ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে হারের প্রতিশোধ নিতেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ২ আগস্ট ২০১৫

মুক্তিযুদ্ধে হারের প্রতিশোধ নিতেই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র একটি দিনে আমরা নিঃস্ব হলাম’Ñ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সবাইকে হারানোর বেদনায় কাতর হয়ে যখন কাঁদছিলেন, তখন উপস্থিত নেতাকর্মীরা কেউ-ই তাদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। রক্তাক্ত-শোকাবহ আগস্টের প্রথম দিনে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা যেমন কাঁদলেন অঝরধারায়, তেমনি কাঁদালেন সবাইকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘৩১ জুলাই জার্মানিতে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন ভাবতেও পারিনি যে, এতবড় একটা আঘাত আসবে। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধান। তারপর একদিনেই সব হারালাম। সকলকে রেখে গেলাম। আর একদিনে আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’ এ কথা বলার পর বেশকিছু সময় তাঁর চোখ দিয়ে পড়ছিল সব হারানোর বেদনার অশ্রু, কণ্ঠ ছিল বাকরুদ্ধ। পিনপতন নীরবতায় তিনি আরও বলেন, ১৫ আগস্টের আঘাতটা একটি পরিবারের ওপরই হেনেছিল, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেটা শুধু পরিবারের ওপর আঘাত ছিল না। সেটা ছিল দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে পরাজিত শক্তির প্রতিশোধের আঘাত। বাঙালী জাতির এই যে বিজয়-উত্থান, একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পরাজিত করাÑ এই পরাজয়ের প্রতিশোধটাই ছিল এই হত্যাকা-ের মূল উদ্দেশ্য, যাতে বাঙালী জাতি কখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। আর সেটি প্রমাণিত হলো যখন ৩ নবেম্বর জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলো, যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করে বিজয় এনে দিয়েছিলেন। শনিবার শোকের মাস আগস্ট শুরুর প্রথম দিন কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীতে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নিজের পরিবারের সেই বিভীষিকাময় দিনটির স্মৃতিচারণ করছিলেন, তখন এমন আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মাত্র একদিনে সর্বস্ব হারানোর বেদনাগুলো প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত হাজারো নেতাকর্মীর সামনে যখন বর্ণনা করছিলেন, তখন কেউ-ই তাদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি। কৃষক লীগ সভাপতি মোতাহার হোসেন মোল্লার সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট শামসুল হক রেজাসহ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় ও মহানগর নেতারা বক্তব্য দেন। ভয়াবহ সেই ১৫ আগস্টের কথা মনে করতে গিয়ে আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদেশে থাকায় আমরা দু’বোন প্রাণে বেঁচে যাই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমাদের দেশে আসতেও বাধা দেয়া হয়েছিল। এরপর দেশে ফিরতে পারিনি। খুনী মোশতাক ও জিয়া ক্ষমতা দখল করল। অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু তারা আমাকে দেশে আসতে দেয়নি। কিন্তু দেশের জনগণের চাওয়া ও তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতেই পরবর্তীতে বাধা উপেক্ষা করে দেশে ফিরে আসি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুই সন্তানের স্নেহ-মমতা ত্যাগ করে চলে এলাম বাংলার মানুষের পাশে। যে দুঃখী মানুষের জন্য আমরা বাবা জীবন দিয়ে গেছেন, সেই দুঃখী মানুষের মুখে কিভাবে হাসি ফোটানো যায়, কিভাবে এই দেশের স্বাধীনতাকে সাফল্যম-িত করা যায়, স্বাধীনতার সুফল বাংলার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া যায়Ñ সেই লক্ষ্য নিয়েই ফিরে এসেছি বাংলার মাটিতে। বিভিন্ন সময় তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টায় হামলার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বার বার আঘাত এসেছে, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু পিছপা হইনি। কারণ আমরা জানি সত্যের জয় আছেই। তিনি বলেন, এই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন আমার বাবা। এই বাঙালী জাতিকে স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাই কোন দল, স্বাধীনতার শত্রু, চক্রান্তকারী যতই চক্রান্ত করুক না কেন, জাতির পিতাই তো বলে গেছেন বাঙালী জাতি সম্পর্কেÑ কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না। তাই এই বাঙালী জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। এটা আমরা জানি, সে জন্যই শত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কৃষক লীগের অনুষ্ঠানে দেশের কৃষি ও কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে তাঁর সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এই কৃষকের ভাগ্যের পরিবর্তন করাই ছিল জাতির পিতার লক্ষ্য। তিনি বার বার কৃষকদের কথা বলতেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বর্তমান সরকারের কৃষি উপকরণের সহজলভ্যতা, কৃষকদের জন্য ভর্তুকি দেয়া, কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধি, পল্লী সঞ্চয় বৃদ্ধি, গ্রামে অর্থপ্রবাহ বাড়ানো, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন অগ্রগতির কথা তুলে ধরে বলেন, কৃষকদের উন্নত জীবন দেয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি কর্মসূচী বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষকে যাতে ভিক্ষা করতে না হয় সেটাই নিশ্চিত করা হচ্ছে। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত চক্র উন্নয়নকাজে বারংবার বাধা দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের বাধা সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশকে কেউ আর অবহেলার চোখে দেখে না। এখন বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। তিনি বলেন, ঘোষণা দিয়েছিলাম ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হবে। ২০১৫ সালেই দেশ নিম্ন মধ্য আয়ের দেশ হয়েছে। তবে আমরা নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে থাকতে চাই না। দেশ হবে উন্নত। ২০৪১ সালের মধ্যে তা নিশ্চিত করা হবে। কৃষক লীগ আয়োজিত স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচীর প্রশংসা করে তিনি বলেন, রক্তদান একটি মহান কাজ। আপনার দান করা রক্ত বাঁচাতে পারে অন্যের জীবন। আর সে কারণে বেশি বেশি রক্তদান করতে হবে। তিনি বলেন, আমিও এক সময় নিয়মিত রক্ত দিয়েছি। এখন বয়স বেড়ে যাওয়ায় রক্ত দেয়া যাচ্ছে না। যারা রক্তদান করতে পারেন তারা নিয়মিত রক্তদান করবেন, সেটাই আমরা প্রত্যাশা। বক্তব্য শেষে কৃষক লীগের আয়োজনে এই রক্তদান কর্মসূচীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
×