের চাওয়া এবং বিএনপির রাজনীতির শেষ রক্ষা হবে? আসলে হতাশা শুধু বিএনপি নেত্রীকেই আচ্ছন্ন করেনি। বিগত দিনে আগুন সন্ত্রাস করে নিরীহ জনগণকে পুড়িয়ে মেরে আন্দোলনে চরম ব্যর্থ বেগম জিয়া ও তাদের নেত্রীর দায়িত্বহীন কথাবার্তা ও কর্মকা-ে বীতশ্রদ্ধ সারাদেশের মাঠ পর্যায়ের হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থকের মধ্যেও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এ বছরের শুরুতে দীর্ঘ তিন মাসেরও বেশি আন্দোলনে নিষ্ঠুর-নির্মম নাশকতার নেতৃত্বদানের নেত্রী বেগম জিয়ার বিচার ট্রাইব্যুনালে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় ইঙ্গিতে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়েছে বিএনপি ও দলটির নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। কারণ এ বছরের ৬ জানুয়ারি থেকে ৭ এপ্রিল পর্যন্ত টানা ৯২ দিনের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচী পালনের নামে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সারাদেশে চালানো হয়েছিল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। একটু পেছনের কথা বলি; গত ৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার একটি বহুল প্রচারিত ইংরেজী দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় তাদের প্রধান সংবাদ ‘পেট্রোলবোমা কেড়ে নিল আরও তিনটি প্রাণ’। ডান পাশে আগুনে দগ্ধ মুখ ব্যান্ডেজ করা মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালের শয্যায় শায়িত এক অসহায় ব্যক্তির ছবি। ছবিটির ঠিক ডান পাশে অষ্টম কলামে খালেদা জিয়ার দাবি ‘আমরা বার বার বলেছি আমাদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণ’ এই কথাগুলো। ঠিক এর উপরিভাগে ছাপানো লাল বৃত্তের মধ্যে গোলাপী আভায় ম-িত বিএনপি নেত্রীর মুখাবয়ব তাদের এই ন্যক্কারজনক মিথ্যাচারের মুখে যে চপেটাঘাত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তার নেতৃত্বে অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে তিন মাসাধিককাল ধরে চলছিল মানুষ পুড়িয়ে মারার বর্বর নৃশংসতা। ক্ষমতা হারিয়ে একেবারে পাগল হয়ে যাওয়া বেগম জিয়ার প্রেরণায় বিএনপি-জামায়াত ক্যাডাররা গত ৬ জানুয়ারি থেকে নিরন্তর গাড়িতে পেট্রোলবোমা মেরে নির্মমভাবে হত্যা করছিল নিরীহ-নিষ্পাপ শিশু-নারী-বৃদ্ধসহ সব বয়সের সাধারণ মানুষ। অগ্নিদগ্ধ অনেক অসহায় মানুষ যন্ত্রণায় কাতরিয়েছে বার্ন ইউনিটে। দগ্ধ মানুষগুলোর আর্তনাদ ও তাদের স্বজনদের আহাজারি হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। অগ্নিদগ্ধ মানুষগুলোর আর্তনাদ আর প্রিয়জন হারিয়ে বা তাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট চিৎকার এবং স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে বাতাস ভারি হয়ে গিয়েছিল। তবুও কঠোর-কঠিন খালেদা জিয়ার মনে এতটুকু মায়া-মমতার উদ্রেক হয়নি। কারণ, অনেকেই তখন বলেছিলেন বেগম জিয়া হৃদয়হীন, আবেগহীন একটি মানুষ। তার তথাকথিত আন্দোলনের সময় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে তার দলের নেতাকর্মীদের পাত্তায়ই ছিল না। আপোসহীন নেত্রী বলে পরিচিত বেগম জিয়া গুলশানের কার্যালয়ে আরাম-আয়েশে শুয়ে-বসে অবরোধের মধ্যে একযোগে হরতালেরও ডাক দিয়েছিলেন। মানুষ ভয়েও এই অপ্রয়োজনীয় অবরোধ বা হরতাল মানার কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে করেনি। গাড়িতে পেট্রোলবোমা মেরে আগুন বা গাড়িতে উঠে পেট্রোল বা কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানো সত্ত্বেও রাস্তায় সব