ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আদিবাসীদের সংগ্রামের গল্প ‘রাঢ়াঙ’

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২ আগস্ট ২০১৫

আদিবাসীদের সংগ্রামের গল্প ‘রাঢ়াঙ’

সাজু আহমেদ ॥ নাটক শুধু বিনোদন নয় শ্রেণী সংগ্রামের সুতীক্ষè হাতিয়ার তথা বিপ্লবের ঝা-া। অন্তত তাই মনে করে দেশের প্রথম সারির নাটকের দল আরণ্যক। সেই চেতনায় নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এ বিষয়টিকেই তারা শ্লোগান হিসেবে নিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দলের এ পর্যন্ত মঞ্চস্থ সব নাটকেই শোষকবিরোধী বিপ্লবী সেøাগান লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে এই দল প্রযোজিত নাটকগুলোতে সমাজের বঞ্চিত খেটে খাওয়া মানুষের জীবনকথনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে বারবার। ‘রাঢ়াঙ’ নাটকটি তেমনি এক অনবদ্য উপাখ্যান। ২০০৪ সালে নাটকটি প্রথম মঞ্চে আসে। এরপর নাটকের আঙ্গিক, বিষয়বস্তুর নান্দনিক উপস্থাপনা এবং ভিন্ন অভিনয়শৈলীর কারণে দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও আলোচিত হয়েছে। দেশের প্রথিতযশা নাট্যজন মামুনুর রশীদ রচিত ও নির্দেশিত নাটকটি জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দেড়শতম প্রদর্শনীর গৌরব অর্জন করেছে। এ উপলক্ষে দলের পক্ষ থেকে তিন দিনব্যাপী উৎসবের আয়োজন করা হয়। শনিবার এ উৎসব শেষ হয়েছে। ‘রাঢ়াং’ নাটকের দেড়শততম মঞ্চায়ন উপলক্ষে উৎসবের আয়োজন করা হলেও উৎসবের প্রথম দিন বৃহস্পতিবার মঞ্চস্থ হয় দলের আরেক প্রযোজনা ‘বঙ্গভঙ্গ’ নাটকটি। আর উৎসবের শেষদিন শনিবার মঞ্চস্থ হয় দলের আরেকটি নান্দনিক প্রযোজনা ‘স্বপ্নপথিক’। এ উপলক্ষে শনিবার সকালে এক সেমিনারেরও আয়োজন করা হয়। সেমিনারে আলোচকদের বক্তব্যে উঠে আসে আদিবাসীদের অধিকার ও সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে নানা কথা। তবে উৎসবের আকর্ষণ ছিল ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের মঞ্চায়ন। শুক্রবার ছুটির হওয়ায় জাতীয় নাট্যশালার এক্সপেরিন্টাল থিয়েটার মিলনায়তন পরিপূর্ণ ছিল দর্শকে। সন্ধ্যার আগে থেকে বৃষ্টি শুরু হলেও বিশেষ এ প্রদর্শনী উপভোগ করতে এসেছিলেন সর্বশ্রেণীর দর্শক। বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় শুরু হয় নাটকের দেড়শতম মঞ্চায়ন। নাটকের গল্পে দেখা যায় তৎকালীন তানোর নামের এক লোকালয়ে সাঁওতালরা বাস করে। সেখানে তাদের কোনো নিজস্ব জমি নেই। পরের জমিতে চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের। সেখান থেকে বিশ্বম্বর নামক এক জোতদারের প্রলোভনে তারা তানোর ছেড়ে পাড়ি জমায় ভীমপুরে। জমি পাওয়ার আশায় তারা ছেড়ে যায় তাদের দীর্ঘদিনের বসতভিটা। কিন্ত ভীমপুরে গিয়েও তারা জমির কাগজ পায় না। আজকাল বলে বিশ্বম্বর তাদের প্রতিদিনই ঘোরায়। কিন্ত তাদের