ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

বজ্রপাত নতুন দুর্যোগ, বাংলাদেশে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩ আগস্ট ২০১৫

বজ্রপাত নতুন দুর্যোগ, বাংলাদেশে মৃত্যু সবচেয়ে বেশি

সমুদ্র হক ॥ শুধু ভূমিকম্পের নয় বাংলাদেশে নতুন করে দেখা দেয়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাতেরও আগাম সঙ্কেত দেয়ার কৌশল বিজ্ঞানীরা এখনও উদ্ভাবন করতে পারেনি। বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যে হারে উষ্ণতা বাড়ছে তাতে বজ্রপাতের হার বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। যার বড় শিকার হবে বাংলাদেশ। এমন শঙ্কা বিজ্ঞানীদের। তারা মনে করেন, পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ভারসাম্য এবং এই শক্তি অক্ষুণœ রাখতে বজ্রপাত প্রাকৃতিক চার্জের কাজ করে। বজ্রপাত প্রতিরোধ করা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতিও বজ্রপাত বাড়িয়ে মাধ্যাকর্ষণের ভারসাম্য ঠিক রাখছে। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট সেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় বাংলাদেশ অতিমাত্রায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। বিশ্লেষণে পরিষ্কার বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। আগামীতে তা আরও বেড়ে যেতে পারে। দেশে প্রতি বছর ঝড়বৃষ্টি ও বর্ষা মৌসুমে প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ৫০ বার বজ্রপাত হয়। সরকারী হিসাবে বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ২শ’। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। কারণ বজ্রপাতে হতাহতের সংখ্যা তাৎক্ষণিকভাবে যা পাওয়া যায় তাই জানা যায়। এর বাইরে ফলোআপের সংখ্যাটি আসে না। বছর কয়েক আগেও বজ্রপাতে একসঙ্গে এক-দুজনের ঝলসে মৃত্যুর খবর মিলত। বর্তমানে একসঙ্গে ৬ থেকে ১৮ জনের মৃত্যুর খবরও মেলে। গত বছর নওগাঁর প্রত্যন্ত গ্রামে এক বাড়ির বারান্দায় অবস্থানরত ১৮ জনের মৃত্যু হয়। ক’বছর ধরে দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক অন্যান্য দুর্যোগের সঙ্গে বজ্রপাত যোগ হয়ে বজ্রপাতেই মানুষের মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষ আগাম প্রস্তুতিও নেয় না, আগাম সঙ্কেতও নেই। হালে ভূমিকম্পে কি করণীয় তা প্রচার করা হচ্ছে। বজ্রপাতে কি করণীয় তার প্রচার নেই। আবহাওয়া বিভাগ যে সঙ্কেত দেয় তা ঝড় ও বৃষ্টিপাতের। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই বজ্রপাত অস্বাভাবিক বেড়েছে। একটা সময় গ্রীষ্মে ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি এবং বর্ষায় অঝোর ধারায় বৃষ্টিতে মেঘের গর্জন ও বজ্রপাত হতো। মৌসুমের পর বৃষ্টি কমে গিয়ে আশ্বিনের শেষে ও কার্তিকে কিছুটা বৃষ্টিপাত হতো। বর্তমানে বৃষ্টির রুটিনে হেরফের ঘটেছে। কখন কোন মেঘে বৃষ্টি ও বজ্রপাত হবে সেই হিসাব আর থাকছে না। প্রকৃতিবাদীরা বলছেন, এসব জলবায়ু পরিবর্তনের ফল। একজন আবহাওয়াবিদ জানান, গ্রীষ্ম এখন বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ পেরিয়ে পরের মৌসুমে এমনকি শীতের আগে পর্যন্ত তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গেই গরম বাতাসে জলীয় বাষ্প উর্ধমুখী হয়ে মেঘের ভেতরে যায়। এই জলীয় বাষ্প যত বেশি হবে মেঘের উষ্ণায়ন ক্ষমতাও অস্বাভাবিক বেড়ে গিয়ে জ্যামিতিক হারে মেঘের সৃষ্টি হবে। বাতাসের এ প্রক্রিয়া