ধরনের গাড়ি চলাচল করেছে। খালেদা জিয়া মুখে বারবার ইসলামের কথা বললেও গত এজতেমার সময় অবরোধ চালিয়ে মুসল্লিদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছেন। বিএনপি নেত্রী ও তার দল এ বছর এসএসসি, এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার সময়ও আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছিল। অবশ্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তার নিজের দুই নাতিনকে তাদের মায়ের সঙ্গে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু দেশের লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীর কথা তার একবারও মনে হয়নি। শান্তিপূর্ণ হরতাল-অবরোধের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট তাদের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আগুনের সঙ্গে পেট্রোলবোমার আগুনের লেলিহান শিখার মিশ্রণ ঘটিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল দেশের সাধারণ মানুষ। তখন তাদের লোকজনের নিক্ষিপ্ত বোমার আঘাতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল দেড় শতাধিক নিরীহ মানুষ। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শেষ পর্যন্ত অর্ধমৃত অবস্থায় পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে আরও প্রায় দুই শতাধিক মানুষ। আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ও ভাংচুর করা হয়েছে প্রায় হাজার যানবাহন। ট্রেনেও হামলা করা হয়েছে। দেশের অর্থনীতিও হয়েছে অগ্নিদগ্ধ। তিন মাসের আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়ানোর ঘটনায় দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে কমপক্ষে ৮০ হাজার কোটি টাকা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী আন্দোলন চলাকালীন সময়েই কমপক্ষে দু’বার গত ১৯ জানুয়ারি এবং ৫ ফেব্রুয়ারি পেট্রোলবোমায় হতাহতদের দায়-দায়িত্ব সম্পূর্ণ অস্বীকার করে নির্লজ্জের মতো পুরো দায়িত্ব খালেদা জিয়া বর্তমান সরকার ও আওয়ামী লীগের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিছুদিন আগেও দেশের মানুষকে বিস্ময়ের ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিয়ে এবার তিনি পেট্রোলবোমা মারার দায় চাপালেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কঠিন দায়িত্বে নিযুক্ত পুলিশের ওপর। আন্দোলনের সময় যারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাদের ওপর এমন নির্লজ্জ মিথ্যা আরোপ যে কতটা নির্মম ও অমানবিক তা সহজেই অনুমেয়। এরকম জঘন্য মিথ্যাচার সারাদেশে তোলপাড় সৃষ্টি করে। আর তাই দীর্ঘ তিন মাসের নিরর্থক আন্দোলনে যানবাহনে পেট্রোলবোমার আগুনে পুড়িয়ে বহু মানুষ হত্যাসহ নির্মম নাশকতার নেতৃত্ব প্রদানের দুঃসাহসী নেত্রী বেগম জিয়ার বিচার ট্রাইব্যুনালে হবে বলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যয়ী বক্তব্যে শঙ্কিত হয়ে পড়েন বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। জামায়াতসহ সমমনা দলগুলোকে নিয়ে আন্দোলনের নামে দেশে ধ্বংসাত্মক কর্মকা- চালানোর জন্য তখনই বিভিন্ন মহল থেকে খালেদা জিয়ার বিচার করার দাবি উঠেছিল। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, বেগম জিয়ার পেট্রোলবোমা হামলায় নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণের দায়-দায়িত্ব এড়ানোর ফন্দি-ফিকির ধোপে টিকেনি। কারণ, মিডিয়া নাশকতার সঙ্গে খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তার চরম মিথ্যাচারের জারিজুরি সব ফাঁস করে দেয়। বেগম জিয়ার টেলিসংলাপের অডিও টেপও ফাঁস হয়ে যায়। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ইউটিউবে বাংলা লিকস নামের ওই এ্যাকাউন্ট থেকে আপলোড করা এসব কথোপকথনে রয়েছে নেতাকর্মীদের প্রতি খালেদা জিয়ার দেয়া নাশকতামূলক নানা নির্দেশনা। খালেদা জিয়ার এ ধরনের টেলিফোন সংলাপের অডিও টেপ প্রকাশে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। সরকারের কেন্দ্র থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বয়ে গিয়েছিল সমালোচনার ঝড়। খালেদা জিয়ার যে পাঁচটি অডিও টেপ বাংলা লিকস প্রকাশ করেছে তার চারটিই ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার একটি মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশকে কেন্দ্র করে। প্রকাশিত চারটি টেপই ওই সমাবেশ শুরুর আগে তার দলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে বেগম জিয়ার কথোপকথন। তাতে নাশকতার কথা বলা হয়েছিল। দলের শৃঙ্খলা ও ঐক্যের প্রশ্নে বিএনপি ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন বয়কট করার পর তা প্রতিরোধ করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হওয়া দলটির সর্বস্তরে এখন বিরাজ করছে চরম হতাশা। এরশাদবিরোধী টালমাটাল আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসার পর এই প্রথম বিএনপি সংসদের বাইরে। বেগম জিয়ার বেপরোয়া মনোভাব এবং গুণধর বড় পুত্র তারেক রহমানের বেসামাল উক্তি ও অনর্থক খবরদারি দলের সিনিয়র নেতাদের কারও কারও কাছে একেবারেই অসহনীয় মনে হয়। তৃণমূল পর্যায়ে হতাশার মাত্রা আরও ভয়াবহ। আর তাই গত কয়েক মাস ধরে হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছে। সে কারণে কিছুদিন আগে এক সভায় বেগম জিয়া দলে থেকে দলের নেতৃত্বকে সমালোচনা করার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। কারও নাম উচ্চারণ না করে দলের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জনসমক্ষে সমালোচনা না করার বিষয়ে সতর্ক করেছেন। অবশ্য কিছু সিনিয়র নেতার ব্যক্তিগত বক্তব্য ও অন্য প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বের প্রতি অনীহা প্রকাশ পেয়েছে। এখানে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া লে. জে. (অব) মাহবুবুর রহমান, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও মঈন খানের ফোনালাপ প্রণিধানযোগ্য। বিএনপি নেত্রী নিজে ইচ্ছে করেই বিগত নির্বাচনে অংশ না নিয়ে নির্বাচন ভ-ুল করতে চেয়েছিলেন। তখন সন্ত্রাস চালিয়ে সরকারকে সংলাপে বসতে বাধ্য করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। সত্যটি তখনও তিনি মনে মনে পোষণ করতেন, এখনও তিনি মনে করছেন যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার আর মাত্র এক বছরের মধ্যে দেশের উন্নয়নে এত সব কাজ করে ফেলবেন যে, তখন এ সরকারের অবস্থান খুব দৃঢ় হয়ে যাবে। দেশের মানুষের মনের মধ্যে সরকারের অবস্থান এতটাই সুদৃঢ় হয়ে যাবে যে, বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে কোন কথাই বলা যাবে না। তাই বেপরোয়া মনোভাবসম্পন্ন তথাকথিত আপোসহীন নেত্রী যে কোন মূল্যে এ সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। সরকারকে ঘায়েল করাই তার বড় টার্গেট। যদিও কাজটি মোটেই সহজ নয় এবং সম্ভবও নয়। কারণ এভাবে মিথ্যাচার দিয়ে আন্দোলন বা সংগ্রাম কোনটাতেই সফল হওয়া যায় না । এছাড়া বিএনপির কতিপয় সিনিয়র নেতা বলছেন এক কথা আর ম্যাডাম খালেদা জিয়া বলছেন অন্য কথা। তাই প্রশ্ন উঠছে খালেদা জিয়া আসলে কোন্ পথে। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
×