দিয়ে ঠিকই ফসল ফলিয়ে তার বড় অংশটা সে নিয়ে যায়। ধীরে ধীরে ক্ষোভ বাড়তে থাকে সাঁওতালদের মনে। এদিকে ভীমপুরের স্থানীয় আরেক জোতদার হাতেম আলী তার এলাকায় সাঁওতালদের মেনে নিতে পারে না। সে বিভিন্নভাবে সাঁওতালদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা চালায়। এমনকি সাঁওতালদের পেছনে পুলিশও লেলিয়ে দেয়। এরই মধ্যে বিশ্বম্বরের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর বিশ্বম্বরের ভাইয়ের ছেলে গদাই হাতেম আলীর সঙ্গে মিলে সাঁওতালদের শোষণের ফন্দি আঁটে। কিন্ত সাঁওতালরা যখন দেখে যে, হাতেম ও গদাইয়ের লোকজন না জানিয়ে তাদের ঘামে ফলানো ফসল কেটে নিয়ে যাচ্ছে তখন তারা বিদ্রোহে ফেটে পড়ে। সাঁওতাল যুবক আলফ্রেড সরেনের নেতৃত্বে হাতেম ও গদাইয়ের সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে তাদের লড়াই বাধে। কিন্ত সাঁওতালদের সম্বল সামান্য তীর-ধনুক দিয়ে তারা ভাড়া করা গু-া বাহিনীর সঙ্গে পেরে ওঠে না। লড়াইয়ে করুণ পরাজয় ঘটে সাঁওতালদের। নিহত হয় তাদের নেতা আলফ্রেড সরেন। স্বপ্নভঙ্গ হয় সাঁওতালদের। ‘রাঢ়াঙ’ নাটকের অন্যতম বিশেষত্ব হলো এটি একটি সেটবিহীন নাটক। এ্যারিনা মঞ্চে উপস্থাপনায় নাটকটির প্রাণ এর সঙ্গীত ও কোরিওগ্রাফি। নাটকের গল্প বর্ননায় সাঁওতালদের নিজস্ব নাচ ও গানগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে যা দর্শকদের আলাদা আনন্দ দেয়। যে কারণে দেশের অন্যান্য প্রযোজনাগুলো থেকে আলাদা। প্রসঙ্গত, ‘রাঢ়াঙ’ মূলত একটি সাঁওতালি শব্দ। এর অর্থ দূরাগত মাদলের ধ্বনি। দূরাগত মাদলের ধ্বনির সঙ্গে শোষিত সাঁওতালদের জেগে ওঠার আহ্বান জানানো হয়েছে এই নাটকে। এ অঞ্চলের আদিবাসীদের ভূমির অধিকারের লড়াইয়ে সাঁওতালদের অবদান একটি কিংবদন্তিসম উপাখ্যান। ভারত বিভক্তির পর ইলা মিত্রের নেতৃত্বে নাচোলের কৃষক আন্দোলনে সাঁওতালদের ভূমিকা আজও সংগ্রামী কৃষক ও আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে এক অনুসরণীয় আলোকবর্তিকা। ভারতীয় উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সাঁওতালরাই প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধে রুখে দাঁড়ায়। ১৭৮৪ সালে হাজারীবাগ জেলার কালেক্টর ক্লিভল্যান্ডকে হত্যার মাধ্যমে সাঁওতালদের প্রতিরোধের সূত্রপাত ঘটে। পরে ১৮৫৫ সালে সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে ঘটে সাঁওতাল বিদ্রোহ। যা ছিল এক ঐতিহাসিক প্রতিরোধ। এই বিদ্রোহের প্রভাবেই পরবর্তীতে ১৮৫৭ সালে সংঘটিত হয় সিপাহী বিদ্রোহ। সর্বশেষ ২০০০ সালে বাংলাদেশের নওগাঁয় সাঁওতাল যুবক আলফ্রেড সরেনের নেতৃত্বে সাঁওতালরা জেগে ওঠে ভূমির লড়াইয়ে। এ লড়াইয়ের শেষ পরিণতি ঘটে আলফ্রেড সরেনের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে। এমনি প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে ‘রাঢ়াঙ’ নাটকেরর শরীর।
×