ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চলাচল বন্ধের নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন শুরু

মহাসড়কে ২০ লাখ অনুমোদনহীন যানবাহন ॥ মালিক-শ্রমিকদের অবরোধ ॥ আন্দোলনের হুমকি

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২ আগস্ট ২০১৫

মহাসড়কে ২০ লাখ অনুমোদনহীন যানবাহন ॥ মালিক-শ্রমিকদের অবরোধ ॥ আন্দোলনের হুমকি

রাজন ভট্টাচার্য ॥ দেশের বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কে প্রায় ২০ লাখ নসিমন, করিমন, অটোরিক্সাসহ অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল করছে। এসব পরিবহনের একটিরও রুট পারমিট নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব যানবাহন সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বছরে দুই শতাংশ সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) ক্ষতি হচ্ছে। এমন বাস্তবতায় দুর্ঘটনা রোধে দেশের প্রায় চার হাজার কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়কে শনিবার থেকে অটোরিক্সাসহ অনুমোদনহীন পরিবহন বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সকাল থেকেই সড়কে মোবাইল কোর্টসহ পুলিশি তৎপরতা বাড়ানো হয়। এরপরও বেশিরভাগ মহাসড়কে এসব পরিবহন চলাচল করেছে। অন্যদিকে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে কর্মসূচী দেয় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরাও। বাস্তবতা হলো, সিদ্ধান্ত কার্যকর করার ক্ষেত্রে সরকারসহ ক্ষুদ্র এসব পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা এখন মুখোমুখি অবস্থানে। সরকারের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবিতে শনিবার সকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, বিক্ষোভ ও মহাসড়ক অবরোধ করেছেন সিএনজি ও ব্যাটারিচালিত অটোরিক্সা মালিক ও চালকরা। সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা না হলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দেন তারা। নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সিএনজি অটোরিক্সা চলাচল বন্ধ নয়, পৃথক লেন তৈরি করা হোক। এই লেন দিয়ে শুধু সিএনজিচালিত যানবাহন চলাচল করবে। তা না হলে কঠোর আন্দোলন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জনস্বার্থে যে কোন মূল্যে পর্যায়ক্রমে সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। ২৭ জুলাই সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, ‘সড়ক নিরাপত্তা বিধানে এ আদেশ ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করা হবে। জাতীয় মহাসড়কে থ্রি-হুইলার অটোরিক্সা ও অটোটেম্পো এবং সব শ্রেণীর অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করতে পারবে না। কোনভাবেই এই প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহার করা হবে না বলে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এমএন ছিদ্দিক বলেন, সরকারের জারি করা প্রজ্ঞাপন কোনভাবে লঙ্ঘন করার অভিযোগ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে, সরকারী সিদ্ধান্তের শুরুর দিন সকাল থেকে জাতীয় মহাসড়কে চলাচলকারী অটোরিক্সা ধরপাকড় শুরু করে পুলিশসহ মোবাইল কোর্ট। প্রতিবাদে শনিবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানেও অবরোধ পালন করেন অটোমালিক ও চালকরা। এ সময় দাউদকান্দি, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও ও মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার অটোমালিক ও চালকরা অংশ নেন। মিরসরাইয়ে মহাসড়ক অবরোধ করার পর স্থানীয় প্রশাসন অটোরিক্সা চলাচলের অনুমতি দেয়। ঢাকা-কিশোরগঞ্জ, বুড়িগঙ্গা সেতুসহ বিভিন্ন মহাসড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। ঢাকা মহানগর সিএনজি অটোরিক্সা ব্যবসায়ী-মালিক সমিতির সভাপতি মোঃ বরকত উল্লাহ ভুলু বলেছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত আমরা মেনে নিতে রাজি নই। এছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের নামে মহাসড়কে সিএনজি বন্ধ করার সিদ্ধান্ত অমানবিক। হাইওয়েতে অটোরিক্সা চলাচলের বিরোধিতা করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ জনকণ্ঠকে বলেন, অটোরিক্সা চলাচল বন্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনার খবর পেয়েছি। তিনি বলেন, নসিমন-করিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-অটোরিক্সাসহ ইজিবাইক বৈধ কোন পরিবহন নয়। বহুবার আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে এসব পরিবহন জাতীয় মহাসড়কে চলাচল বন্ধে সিদ্ধান্ত হলেও কার্যকর হয়নি। এবারই প্রথম সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গেজেট নোটিফিকেশন করেছে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। আমরা জনস্বার্থে নেয়া এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জোরালো ভূমিকা কামনা করেন তিনি। বলেন, এসব পরিবহনের কারণে দিন দিন সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় মহাসড়কে এসব পরিবহন চলাচলের জন্য পৃথক লেনের দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়Ñ এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যৌক্তিক দাবি না হলে কেউ তা মানবে না। কঠোর অবস্থানে সরকার ॥ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয় মহাসড়কে অটোরিক্সা বন্ধে কঠোর অবস্থানে সরকার। সম্প্রতি একাধিক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়ক-মহাসড়কে ইতোমধ্যে নসিমন, করিমন, মাহিন্দ্রসহ অনুমোদনহীন যানবাহন চলাচল কমেছে। কিন্তু নতুন করে যুক্ত হয়েছে অটোরিক্সা। এসব পরিবহনের কারণে সড়ক দুর্ঘটনা বাড়ছে। যার প্রেক্ষিতে জাতীয় মহাসড়কে অটোরিক্সা চলাচল বন্ধের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি। কর্মসূচী ঘোষণা ॥ মহাসড়কে অটোরিক্সা চলাচল নিষিদ্ধের সরকারী সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে বাংলাদেশ অটোরিক্সা-অটোটেম্পো সংগ্রাম পরিষদ ধারাবাহিক আন্দোলন কর্মসূচী ঘোষণা করেছে। আগামী ৪ আগস্ট জেলা প্রশাসকদের কাছে স্মারকলিপি পেশ, ৮ আগস্ট সব জেলা সদরে মানববন্ধন, ৯ থেকে ১১ আগস্ট জেলায় জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও মিছিল এবং সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় সমাবেশ। ৪০ জেলায় মহাসড়ক ব্যবহারের বিকল্প নেই ॥ অটোরিক্সা চালক ও মালিক সমিতির নেতৃবৃন্দ বলছেন, আঞ্চলিক মহাসড়কের চেয়ে জাতীয় মহাসড়ক কম হলেও অন্তত ৪০টি জেলায় মহাসড়ক ব্যবহার না করে অন্য কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। এর প্রধান কারণ হলো বিকল্প সড়ক যোগাযোগ না থাকা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা জেলা অটোরিক্সা, অটোটেম্পো, মিশুক যানবাহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোহাম্মদ ফারুক জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ইতোমধ্যে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, সরকার আমাদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। তাছাড়া সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সকলেই একমত। কিন্তু সকলের দাবি হলো, মহাসড়কের সঙ্গে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচলের জন্য ডিভাইডারসহ পৃথক লেন করতে হবে। এতে সড়ক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, একতরফা সিদ্ধান্তে জাতীয় মহাসড়কে অটোরিক্সা চালানো বন্ধ হলে বহু শ্রমিক বেকার হবে। পথে বসবে বহু পরিবার। পরিবহন নেতৃবৃন্দ জানিয়েছেন, একমাত্র হাটিকুমরুল থেকে বনপাড়া হয়ে নাটোর মহাসড়ক ছাড়া দেশের আর কোনো মহাসড়কের সঙ্গে নিম্নগতির যানবাহন চলার জন্য সাবওয়ে বা বিকল্প সড়ক নেই। ফলে চট্টগ্রাম, পাবনা, রংপুর, বগুড়া, রাজশাহী, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, কুমিল্লা, সিলেট প্রভৃতি জেলা শহর থেকে মহাসড়ক ব্যবহার না করে অনেক উপজেলা শহরে যাওয়ার সুযোগ নেই। এসব ক্ষেত্রে মহাসড়কে হঠাৎ করে ছোট যানবাহন চলাচল বন্ধ হলে জেলা শহরের সঙ্গে উপজেলার মানুষের যাতায়াতে অচলাবস্থার সৃষ্টি হবে। সীতাকু-ের সঙ্গে চট্টগ্রামের যোগাযোগের জন্য ৩২ কিলোমিটার মহাসড়ক ব্যবহার অপরিহার্য। কালিহাতী থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটারজুড়ে বিকল্প সড়ক না থাকায় জাতীয় মহাসড়ক ব্যবহার করতে হচ্ছে। দাগনভূঞা থেকে ফেনী পর্যন্ত যেতে হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ব্যবহারের বিকল্প নেই। নারায়ণগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন রেজিঃনং ডি-২৩০২-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সামসুল আলম ও সাধারণ সম্পাদক আবু হাসান টিপু বলেছেন, সড়ক দুর্ঘটনার অজুহাতে মহাসড়কে সিএনজি অটোরিক্সা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা বরদাস্ত করা হবে না। নেতৃবৃন্দ বলেন, বিশেষজ্ঞদের মতে সাম্প্রতিককালের ৯০ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনাই হয়েছে সরকারের অব্যস্থাপনা, অন্ধ মোড়, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, পরিবহন চলাচল আইনের যথাযথ ব্যবহার না থাকা, লাইসেন্সবিহীন চালক, অপ্রশস্ত ও ভাঙ্গাচোরা রাস্তাঘাটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বহীনতার কারণে। অথচ সরকার তার দায় এড়াতে সড়ক দুর্ঘটনার অজুহাতে মহাসড়কে সিএনজি অটোরিক্সা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ পরিষদের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৮ লাখ নসিমন, করিমন, ভটভটি বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে, যার একটিও সরকারীভাবে অনুমোদিত নয়। তিন লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত রিক্সা ও ইজিবাইক মহাসড়কে চলতে দিয়ে কোন অবস্থাতেই নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমাদের দেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনের মধ্যে ৮৬ দশমিক ৬টি যানবাহন প্রতি বছর মারাত্মক দুর্ঘটনায় পড়ছে। এই পরিসংখ্যানে নিহতের সংখ্যা এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ ১৬৯ জন। দুর্ঘটনার কারণে দেশের জিডিপির ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। এদিকে, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব পরিবহন নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়েছেন বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আলী রেজা। তিনি বলেন, সরকারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে হলে চালক-শ্রমিকদের জীবনযাপনের বিষয়টি ভাবা উচিত।
×