ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দিনভর সারাদেশে বৃষ্টি ॥ সেতু দেবে যাওয়ায় বান্দরবান বিচ্ছিন্ন

দুর্বল ঘূর্ণিঝড়েও ব্যাপক ক্ষতি, লাখো মানুষ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১ আগস্ট ২০১৫

দুর্বল ঘূর্ণিঝড়েও ব্যাপক ক্ষতি, লাখো মানুষ পানিবন্দী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে উপকূলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঝড়োহাওয়া ও অতিবর্ষণে অনেক এলাকায় দেখা দিয়েছে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয়। উপকূলবাসীর জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষ। বিধ্বস্ত বহু কাঁচা ঘরবাড়ি, উপড়ে পড়েছে অসংখ্য গাছপালা ও বিদ্যুতের খুঁটি। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, সবজি ক্ষেত, আমন বীজতলা, মৎস্যঘের ও কয়েক শ’ গ্রাম। হাতেগোনা কিছু উঁচু এলাকা ছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর অধিকাংশ এলাকাতেই সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। চট্টগ্রামের বঁাঁশখালীর ৬ কিমি বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। ফের বন্যায় প্লাবিত হয়েছে বান্দরবন শহর। বেইলি ব্রিজ দেবে যাওয়ায় শুক্রবার বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল। নেত্রকোনায় মাছ ধরতে গিয়ে হাওড়ে ডুবে মারা গেছে একজন। বুধবার রাত থেকে শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দু’দিনে ঘূর্ণিঝড়ে দেয়ালধস, গাছচাপা ও নৌকাডুবিতে মোট ৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে। শুক্রবার সাগরে দুটি মাছ ধরা ট্রলারের ৩৮ জেলে নিখোঁজ রয়েছে। বিপদসঙ্কেত উঠিয়ে সকল সমুদ্রবন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সঙ্কেত দেখাতে বলা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে শুক্রবার দিনভর হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিতে চরম দুর্ভোগে পড়ে রাজধানীবাসী। এদিন দেশের অধিকাংশ স্থানেই বৃষ্টিপাত হয়েছে। আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ বিশেষ বুলেটিনে শুক্রবার সন্ধ্যায় বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ সন্দ্বীপের কাছ দিয়ে চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করেছে। শুক্রবার সন্ধ্যায় ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে নোয়াখালী ও আশপাশে অবস্থান করছিল। বৃষ্টি ঝরিয়েই ‘কোমেন’ পশ্চিম-উত্তর পশ্চিমে স্থলভাগের দিকে অগ্রসর হয়ে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে এর দাপটে দেশজুড়ে বৃষ্টি ঝরছে। রাজধানী ঢাকায় আজ শুক্রবার সকাল থেকে বিরামহীন বৃষ্টি। আজ শনিবারও বৃষ্টি হবে। স্টাফ রিপোর্টার চট্টগ্রাম অফিস থেকে জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ প্রচ- শক্তিতে আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে একটানা ভারি বর্ষণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে চট্টগ্রাম উপকূলে। বসতবাড়ি ডুবিয়ে আশ্রয়হীন করেছে হাজার হাজার পরিবারকে। ভেসে গেছে অসংখ্য চিংড়িঘের। উপকূলীয় এলাকায় ঘটেছে এক ধরনের মানবিক বিপর্যয়। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় উপকূলবাসীর জীবনযাত্রায় নেমে এসেছে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ। চট্টগ্রামবাসীর জীবনযাত্রাও থমকে গেছে। শুক্রবার হাতেগোনা কিছু উঁচু এলাকা ছাড়া নগরীর অধিকাংশ এলাকায়ই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। আকাশভাঙ্গা বর্ষণের পাশাপাশি সামুদ্রিক জোয়ার থাকায় বাধাপ্রাপ্ত হয় পানি নিষ্কাশন। ফলে নগরীর লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে। তবে কোমেন সতর্কতা প্রত্যাহার হওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দরে