ওপর ও নিচে দুভাবে চলতে থাকে। আপ ড্রাফ হলো মেঘের উপরের স্তর এবং ড্রাউন ড্রাফ মধ্যম ও নিচের। এই মেঘই বজ্রমেঘ। এই দুই মেঘের মধ্যে বৈদ্যুতিক পজিটিভ ও নেগেটিভ বিকিরণে প্রাকৃতিক নিয়মে ব্যালান্স (ভারসাম্য) আনার চেষ্টা হয়। পজিটিভ ও নেগেটিভ মেঘ একত্রিত হয়ে বিদ্যুত সঞ্চালন শুরু হলে বজ্রপাত হতে থাকে। এই বিদ্যুত সঞ্চালনে বাতাসের তাপমাত্রা ২০ থেকে ৩০ হাজার ডিগ্রী সেলসিয়াসে পরিণত হয়। মেঘের অভ্যন্তরের নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাস সম্প্রসারিত হয়ে ভয়াবহ কম্পনে গর্জে ওঠে মেঘ। শব্দের গতিবেগের চেয়ে আলোর গতিবেগ বেশি হওয়ায় আগে আলোর ঝলক দৃষ্টিতে আসে। পরে প্রচ- শব্দ অনুভূত হয়। দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ পূর্ব প্রস্তুতি না থাকা এবং বড় বৃক্ষের অভাব। শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে বজ্রমৃত্যুর হার বেশি। শহরাঞ্চলে ঘরবাড়িগুলো অনেকটা বজ্র নিরোধক। গ্রামাঞ্চলে বজ্র প্রতিরোধ হিসাবে কাজ করে বিশাল বৃক্ষ। এই বড় গাছ এখন খুবই কম। কালে ভদ্রে বিশাল বট পাকুড় আম জাম শিমুল কাঁঠাল চোখে পড়ে। বৃষ্টির সময় বিদ্যুতের ঝলকানি ও মেঘের গর্জনের (গ্রামের কথায় মেঘের ডাক) মধ্যে অনেক সময় গৃহবধূ ওঠানে কাজ করে। কৃষক মাঠে থাকে। খোলা মাঠে ও উঠানে বিদ্যুত আক্রান্ত হয় বেশি। হালে কৃষিকাজে যন্ত্রের ব্যব্যহার বেড়েছে। আকাশে ঝলসানো বিদ্যুত এসব ধাতব বস্তুর সংস্পর্শে দ্রুত চলে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালির্ফোনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিশ্বের গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে বজ্রপাত অন্তত ১৫ শতাংশ এবং ৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস বাড়লে ৫০ শতাংশেরও বেশি হতে পারে। কয়েকটি দেশের হিসাব কষে এই ফল দেয়া হয়েছে। কঙ্গোয় ভূমি থেকে এক হাজার মিটারেরও বেশি উচ্চতায় কিফুকা পর্বতের এক গ্রামে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় বছরে প্রতি বর্গকিমিতে দেড়শ’বার। পরবর্তী অবস্থানে আছে ভেনিজুয়েলা উত্তর ব্রাজিল ও যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা। বিশ্বে প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ৪৫ বার বজ্রপাত হয়। সেই হিসেবে বছরে এই সংখ্যা প্রায় দেড়শ’ কোটি বার। বিশ্বের হিসাব যাই থাক বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার বেড়ে গিয়ে যে মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে তা রোধে কোন ব্যবস্থা নেই। সচেতনতাও গড়ে তোলা হয়নি। ভূমিকম্পের সময় কি করণীয় তার প্রচার হয়। বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন ধারণাও দেয়া হয় না। এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত থেকে যা মেলে তা হলো- আকাশে ঘন কালো মেঘ দেখার সঙ্গেই প্রস্তুতি নেয়া, মেঘের ডাক শুনলেই নিরাপদে যাওয়া। পাকা বাড়ি সাধারণত নিরাপদ। ফসলের মাঠ, ফাঁকা মাঠ, উঠান, সৈকত, পাহাড়, গাছের নিচে বিদ্যুতের খুঁটির নিচে দাঁড়ানো বা নিচে দিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক। বজ্রপাতের সময় ধাতব বস্তু স্পর্শ করা ঠিক নয়। এমনকি টিভি ফ্রিজ পানির মোটর বন্ধ থাকলেও তার স্পর্শ থেকে সাবধানে থাকা ভাল। এ সময় বৈদ্যুতিক ঝরনায় গোসল করা ঠিক নয়। পাকা বাড়ি হলেও তার ধাতব জানালায় হাত রাখা বিপদ হতে পারে। বিদ্যুতের সুইচ অফ রাখা বাