ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুই দেশের সীমান্তের ৩ স্টিপ ম্যাপে আনুষ্ঠানিক সই ;###;আজ মধ্যরাতে বিনিময় হবে বাংলাদেশের ৫১ এবং ভারতের ১১১ ছিটমহল ;###;কাল ভোরে বাংলাদেশ অংশে উড়বে জাতীয় পতাকা

প্রায় ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের মুক্তি আজ রাত বারোটায় ॥ ছিট যুগের ইতি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৩১ জুলাই ২০১৫

প্রায় ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের মুক্তি আজ রাত বারোটায় ॥ ছিট যুগের ইতি

তৌহিদুর রহমান ॥ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বহুল প্রতীক্ষিত ছিটমহল সমস্যার সমাধান হচ্ছে। ‘ছিটমহল’ এই শব্দটি এখন ইতিহাস হতে চলেছে। আজ শুক্রবার রাত বারোটার পর থেকে উভয় দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হবে। এর মধ্যে দিয়ে প্রতিবেশী দুই দেশের ছিটমহলবাসীর প্রায় ৬৮ বছরের দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান হচ্ছে। ছিটমহলে বসবাসকারী নাগরিকরা তাদের অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি পেতে চলেছে। তাই ছিটমহলে বইছে এখন আনন্দের বন্যা। আগামীকাল শনিবার ভোরে ছিটমহলের বাংলাদেশ অংশে জাতীয় পতাকা উড়বে। এদিকে ছিটমহল বিনিময়ের একদিন আগেই বৃহস্পতিবার ঢাকায় দুই দেশের সীমান্তের ৩০টি স্ট্রিপ ম্যাপে আনুষ্ঠানিক সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ে ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত স্থল সীমান্ত চুক্তি, ২০১১ সালে স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত প্রটোকল ও সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরে দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বিল বিনিময়ের পর এখন সীমান্ত চুক্তির বাস্তবায়ন হতে চলেছে। সীমান্ত চুক্তির রূপরেখা অনুযায়ী ৩১ জুলাই মধ্যরাতে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় হবে। আজ শুক্রবার রাত বারোটার পরই ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল বিনিময় হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দুই দেশের ছিটমহল বিনিময়ের জন্য কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কোন আনুষ্ঠানিকতা থাকছে না। তবে স্থানীয় পর্যায়ে আনুষ্ঠানিকতা পালিত হবে। ছিটমহলের মানুষেরা বাড়িতে বাড়িতে মোমবাতি জ্বালিয়ে উৎসব পালন করবে। শনিবার ভোরে বাংলাদেশ অংশে পতাকা উড়ানো হবে। তবে ছিটমহলের ভারতীয় অংশে কোন পতাকা উড়বে না। কেননা ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের মৃত্যুতে দেশটিতে সাত দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হচ্ছে। সে কারণে ভারতীয় ছিটমহলে এ মুহূর্তে কোন পতাকা উড়বে না। দেশটির সকল স্থানে এখন পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে। এছাড়া সে দেশের সকল সরকারী অনুষ্ঠান ও ভোজসভাও বাতিল করা হয়েছে। এদিকে ছিটমহল বিনিময়ের একদিন আগেই বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৩০টি স্ট্রিপ ম্যাপে আনুষ্ঠানিক সই হয়েছে। ঢাকায় দুই দেশের হাইকমিশনার এসব ম্যাপে সই করেছেন। ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদফতরে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ৩০টি স্ট্রিপ ম্যাপে সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে এই ম্যাপে সই করেন দিল্লীতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী। অপরদিকে ভারতের পক্ষে ম্যাপে সই করেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ শরণ। গত সপ্তাহে ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে দুই দেশের মানচিত্রের নক্সা চূড়ান্ত করা হয়। এই মানচিত্র অনুযায়ী দুই দেশের সীমান্তে নতুন করে সীমানা চিহ্নিত হয়। এ সময় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত এলাকার ৩১টি স্ট্রিপ ম্যাপের মধ্যে ৩০টি ম্যাপই প্রাথমিক সই হয়। বৃহস্পতিবার দুই দেশের মধ্যে এসব ম্যাপে চূড়ান্ত সই হয়। বৃহস্পতিবার ঢাকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে স্থল সীমানা সংক্রান্ত চুক্তি ও প্রটোকল অনুযায়ী আজ ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ভূমি বিনিময় সম্পন্ন বলে গণ্য হবে। আজ শুক্রবার মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশের মূল ভূখ-ে অবস্থিত সকল ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের ভূখ- হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত সকল বাংলাদেশী ছিটমহল ভারতের ভূখ- হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে। একই সঙ্গে উভয় দেশের অপদখলীয় জমি সে দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে। এছাড়া এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত জমি সংযুক্ত করে এবং বহির্ভূত জমি বাদ দিয়ে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে গেজেট নোটিফিকেশন জারি করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূখ- হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ১১১টি ছিটমহলে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিক হিসেবে থাকার অপশন প্রদানকারীগণ ব্যতীত অন্যান্য বাসিন্দাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে ভারতীয় ভূখ- হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হবে এবং এদের নাগরিকরা ভারতীয় নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবে। ১ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশের ভূখ-ে নতুনভাবে অন্তর্ভুক্ত ভারতের পূর্ববর্তী ১১১টি ছিটমহলে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। ছিটমহল বিনিময় সামনে রেখে সরব বিশ্বগণমাধ্যমও। বহু প্রতীক্ষিত সেই সময়টি বিশ্ববাসীকে দেখাতে চান সবাই। তাই বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম ছিটমহল এলাকা শেষবারের মতো দেখতে আসছে। আগামীতে আর কখনও ছিটমহল এলাকা দেখা যাবে না। তাই ছিটমহলের মানুষের অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমে তুলে ধরতে চান তারা। তাই ছিটমহলে এখন গণমাধ্যমের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ১৯৭৪ সালে ঢাকা ও দিল্লী সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশ সেই বছরই চুক্তিটি অনুস্বাক্ষর করে। এরপর ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় চুক্তিটি বাস্তবায়নের জন্য একটি প্রটোকল স্বাক্ষর করা হয়। তবে সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছর ভারতের লোকসভায় সীমান্ত চুক্তি বিল পাসের পর এই চুক্তি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। এরপর গত ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি বিল বিনিময় হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নে একটি রূপরেখাও চূড়ান্ত করা হয়। সে অনুযায়ী সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন চলছে। আর সেই রূপরেখা অনুযায়ী শুক্রবার দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় হবে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরে বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর ও কোচবিহারের সীমানা নিয়ে সমঝোতা না হওয়ায় ছিটমহলের উদ্ভব হয়। সমস্যা সমাধানে ১৯৫৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছিল। যেটা নেহরু-নুন চুক্তি হিসেবে পরিচিতি পায়। পরবর্তীতে এই চুক্তি বাস্তবায়নে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এরপর ১৯৭৪ সালে ছিটমহল বিনিময়, অমীমাংসিত সীমান্ত ও অপদখলীয় জমি নিয়ে সমস্যা সমাধানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। যেটা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নামে পরিচিত। তখন এই চুক্তি বাংলাদেশের পার্লামেন্টে অনুমোদিত হলেও ভারতের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়ায় দেশটির পার্লামেন্টে চুক্তিটি অনুমোদন করা হয়নি। ফলে এই চুক্তি বাস্তবায়নও আটকা পড়ে যায়। বাংলাদেশ ও ভারতের মোট ছিটমহলের সংখ্যা ১৬২টি। এর মধ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতের ছিটমহলের সংখ্যা ১১১। আর ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের ছিটমহল ৫১টি। চুক্তি বাস্তবায়নের পর আজ রাত বারোটার পর ভারতের ১১১টি ছিটমহল যার জমির পরিমাণ ১৭ হাজার একর বাংলাদেশের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। অনুরূপভাবে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ভারতে যুক্ত হবে। ৫১টি ছিটমহলে জমির পরিমাণ সাত হাজার একর। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের সন্ধিক্ষণ সামনে রেখে বিভিন্ন ছিটমহলে আনন্দের বন্যা বইছে। ছিটমহল বিনিময়ের এই ঐহিতাসিক দিনে সেখানের বাসিন্দারা নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ছিটমহল বিনিময় হবে। বৃহস্পতিবার পঞ্চগড় থেকে এ রহমান মুকুল জানান, ৩১ জুলাই মধ্যরাতে দুই দেশের ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১৬২টি (বাংলাদেশী ৫১টি, ভারতীয় ১১১টি) ছিটমহল স্ব-স্ব দেশের ভূখ-ে একীভূত হয়ে যাবে। একই সঙ্গে ছিটমহল নামটিও চিরদিনের জন্য বিলুপ্ত হওয়ার পাশাপাশি ৬৮ বছরের বিভীষিকাময় এক অধ্যায়েরও পরিসমাপ্তি ঘটবে। এরপর কোন ছিটমহলের নাগরিক নিজভূমে পরবাসী থাকবে না। তারা পাবেন সমাজবদ্ধ একটি জীবন, নিজের আত্মপরিচয় আর একটি স্বাধীন ভূখ-। যে ভূখ-টির নাম হবে বাংলাদেশ কিংবা ভারত। এতদিন যাদের পরিচয় ছিল ভারতীয়, তারা হয়ে যাবেন বাংলাদেশী আর বাংলাদেশীরা হয়ে যাবেন ভারতীয়। এ যেন স্বাধীনতার মতোই স্বাদ। ৬৮ বছরের দুঃখ, কষ্ট আর যন্ত্রণার প্রতীক হিসেবে প্রতিটি মুসলমান বাড়ির উঠোনে ৬৮ মোমবাতি এবং হিন্দু বাড়িতে জ্বালানো হবে ৬৮টি প্রদীপ। দিনটিকে ঐতিহাসিকভাবে স্মরণীয় রাখতে আলোকসজ্জা আর সড়কগুলোতে মশাল প্রজ্বলনের পাশাপাশি বিভিন্ন ছিটমহলে আলোচনা সভা, স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। পঞ্চগড়ের গারাতী ছিটমহলে শুক্রবার সকাল থেকে নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা চলবে। সদর উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে দিনব্যাপী কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়েছে। খেলাধুলার পাশাপাশি ঢাকা থেকে শিল্পী এনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিদ্রোহী শিশু কিশোর থিয়েটারের আয়োজনে মানবতার মহাকবি নামে একটি নাটক মঞ্চায়ন করা হবে। এছাড়াও পটকা ও আতশবাজি ফুটিয়ে আনন্দ উল্লাস করা হবে। ৩১ জুলাই সকাল থেকে রাতভর চলবে নানা অনুষ্ঠানমালা। সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনোয়ার সাদত সম্রাট জানান, অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে হাজার হাজার মানুষ এসব অনুষ্ঠান উপভোগ করবেন। পঞ্চগড়ের ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক শামছুল আযম বলেন, ৩১ জুলাই মধ্যরাত থেকে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় ছিটমহল বাংলাদেশের আর ভারতের অভ্যন্তরে অবস্থিত বাংলাদেশী ছিটমহল ভারতের হয়ে যাবে। এসব ছিটমহলের মানুষ নিজেদের পছন্দমতো দেশ বেছে নিয়েছেন, যারা ভারতে যাওয়ার আবেদন করেছেন ১ আগস্টের পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের নামে ট্রাভেল পাস ইস্যু করবেন মর্মে তিনি জানান। নীলফামারী থেকে তাহমিন হক ববি জানান, ৩১ জুলাই মধ্যরাতে স্বাধীনতা পেতে চলেছে ছিটমহলবাসী। সেই সন্ধিক্ষণকে ধরে রাখতে ওই দিন রাতভর অনুষ্ঠান করবে ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটি। কমিটির তরফে জানানো হয়, ভারতের মধ্য মশালডাঙা ছিটমহলে মূল অনুষ্ঠান করা হবে। এ বিষয়ে মুঠোফোনে সংগঠনের সহকারী সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত বলেন, ওই দিন ঘরে ঘরে জাতীয় পতাকা তুলবেন বাসিন্দারা। মোমবাতি জ্বালাবেন। তারা নিজেদের মতো করে আনন্দ করবেন। আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে একটি অনুষ্ঠান করব ভারতের মধ্য মশালডাঙা ছিটমহলে। তিনি ছিটমহলবাসীর ৬৮ বছরের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ৩১ জুলাই সরকারীভাবে ছিটমহল বিনিময় হয়ে যাবে। স্বাভাবিকভাবেই বিনিময় সমন্বয় কমিটি ওই দিন ভেঙ্গে দেয়া হবে। কিন্তু ছিটমহলের মানুষের পাশে আমরা থাকবই। তাই মানবধিকার সংগঠন তৈরি করা হবে। ছিটমহলের বাসিন্দাদের পাশাপাশি সীমান্তের মানুষের মানবাধিকার আদায়ে কাজ করা হবে। তাদের প্রত্যেককে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। নীলফামারীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বলেন, ছিটমহলের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কোনরকম অবনতি যাতে না হয়, সে জন্য প্রশাসন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। শুক্রবার ছিটমহলের বাহিরে থাকবে পুলিশ। কারণ আইনগতভাবে ৩১ জুলাই রাত ১২টার আগ পর্যন্ত আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছিটমহলে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাই ১ আগস্ট আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিলুপÍ হয়ে যাওয়া ৪টি ছিটমহলে প্রবেশ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে। শুক্রবার রাতে বহিরাগত কেহ যাতে কোন প্রকার সমস্যা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা হবে। ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে চুক্তি অনুযায়ী উভয় দেশের ১৬২টি ছিটমহল স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিনিময় হয়ে যাবে। এ জন্য কোন আনুষ্ঠানিকতা রাখা হয়নি। কুড়িগ্রাম থেকে রাজুমোস্তাফিজ জানান, বাংলাদেশ-ভারত অভ্যন্তরের ১৬২ ছিটমহলে এখন আনন্দের বন্যা। বাঁধভাঙ্গা আনন্দে উদ্বেলিত অর্ধলক্ষাধিক ছিটমহলবাসী। ৩১ জুলাই রাত ১২টা ১ মিনিটে ভারতীয় পতাকা নামিয়ে ৬৮টি মোমবাতি জ্বালিয়ে অন্ধকার দূর করে মুক্তির স্বাদ নেবেন ছিটমহলবাসী। অনুরূপভাবে ভারতে বাংলাদেশী ছিটমহলে ছিটের মানুষরাও অনুষ্ঠান পালন করবে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিশেষ দোয়া, বিকেলে লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান চলবে। বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা জানান, সন্ধ্যায় সমন্বয় কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ছিটমহলগুলোতে শান্তি বজায় রাখতে ১১১টি ছিটে অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি গঠন করা হয়েছে। দাশিয়ারছড়া ছিটের আলতাফ হোসেনকে আহ্বায়ক করে ১৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়। তিনি আরও জানান, ছিটমহলগুলো হস্তান্তর না হওয়া পর্যন্ত এ কমিটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। তবে ৩১ জুলাইয়ের পর এ ভূখ-টি বাংলাদেশ হয়ে যাবে। তখন এ কমিটির গুরুত্ব কমে যাবে। সরাসরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হস্তক্ষেপ করবে। কুড়িগ্রাম পুলিশ সুপার তবারক উল্লা জানান, গত এক মাস থেকে আমরা বিভিন্ন ছিটের মানুষদের নিরাপত্তা দিয়ে আসছি। এখন পর্যন্ত কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ৩১ জুলাইয়ের পর ছিটমহলের ভারতীয় ভূখ- বাংলাদেশ হয়ে যাবে। তখন পুরোপুরিভাবে আমরা নিজেদের মতো করে আরও নিরাপত্তা দেব। কুড়িগ্রাম জেলার অভ্যন্তরে ভারতীয় ছিটমহল রয়েছে ১২টি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার অভ্যন্তরে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম জেলার ছিট রয়েছে ১৮টি। লালমনিরহাট থেকে জাহাঙ্গীর আলম শাহীন জানান, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যরাতের পর হতে ছিটমহলের মানুষ নিজ নিজ দেশের নাগরিকত্ব পাচ্ছে। মধ্যরাতে লালমনিরহাট জেলা সদরের কুলাঘাট ইউনিয়নের বাঁশপচাই ও ভিতরকুটি ছিটমহলে সরকারীভাবে ছিটমহল হস্তান্তর অনুষ্ঠান হবে। এতে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারসহ সকল সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী ও রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান অংশ নেবেন। মধ্যরাতে মোমবাতি ও দীপাবলী জ্বালিয়ে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়ন হবে। সারারাত ধরে চলবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সভা, সমাবেশ। এ সময় ছিটমহলের মানুষের হাতে থাকবে বাংলাদেশের পতাকা। পহেলা আগস্ট সকালে ভারতীয় পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ছিটমহলগুলোতে উত্তোলন করা হবে। বৃহস্পতিবার রাত হতেই প্রতিটি ছিটমহলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শান্তিপূর্ণ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ তদারকি করবে। ছিটমহল বিনিময়কে জমকালো ও জাঁকজমক করতে ছিটমহলবাসী ঘরে ঘরে প্রস্তুতি নিচ্ছে। লালমনিরহাটে ৫৯টি ছিটমহলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সরকারী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ছিটমহলে বিদ্যুত লাইন সম্প্রসারণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬ কোটি ৯১ লাখ ৫৭ হাজার ৯১ টাকা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ (গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন) কাঁচা রাস্তা সংস্করণ ও মূল রাস্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ব্যয় ২ কোটি ৫৬ লাখ ৮৮ হাজার ২৪৪ টাকা, কৃষি বিভাগ প্রদর্শনী খামার ও প্রশিক্ষণ ব্যয় ৫৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, শিক্ষা বিভাগ ৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ব্যয় ধরেছে ৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ রাস্তা, ব্রিজ ও কালভাটর্ নির্মাণ, ক্রসড্রেন নির্মাণে ব্যয় ধরেছে ৪৩ কোটি ৯৮ লাখ ১৫ হাজার টাকা। স্বাস্থ্য বিভাগ ৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৬ লাখ টাকা। বিআরডিবি হতদরিদ্রদের মাঝে ঋণ বিতরণ, দল-সমিতি গঠন ও প্রশিক্ষণ ব্যয় ধরেছে ৪০ লাখ টাকা। প্রাণিসম্পদ বিভাগ পশুপালন, প্রশিক্ষণ, ভ্যাক্সিনেশন এবং ওষুধ সরবরাহ ব্যয় ধরেছে ৫ লাখ টাকাসহ নানা সরকারী প্রতিষ্ঠান ছিটমহলের উন্নয়নে ৬১ কোটি ১৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৩৫ টাকা বরাদ্দ চেয়েছে। এ বরাদ্দের বিষয়টি জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান স্বীকার করেছেন। জেলার ৫৯টি ছিটমহলের এক হাজার ৪৪২ একর জমি কেনাবেচা ও মালিকানা হস্তান্তর হয়েছে। ছিটমহলের জমি ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ভারত হতে স্ট্যাম্প নিয়ে এসে স্ট্যাম্পের উপর লিখে হস্তান্তর হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের পর ভারত হতে স্ট্যাম্প নিয়ে আসতে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। ফলে সাদাকাগজে স্থানীয়দের সাক্ষী রেখে জমি কেনাবেচা হয়েছে, যা সরকারীভাবে কোন দেশের অবৈধ স্বীকৃত নয়।
×