ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ নাড়ি ছেঁড়ার গল্প

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২ আগস্ট ২০১৫

একুশ শতক ॥ নাড়ি ছেঁড়ার গল্প

বহুদিন পর আমরা আবার বিভাজনের কাহিনীর মুখোমুখি হচ্ছি। শুনতে হচ্ছে নাড়ি ছেঁড়ার গল্প। সাতচল্লিশ-একাত্তরে এ যে রূপটি অনেক ভয়ঙ্কর ছিল, সেটি এবার ততটা ভয়ঙ্কর না হলেও গল্পের রেশ তো একই। সেই গল্পের কোথাও আছে হারানোর বেদনা আবার কোথাও আছে অতি সাধারণ মানুষের পরম দেশপ্রেমের অভাবনীয় কাহিনী। দেশপ্রেমের একটি অসাধারণ দৃষ্টান্তের খবর ছাপা হয়েছে দৈনিক জনকণ্ঠের ৩১ জুলাইর ১১ পাতায়। খবরটি এমন যে, মুক্তিযোদ্ধার কন্যা আর্জিনা তার স্বামীর চাপে পড়ে ছিটমহল বিনিময়ের সময়ে ভারত যাওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছিলেন। কিন্তু দেশপ্রেম তাকে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সহায়তা করে। আর্জিনা স্বামীকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, এই মাটিই তার নিজের মাটি। ভারত তার দেশ নয়। এমনকি ভারতের লোভনীয় অফারও তাকে প্রলুব্ধ করেনি। পরিণতিতে আর্জিনা স্বামীসহ নিজ দেশে থাকতে সক্ষম হন। কিন্তু সবাই আর্জিনা নন। সবাই আর্জিনার স্বামী শহীদুল ইসলামও নন। অন্য কাহিনীগুলো বিভাজনের-নাড়ি ছেঁড়ার গল্প। ৩১ জুলাই ২০১৫ তারিখের দৈনিক প্রথম আলোতে বাংলাদেশের ছিটমহলের দুটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। এর একটি সারোয়ার আর মেরিনার। ওরা স্বামী-স্ত্রী। অন্যটি লক্ষ্মীবালা ও মধুসূদনের। ওরা ভাই-বোন। দুটি কাহিনী মানবসভ্যতার এক আবহমান বিয়োগান্তক পরিণতিকেই প্রকাশ করেছে। এই অঞ্চলে এই কাহিনীর ভয়াবহতম প্রকাশ ঘটেছিল ৪৭ সালে। ইংরেজরা পাকিস্তান ভারত সৃষ্টি করে পৃথিবীর অন্যতম জঘন্য মানবিক করুণ পরিণতির সূচনা করে- ভাগ হয় দেশ, পরিবার ও সমাজ। একাত্তরে পাকিস্তানীরা আবারও ভাগ করে পরিবার ও সমাজকে। এবার ভারত বাংলাদেশ নামক দুটি দেশকে জোড়া দিতে গিয়ে আবার ছোটখাটো কিছু বিভাজন তৈরি করা হয়েছে। প্রথম আলোর খবরটির অংশ বিশেষ এ রকম; “ভারত, না বাংলাদেশ। একমত হতে পারলেন না দুজন। স্বামীর সিদ্ধান্ত ভারত, স্ত্রীর বাংলাদেশ। ভূখ- বেছে নিতে দুই নাড়ির দুই টান। অবশেষে ভারত-বাংলাদেশে ভাগ হয়ে ছিঁড়ে গেল সরোয়ার আলম ও মেরিনা বেগমের দাম্পত্যের বাঁধন। মেরিনা ও সরোয়ার দাশিয়ারছড়ার তিন নম্বর মৌজার বাসিন্দা। কথা বলে জানা গেল, সরোয়ারের জন্ম ও বেড়ে ওঠা দাশিয়ারছড়ায়। আর মেরিনার জন্ম বাংলাদেশে, কুড়িগ্রাম জেলার ফুলবাড়ী উপজেলার কাশিপুরে। ২০১১ সালে তাদের বিয়ে হয়। তাদের ঘরে আছে দুই সন্তান মোস্তাফিজুর রহমান হিমেল ও আবদুল্লাহ আল মুয়াদ। বুধবার (২৯ জুলাই) বিকেলে দাশিয়ারছড়ায় বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে কথা হয় সরোয়ার আলমের সঙ্গে। কোলে দুই বছরের ছেলে হিমেল। সরোয়ার জানান, তাদের চার ভাইয়ের দুজন পরিবার নিয়ে ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পাশের খড়িবাড়ি বাজারের গত হাটে নিজের দুটি গরু ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়েছেন। নিজের ভাগের কিছু গাছগাছড়া বেচে দিয়েছেন ২৮ হাজার টাকায়। সরোয়ার বলেন, দুই ছেলে আর স্ত্রীসহ ৯ জুলাই ফুলবাড়ী উপজেলায় গিয়ে ভারতের অধিবাসী হওয়ার আবেদন করেছিলেন। কিন্তু পরে স্ত্রী মত পাল্টান। ২২ জুলাই স্ত্রী মেরিনা ছোট ছেলে মুয়াদকে নিয়ে বাবার বাড়ি ফুলবাড়ীর কাশিপুরে চলে যান। প্রতিবেশীদের বক্তব্য, দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে স্ত্রীকে জোর করে রাজি করিয়েছিলেন সরোয়ার। তাই বিদায় নিতে যাওয়ার কথা বলে ছয় মাসের শিশু-সন্তান মুয়াদকে নিয়ে বাবার বাড়ি যান। সেখান থেকে তিনি আত্মগোপন করেন। এর মধ্যে সরোয়ার জানতে পারেন, তার স্ত্রী ২৭ জুলাই উপজেলায় গিয়ে নিজের ও দুই সন্তানের ভারতের যাওয়ার তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে এসেছেন। সরোয়ার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে স্ত্রী-সন্তানের খোঁজ পাননি।” খবরের সূত্র ধরে জানা যায় যে, মেরিনা তার নিজের দেশে থাকার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমনকি একটি সন্তানের মায়া ও স্বামীর সঙ্গে জীবনযাপন না করতে পারার বেদনা নিয়েও মেরিনা তার নিজের দেশ ছাড়তে চান না। একজন অতি সাধারণ এক যুবতী নারীর এই দেশপ্রেমকে কি দিয়ে যে তুলনা করা যাবে সেটি আমি ভেবেই পাই না। আমার জীবনে এমন অনেক অভিজ্ঞতা আছে একাত্তরের। আমার পাশের থানা শাল্লার রাজাকাররা যখন হিন্দুদের বাড়িতে আগুন দিচ্ছিল তখন আমার নিজের থানার হিন্দুদের মাঝে ভারত যাওয়ার প্রচ- তাড়না কাজ করছিল। সেই সময়ে আমার অনেক হিন্দু স্বজনকে স্পষ্ট ভাষায় বলতে শুনেছি- আমার দেশ ছেড়ে আমি যাব না। সারা দুনিয়াতে নিজের দেশ ও পরের মাটিকে ঘিরে মানুষের যে জীবন সেই জীবনে বার বার মেরিনারা অগ্নিপরীক্ষা প্রদান করেন এবং নিজেদের মাটির মানুষ হিসেবে প্রমাণ করেন। মাত্র দুই বছরের একটি শিশুকে ছেড়ে মা মেরিনার জীবন যে কত বেদনার হবে সেটি ভাবতেও কষ্ট লাগে। স্বামী ছাড়া একটি যুবতী মেয়ের জীবনযাপনও যে কত সংগ্রামের সেটি ভাবাই যায় না। তবুও মাটির টান এক বিশাল অনুভূতিকে প্রকাশ করেছে। শুভ কামনা মেরিনা ও তার সন্তানদের জন্য। প্রথম আলোর খবরে একই ধরনের ভিন্ন মাত্রার আরও একটি খবর ছাপা হয়েছে। খবরটি এ রকম; লক্ষ্মীবালা যাচ্ছেন, থাকছেন মধুসূদনরা : দাশিয়ারছড়ার দুই নম্বর মৌজায় পাশাপাশি ঘর, দুই ভাই-বোন লক্ষ্মীবালা মোহন্ত ও মধুসূদন মোহন্ত। ৩৫ বছর ধরে এক বাড়িতে বসবাস তাদের। আরেক ভাই হরেকৃষ্ণ মোহন্তর বাড়ি তিন জমি পর। লক্ষ্মীবালার ছোট বোন যমুনা মোহন্ত আছেন সীমান্তের ওই পাড়ে ভারতের কোচবিহার জেলার নয়ারহাটে। সেখানেই তার বিয়ে হয়েছে। লক্ষ্মীবালার সিদ্ধান্ত, দুই ছেলে হরিচরণ ও বিষ্ণু মোহন্ত, ছেলের বউ আর পাঁচ নাতনিকে নিয়ে বোন যমুনার কাছাকাছি থাকবেন। মধুসূদন ও হরেকৃষ্ণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে থাকার। ভারতের ছিটমহলের বাসিন্দা হলেও দুই ভাই আত্মীয়তা গড়েছেন বাংলাদেশীদের সঙ্গে। এর মধ্যে মধুসূদনের মেয়ে কৃষ্ণা রানীর বিয়ে দিয়েছেন লালমনিরহাটের বড়বাড়ি এলাকায়। ছেলে নরেশ ঢাকায় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করছেন। এতদিন পাশাপাশি থাকা বোন-ভাগ্নেরা ভিটে খালি করে চলে যাচ্ছেন ভারতে। মধুসূদন মোহন্ত বলেন, ‘বাপ-দাদার জন্ম এই বাড়িতেই। ভিটা ছাড়ি কোটে যামো। বোনকে অনেক বুঝাইলাম, তারা থাইকবার চায় না। তাই যদি না থাকে, তাক আটকে রাখার ক্ষমতা তো আমার নাই। আমি ছওয়া পাওয়া ছাড়ি যাবার পারব না।’ বুধবার দাশিয়ারছড়ায় গিয়ে দেখা যায়, বোন লক্ষ্মীবালার ঘরে চলছে বিদায়ের প্রস্তুতি। ছয়টি গাছ তিন হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন। সেটি কাটাকুটি চলছে। ঘরে দুটি ছাগল ছিল। একটি জেঠাসের মেয়ে আঙ্গুরীকে, আরেকটি সম্বন্ধীর মেয়ে অনন্যাকে দিয়ে দিয়েছেন। এখন কাপড়চোপড, কাঁথাবালিশ, ঘটিবাটি আর নিজে যে রিক্সা-সাইকেলের মেকারি করতেন, সেই হাতিয়ারগুলো গোছগাছ বাকি, জানালেন হরিচন্দ্র মোহন্ত। দুই ভাই হরি ও বিষ্ণুর নামে ঘরভিটাসহ ৪১ শতক জমি আছে। সেগুলোর কোন বন্দোবস্ত হয়নি। ভিটেবাড়ি ছেড়ে কেন যাচ্ছেন? জবাবে হরিচন্দ্রের মা লক্ষ্মীবালা বলেন, ‘এটে দুই ভাই। ওখানে (ভারত) দুই মেয়ে, ননদ, কাকারা থাকে। ইন্ডিয়া গেলে ওই দেশের সরকার দুই বছর পুইষবে, পাঁচ লাখ টাকা, থাকবার ঘর করি দিবে, তাই যাবার চাই।’ বুধবার লক্ষ্মীবালার ঘরের পেছনের গাছ দুটি যখন কাটা হচ্ছিল, ঠিক তখন কানে আসছিল ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির মঞ্চ নির্মাণের হাতুড়ির ঠুকঠাক আওয়াজ। লক্ষ্মীবালার বাড়ির কয়েক জমি পরেই বানানো হচ্ছিল উৎসব মঞ্চ। এর পাশ ঘেঁষেই সিমেন্টের পিলার পুঁতে দাশিয়ারছড়া দাখিল মাদ্রাসার সাইনবোর্ড টাঙিয়ে চলছে ঘর বানানোর কাজ। মধুসূদনের জন্য চ্যালেঞ্জটি অনেক বড়। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম প্রধান দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে মধুসূদনদের অবশ্যই অনেক বড় সাহস করতে হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে যখন জঙ্গীবাদ, উগ্রতা ও ধর্মীয় বিভাজন রেখা প্রকট তখন ভারতে না গিয়ে বাংলাদেশে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়াটা কেবল সাহসের নয়, দুঃসাহসের। উপরন্তু দুই