ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ছিটবাসীর মা হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২ আগস্ট ২০১৫

ছিটবাসীর মা হলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা

তাহমিন হক ববি, ছিটমহল থেকে ॥ এতদিন ডিমের ভেতর বসেছিলাম। সেই ডিম ফেটে আজ আমরা ছিটমহল থেকে বেরিয়ে এলাম। পেলাম দেশ, জাতি এবং পরিচয়। আমাদের আজ নতুন ভোর, নতুন সূর্যের আলো ছড়িয়ে দেয়া হলো। মা ডাক দিয়েই কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর বড়খানকিবাড়ি গীতালদহের ফরহাদ হোসেন (৫৫)। তিনি বললেন, আজ থেকে বিলুপ্ত হওয়া ছিটবাসীদের মা হলেন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই মা আমাদের স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক করে সকলকে নিজের সন্তান হিসেবে বুকে টেনে নিলেন। ফরহাদ হোসেন যখন কথাগুলো বলছিলেন তখন বইছিল মাঝারি দমকা হাওয়া। প্রকৃতি যে কখনও কখনও মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে আপ্লুত করে দুই চোখে আনন্দের কান্না নিয়ে আসতে পারে তা ফরহাদ হোসেন দেখিয়ে দিলেন। গোটা রাত কিভাবে কেটে গেছে তা শুধু ফরহাদ হোসেন নয়, নীলফামারীর ৪টি বিলুপ্ত হওয়া ১১৯টি ছিটমহলের পরিবারের ৫৪৫ জন নারী-পুরুষ ঠাওর করতে পারেনি। রাত ১২টার পর ছিটমহল নামের অবসানে ৬৮ বছরের বন্দীদশা থেকে মুক্তির জন্য ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্বলিত করে সারারাত ধরে জয় বাংলার সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত করে রেখেছিল তারা। এ সময় প্রশাসন ও পুলিশ তাদের নিরাপত্তায় ছিল নিয়োজিত। পহেলা আগস্ট সেই কাকডাকা ভোর। পাখিদের কিচিরমিচির ডাক ছড়িয়ে পড়ছে। পাঁচ ঘণ্টা আগে বিলুপ্ত হয়েছে ছিটমহলগুলো। কিছুক্ষণের মধ্যে পূর্বের আকাশে উঁকি দেবে সূর্যি মামা। তার আগেই রাষ্টীয়ভাবে উত্তোলন করা হবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। বড়খানকিবাড়ি খারিজা গীতালদহ বিলুপ্ত ছিটমহলে ৮টি পরিবারের ৪২ জন নারী-পুরুষ জড়ো হয়েছে একটি উঁচু ডিবির উপর। সেখানে প্যান্ডেল করা হয়েছে। ডিমলা উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা এসএম সফিকুল ইসলাম এখানে এসে রাষ্ট্রের পক্ষে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন। সবাই গাইছিল বাংলাদেশের জাতীয়সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’। এখানে উপস্থিত ছিলেন ফরহাদ হোসেন, তার বিধবা মা জয়গুন বেওয়া, স্ত্রী আঞ্জুয়ারা বেগম, তিন সন্তান যথাক্রমে আলিমুজ্জামান (২৩), আখতারুজ্জামান (১৬) ও আফরোজা আক্তার (৭)। জাতীয় পতাকা উত্তোলন শেষে যখন মোনাজাত করা হচ্ছিল তখনও দেখা গেল ফরহাদ হোসেন কাঁদছেন। দোয়া শেষে চোখ মুছতে মুছতে বললেন,০ আজ যদি পিতা (জাফর উল্লাহ) বেঁচে থাকতেন তাহলে কতই না খুশি হতেন। ফরহাদের বিধবা মা জয়গুন বেওয়া (৭৫) বলেন, স্বামী ১৯৭৩ সালে মারা গেছেন। ভারতীয় ছিটবাসী থেকে বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার পর ফজরের নামাজের পর স্বামীর কবরে গিয়ে দোয়া করে বলেছি, বঙ্গবন্ধুর কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের নাগরিক করে নিয়েছে। আমরা আর ছিটের আজাইরা নই। এ সময় ফরহাদ হোসেন চিৎকার করে বলে ওঠেনÑ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। পিতার সঙ্গে তার সন্তানরাও একই সেøাগান দিয়ে ওঠে। এই বিলুপ্ত ছিটমহলের