ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শিল্পকলায় ময়ূরভঞ্জ ছৌ নৃত্যে মুগ্ধ দর্শক

প্রকাশিত: ০৭:৪৭, ৩০ জুলাই ২০১৫

শিল্পকলায় ময়ূরভঞ্জ ছৌ নৃত্যে মুগ্ধ দর্শক

গৌতম পাড়ে ॥ বৃষ্টির তীব্রতা দমিয়ে রাখতে পারেনি দর্শনার্থীদের নৃত্য উপভোগের আকাক্সক্ষাকে। মিলনায়তন ভর্তি দর্শক বিমুগ্ধচিত্তে, অপলক নেত্রে যেন তাকিয়ে আছে মঞ্চের দিকে। তাকিয়ে না থেকে উপায়ও নেই। ভারতের প্রতিথযশা শিল্পী সন্তোষ নায়ারের নৃত্যশৈলী যেন জাদু মন্ত্রের মতো সবাইকে তাক লাগিয়ে রেখেছিল। অনেককে বলতে শোনা গেছে, এই প্রথমবারের মতো অসাধারণ এক নৃত্য পরিবেশনা দেখলাম। এর থেকে আমাদের দেশের নৃত্যাঙ্গনের মানুষদেরও অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হলো। পাশাপাশি দেশের প্রতিভাধর তরুণ শিক্ষার্থীদের দলীয় পরিবেশনা যেন নৃত্যলোকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় মঙ্গলবার সন্ধ্যায়। শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত ও নৃত্যকলা কেন্দ্র মিলনায়তনে বর্ণাঢ্য এ নৃত্যায়োজন করে ওয়ার্ল্ড ড্যান্স এলায়েন্স বাংলাদেশ কেন্দ্রের ‘নৃত্যযোগ’। আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। ভারতীয় আদিবাসী যুদ্ধনৃত্য ‘ময়ূরভঞ্জ ছৌ’। এ নাচের উৎপত্তিস্থল উড়িষ্যার সাবেক দেশীয় রাজ্য ময়ূরভঞ্জে। এই নাচে রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন উপাখ্যান অভিনয় করে দেখানো হয়। কালের বিবর্তনে এ নৃত্য যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে মার্শাল আর্টে পরিণত হয়। পরবর্র্তীতে এ নৃত্যের নমনীয় এক শৈলী দর্শক মনে বিশেষ এক স্থান করে নেয়। দিল্লির প্রখ্যাত শিল্পী সন্তোষ নায়ারের পরিচালনায় সপ্তাহব্যাপী এ নৃত্যের এক কর্মশালা হয় শিল্পকলা একাডেমিতে। এতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৬৫ জন শিক্ষার্থী অংশ নেয়। মাত্র এক সপ্তাহে তরুণ শিক্ষার্থীদের ‘ময়ূরভঞ্জ ছৌ’ নৃত্যের এক ব্যাসিক পাঠ দানে সমর্থ হয় নৃত্যগুরু সন্তোষ নায়ার। শিক্ষার্থীরা সেই অংশটুকুই প্রদর্শন করে এ নৃত্য আয়োজনে। শিল্পী সন্তোষ নায়ার তাঁর এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আমি অবিভূত। এদেশের তরুণ ছেলে-মেয়েরা যে এত সহজেই কঠিন এ নৃত্যটির ব্যাসিক ফর্ম আয়ত্ব করতে পারবে, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। কারণ,‘ময়ূরভঞ্জ ছৌ’ নৃত্যটি অত্যন্ত কঠিন। আমি এ নৃত্যের মাত্র দশ শতাংশ এদের দেখিয়েছি, এখনও আশি শতাংশ বাকি। তথাপি এরা সঠিকভাবে এগুলো শিখে নিতে পেরেছে, এতে আমি খুব খুশি। প্রদীপ প্রজ্বলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সূচনা করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নাট্য ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নৃত্যগুরু সন্তোষ নায়ার, আনিসুল ইসলাম হিরু, নৃত্যযোগের প্রসিডেন্ট শর্মিলা বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ। ‘ময়ূরভঞ্জ ছৌ’ নৃত্যের ব্যাসিক আর্ট ফর্মের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীরা প্রথম পরিবেশনা শুরু করে। এতে ছৌ নৃত্যের বিভিন্ন কলাকৌশল ও আঙ্গিক পরিবেশন করা হয়। পরিবেশনার ধারা বর্ণনায় ছিলেন নৃত্যগুরু সন্তোষ নায়ার। এরপর তাঁর নৃত্য জীবনের ওপর একটি অডিও ভিজ্যুয়াল পর্দায় দেখানো হয়। নাটরাজের সাজে মঞ্চে আসেন নৃত্যশিল্পী সন্তোষ নায়ার। পরিবেশন করেন নৃত্য ‘নটরাজ’। নটরাজ শিবকে বলা হয় নৃত্যের দেবতা। নৃত্যের সব ধরনের মুভমেন্টের উৎপত্তি শিবের থেকে। এটা দৃশ্য বা ছবি থেকে চলমান প্রকাশভঙ্গির রূপান্তর। ঐতিহ্য ও আধুনিক ভঙ্গির সংমিশ্রণে এতে এক অসাধারণ নৃত্যশৈলী তুলে ধরেন সন্তোষ নায়ার। যার মধ্যে প্রতিভাত হয়েছে অনিয়ন্ত্রিত ও শক্ত ভিত্তিভূমির নৃত্য রচনা যাকে আবিষ্কারও বলা যায়। শিবের দুটি দিক সুন্দরভাবে এ নৃত্যে তুলে ধরেছেন তিনি। যা কাল ও সময়বিহীন, শূন্যস্থানবিহীন, রহস্যময়তায় পূর্ণ এবং জটিল। মহাশূন্যের যিনি প্রভু, একজন যোগী, যাকে বলা হয় আদি গুরু। নৃত্যের মধ্যে যে বিষয়টিকে তিনি বেশি করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন তা হলো-অন্ধকারকে দূর করে আলোর পথে অগ্রসর, শৃঙ্খলামুক্ত হয়ে সবাইকে স্বাধীন হয়ে বাঁচার এক প্রয়াস। পরের নৃত্যটি পরিবেশন করে কর্মশলায় অংশ নেয়া শিক্ষার্থীরা। ছৌ নৃত্যের লোক আঙ্গিকের নৃত্যটিতে সুন্দর এক মোহতায় ভরিয়ে তোলে তারা। শানাইয়ের সুরে ছৌ নৃত্যের বিভিন্ন কলাকৌশল ও আঙ্গিক প্রদর্শন করে তারা। আবারও মঞ্চে আসেন সন্তোষ নায়ার। আসেন যুদ্ধের বেশে। হাতে তলোয়ার। ‘যোদ্ধা’ নৃত্য পরিবেশন করেন তিনি। ‘যোদ্ধা’ পূর্ব ভারতের ময়ূরভঞ্জ ছৌয়ের একটি যুদ্ধ নৃত্য। এটি হাতিয়ার ধারার। তা-ব ভাবের সমান্তরাল। এই নৃত্য সাহসের ভাবকে সম্ভ্রম জানায় এবং একজন অসম্ভব সাহসী যোদ্ধার ভাব প্রকাশ করে। নৃত্যটি পরিবেশন শেষে পুরো মিলনায়তনজুড়ে হাতের তালির এক ভিন্ন আবহ তৈরি করে। কোন কোন জায়গা থেকে আসাধারণ-অসাধারণসহ বিভিন্ন রকমের শব্দ আসতে থাকে। সবশেষ পরিবেশনাটি ছিল বাংলা গানের সঙ্গে ছৌ নৃত্য। ‘আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল’ গানটির সঙ্গে তরুণ শিক্ষার্থীদের নৃত্যভঙ্গি বিশেষ এক আবহ সৃষ্টি করে। সঙ্গে গুরু সন্তোষ নায়ারের যোগ নৃত্যটিকে আরও অর্থবহ করে তোলে।
×