বছরের থাকা ও খাওয়া, পাঁচ লাখ টাকার অনুদান ইত্যাদির মায়া মাটির টানে ছাড়তে পারাকে কোনভাবেই ছোট করে দেখার নয়। আমার নিজের জীবনে মেরিনা-লক্ষ্মীবালা-মধুসূদনের গল্পের মতো একাধিক গল্প আছে। প্রায় দুই শতাধিক বছর আগে আমার দাদি আদির মা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রাম থেকে ভাটি বাংলার নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে গিয়েছিলেন ভাইদের হাত ধরে। নবীনগরে তার স্বামী ছিল, ছিল সংসার। তিনি মেরিনার মতো স্বামীকে ছেড়ে যান। আমার দাদা মুন্সী আলীমুদ্দিন তালুকদারেরও স্ত্রী ছিল। ছিল সংসার। তার স্ত্রী তার সঙ্গে উত্তরে যেতে রাজি হননি। তিনি একাই ভাইদের সঙ্গে নিঃসম্বল অবস্থায় উত্তরে পাড়ি দিয়েছিলেন। কাকতালীয়ভাবে ভাইদের হাত ধরা স্বামীকে ছেড়ে যাওয়া আদির মার সঙ্গে স্ত্রীকে ফেলে আসা মুন্সী আলীমুদ্দিনের বিয়ে হয় এবং তারা গড়ে তুলেন তাদের নিজস্ব পৃথিবী। তাদের সফলতারই প্রমাণ হিসেবে আমরা বেড়ে উঠেছি। আমার বড় মেয়ে সাবরিনা একটি আন্তর্জাতিক মেডিক্যাল এনজিওতে কাজ করে বলে তার কাছ থেকে আমি প্রতিদিনই মেরিনা, লক্ষ্মীবালা, আদির মা আর আলীমুদ্দিনের কাহিনী শুনি। দক্ষিণ সুদান থেকে তুরস্ক অবধি একই ধরনের গল্পের অবিরাম জন্ম হচ্ছে। এই গল্পগুলোতে আমরা একদিকে যেমন ব্যক্তিগত বিভাজন, পারিবারিক নাড়ি ছেঁড়া ও দেশপ্রেমের মতো প্রসঙ্গগুলো দেখতে পাই তেমনি করে খুব নির্মমভাবে চোখে পড়ে শিশুদের জীবন। মেরিনার কোলের শিশু দুটি যখন তাদের পিতা-মাতার বিভক্তিতে বড় হতে থাকবে তখন এদের বিকাশকে কখনও পূর্ণ বলা যাবে না। বরং প্রচ- দুঃখ-ক্ষোভ ও বেদনায় দুই দেশে দুই ভাই আপন জনের সন্ধানে নিজেকে কাঁদিয়ে বুক ভাসাবে। ৬৮ বছর পর যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ সফলতার প্রতীক হিসেবে আমরা ছিটমহল সমস্যার সমাধান হতে দেখছি তখন মনে হচ্ছে জঘন্য কাজটির সমাধান যদি সেই ৪৭ সালেই করা হতো তবে আজকের বিয়োগান্তক ঘটনাগুলো ঘটত না। এমনকি যদি বাংলাদেশের শাসককুল জিয়া-এরশাদ-খালেদাও এর সমাধান করতেন তবে আর যাই হোক মেরিনার জীবনের ট্র্যাজিডিটা হয়ত ঘটত না। এসব প্রেক্ষিত বিবেচনা করলে এটি খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায় যে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে যদি যথাসময়ে সঠিক কাজটি না হয় তবে মেরিনাদের ট্র্যাজিডির জন্ম হয় আর যদি করা যায় তবে মেরিনাদের দুয়েকটি ট্র্যাজিডিতেই তার সমাপ্তি রেখা টানা যায়। আজ আমরা আনন্দের সঙ্গে বলতে পারব যে ছিটমহলে আর কখনও মেরিনার গল্প আমাদের আর আনন্দ বেদনার সাগরে ভাসাবে না। ঢাকা, ৩১ জুলাই, ২০১৫ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যারের জনক ॥ ই-মেইল : [email protected] ওয়েবপেজ: www.bijoyekushe.net,ww w.bijoydigital.com
×