সব থেকে বেশি বয়সী নারী বিধবা ময়মন বেওয়া। ছিটমহল এখন বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ায় ওই বৃদ্ধাও আনন্দে আত্মহারা। তার ৭ ছেলে ৭ মেয়ের মধ্যে ৯ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। বাংলাদেশের মূল ভূখ-ে বিয়ে হয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের ৪৫ সন্তান ও ৪০ নাতি-নাতনির ১০৫ জন পুতি রয়েছে এই বৃদ্ধার। এ সময় এই বৃদ্ধা বললেন, শেখের বেটি হাসিনা হামার এইবার কামের কাম করি দেলে (দিলেন)। মুই শেখের বেটিক প্রাণভরি দোয়া দেছো। বর্তমানে এই বৃদ্ধার বয়স ১০৬। হাঁটতে কষ্ট হয়। দুটি লাঠির ওপর ভর করেই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছেন তিনি। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে স্বামী জাফর আলীকে চিরদিনের জন্য হারিয়েছেন। নগর জিগাবাড়ি ছিটমহলের ৪৫টি পরিবারের ২২০ জন সদস্যের মধ্যে চারটি হিন্দু পরিবার রয়েছে। মৃত অতুল চন্দ্রের তিন পুত্র রঞ্জিত চন্দ্র রায়, ভরত চন্দ্র রায় এবং সনাতন চন্দ্র রায় ও মৃত বীরেন্দ্র নাথের পুত্র অতুল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে কথা বললে তারা ছিটমহল বিনিময়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেন, বাপ-দাদাদের রেখে যাওয়া ভিটেবাড়ি রেখে কোথাও যাব না বলেই ভারতীয় নাগরিক থেকে নাম কাটিয়ে বাংলাদেশর নাগরিক হতে নিবন্ধন করেছিলাম। বাড়িতে বাড়িতে তারা ছিটের অবসানে ৬৮টি প্রদীপবাতি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। তারা বললেন, জীবনের বড় যে চাওয়া-পাওয়া ছিল আজ সেটি পেলাম। ছিটের আজাইরা থেকে হলাম বাংলাদেশের সন্তান। এই জন্য শেখ হাসিনার কাছে আমরা চিরদিন ঋণী হয়ে থাকব। জিগাবাড়ি গ্রামের আখতারুল ইসলাম (৫৫) বললেন, আমরা নাগরিক অধিকার ফিরে পেলাম। দিনটি আমাদের কাছে স্মরণীয়। গিদালদহ গ্রামের ওমর ফারুক বলেন, এসব ছিটমহলের অধিকাংশ শিশু ছিল লেখাপড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আর যারা লেখাপড়া করেছে তারা চুরি করে বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে যাতায়াত করত দূর-দূরান্ত থেকে। মিথ্যা ঠিকানা ব্যবহার করে তাদের ভর্তি হতে হয়েছিল স্কুলে। কিন্তু একটা পর্যায়ে ধরা পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে অনেকের লেখাপড়া। আর ফাঁকি দিয়ে লেখাপড়া শিখে যোগ্যতা অর্জন করলেও নাগরিকত্বের প্রশ্নে তারা পারেনি উভয় দেশের সরকারী চাকরিতে যোগ দিতে। এমন পরিস্থিতির অবসান ঘটায় শিক্ষার্থীরা আনন্দিত। বড়খানকি কান্দাপাড়া ছিটমহলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী মেঘনা আক্তার বলেন, আমাদের লক্ষ্য অর্জনে আর কোন শঙ্কা থাকল না। এখন লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে নিজের ও দেশের জন্য কিছু করতে পারব। পাব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেয়া উপবৃত্তির টাকা। আমরা শেখ হাসিনার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। নগর জিগাবাড়ি ছিটমহলের বাসিন্দা আঞ্জুয়ারা বেগম (৪৫) বলেন, অনেক মানুষ এক সময় আমাদের ওপর জুলুম করেছিল। বিচার-সালিশ করার কেউ ছিল না। এখন এ্যালা বাংলাদ্যাশের নাহরিক হলাম, পেলাম আইনও। এখন রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারব। ঘুমিবার পারিমো বাহে। এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিলাম।
×