সীমিত আকারে পণ্য ওঠানামা শুরু হয়েছে। শুক্রবার বিকেল তিনটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১১৬ মিমি বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে দুপুর বারোটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় বৃষ্টি হয়েছে ৬০ মিমি। বাঁশখালী থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি জোবাইর চৌধুরী জানান, উপজেলার খানখানাবাদ ও ছনুয়া ইউনিয়নের ৬কিমি বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। এতে বিধ্বস্ত হয়েছে মানুষের বাড়িঘর। এছাড়া অন্তত ১৩ পয়েন্টে ভেঙ্গে গেছে বেড়িবাঁধ। ভারি বর্ষণ ও ঘূর্ণিঝড় আতঙ্কে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত অর্ধলাখ মানুষ তাদের বাড়ি ফিরতে পারছেন না। কারণ, বসতঘর সম্পূর্ণ পানির নিচে। দুর্যোগে বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৮শ’ বাড়িঘর এবং জলমগ্নসহ নানা কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অন্তত ৩ হাজার ঘর। উপজেলার সবচেয়ে বড় চিংড়ি খামার সিকদার চিংড়িঘেরসহ প্রায় ২ হাজার একর ঘের সম্পূর্ণ সাগরের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। ফসলি জমি ও নিচু এলাকার সড়ক চলে গেছে পানির নিচে। শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় ৬০ ঘণ্টা বিদ্যুতবিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে বাঁশখালী। পুকুরিয়া এলাকায় শঙ্খনদীর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে ৪০ পরিবারের আবাসস্থল চলে গেছে নদী গর্ভে। একইসঙ্গে ভাঙ্গনের শিকার হয়ে ধ্বংস হয়েছে একটি সাইক্লোন শেল্টার ও চারটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রস্তুত করে প্রশাসনকে অবহিত করেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করা হবে বলে জানিয়েছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফ আহমেদ খান। স্টাফ রিপোর্টার কক্সবাজার থেকে জানান, ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ায় কক্সবাজারের পাঁচটি উপজেলার ২৮ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি সাধন হয়েছে কাঁচা বাড়িঘর, পানের বরজ, বীজতলা, বিদ্যুত, রাস্তাঘাট ও মৎস্য ঘেরের। সেন্টমার্টিনসহ টেকনাফ উপজেলায় গাছপালা ভেঙ্গে পড়ে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ শতাধিক বসতগৃহ। সেন্টমার্টিনদ্বীপে বাতাশে উড়ে গেছে অর্ধশতাধিক বসতগৃহের চালা। ঝড়োবাতাসে টেকনাফে পল্লী বিদ্যুতের লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পল্লী বিদ্যুতের ইঞ্জিনিয়ার হামিদুল ইসলাম জানান, বিদ্যুতের ২১টি খুঁটি ভেঙ্গে ও হেলে গেছে। ৫৩ জায়গায় লাইনের ওপর বড় বড় গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সকাল থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় এবং বাতাসের গতিবেগও কমে যাওয়ায় উপকূলের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়া মানুষ সকালের মধ্যে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে গেছে। তবে বিকেল আড়াইটার দিকে প্রায় এক ঘণ্টা ভারি বৃষ্টিপাত হয়। বিধ্বস্ত হয়েছে ৩ শতাধিক ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে কক্সবাজারের ৮ উপজেলার ২৮টি ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হলেও ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি। স্টাফ রিপোর্টার সাতক্ষীরা থেকে জানান, টানা ১৫ দিনের ভারি বর্ষণ আর কপোতাক্ষ নদের উপচেপড়া পানিতে তালা উপজেলার প্রায় ২৫ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার একর ফসলি জমি ও আমন ধানের বীজতলা। স্টাফ রিপোর্টার গলাচিপা থেকে জানান, ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে বৃহস্পতি ও শুক্রবার দফায় দফায় পটুয়াখালীর নি¤œাঞ্চল ব্যাপক বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হলেও তেমন বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ পাওয়া যায়নি বরং কোমেন পটুয়াখালী অঞ্চল থেকে সরে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। কেটে গেছে আতঙ্ক। নিজস্ব সংবাদদাতা বান্দরবান থেকে জানান, ফের বন্যায় প্লাবিত হলো বান্দরবান শহর। টানা দুইদিনের বর্ষণের কারণে বৃহস্পতিবার রাত থেকে বান্দরবান শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে শত শত পরিবার। বান্দরবানের সাঙ্গু নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বান্দরবান শহরের আর্মিপাড়া, হাফেজঘোনা, মেম্বারপাড়া, ইসলামপুর, শেরেবাংলা নগরসহ পৌর এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। পানি বৃদ্ধির কারণে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের সুয়ালক এলাকায় বেইলি ব্রিজ দেবে বান্দরবানের সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়নি। নিজস্ব সংবাদদাতা ফেনী থেকে জানান, ফেনীর সমুদ্র উপকূলীয় উপজেলা সোনাগাজীতে ঘূর্ণিঝড়ের কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩-৪ ফুট উঁচু জোয়ারের তোড়ে চরের প্রায় ৫ টি গ্রামের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কোমেনের কারণে বড় ধরনের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লুতফুর নাহার। শুক্রবার ভোর থেকে ফেনীর কোথাও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আবার কোথাও রোদ দেখা গেছে। নিজস্ব সংবাদদাতা কুষ্টিয়া থেকে জানান, শুক্রবার ভোর থেকে কুষ্টিয়ায় শুরু হয় টানা বর্ষণ। দিনব্যাপী থেমে থেমে এ বর্ষণে শহরের অধিকাংশ এলাকার রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়ে। হাঁটুপানি জমে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। শহরের কোর্টপাড়া, থানাপাড়া, হাউজিং এস্টেট, পূর্ব ও পশ্চিম মজমপুরসহ অধিকাংশ এলাকা বৃষ্টির পানিতে সয়লাব হয়ে যায়। স্টাফ রিপোর্টার রাজশাহী থেকে জানান, রাজশাহীতে ঝড়োবাতাস ও বৃষ্টিপাত অব্যাহত। বৃহস্পতিবার বিকেলের পর রাজশাহী অঞ্চলের ওপর দিয়ে ঝড়োহাওয়াসহ বৃষ্টিপাত শুরু হয়। শুক্রবার সকাল থেকে হালকা থেকে ভারি বৃষ্টিপাত হয়েছে এ অঞ্চলে। সংবাদদাতা হাতিয়া (নোয়াখালী) থেকে জানান, নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে নৌ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। জোয়ারের পানিতে নলচিরা ইউনিয়নের দুটি গ্রাম তলিয়ে যায়। পানিবন্দী হয়ে পড়ে কয়েক হাজার মানুষ। জোয়ারের পানিতে অনেক কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। স্টাফ রিপোর্টার যশোর অফিস থেকে জানান, কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও কপোতাক্ষ নদের উপচেপড়া পানিতে যশোরের মনিরামপুর উপজেলার মশ্মিমনগর ও ঝাপা ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রাম তলিয়ে গেছে। দুর্গত এসব গ্রামের কয়েক শ’ মানুষ বাড়িঘর ফেলে আশ্রয় নিয়েছে বেড়িবাঁধের ওপর। সেখানে তারা চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। নিজস্ব সংবাদদাতা পটিয়া থেকে জানান, ঝড়ের কারণে এলাকায় তিন দিন ধরে বিদ্যুত সংযোগ বন্ধ রয়েছে। কয়েক লাখ গ্রাহক নানাভাবে ভোগান্তির শিকার। নিজস্ব সংবাদদাতা নেত্রকোনা থেকে জানান, নি¤œচাপের প্রভাবে জেলার খালিয়াজুরি, মোহনগঞ্জ ও মদন উপজেলার হাওড়গুলোতে প্রচ- ঢেউ দেখা দিয়েছে। খালিয়াজুরির শাইলখা হাওড়ে মাছ ধরতে গিয়ে এক জেলের মৃত্যু হয়েছে। তার নাম কাছু বর্মন(৫০)। তার বাড়ি সদর ইউনিয়নের নয়াপাড়া গ্রামে। খালিয়াজুরি থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ জানান, কাছু বর্মন বৃহস্পতিবার বিকেলে শাইলখা হাওড়ে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হন।
×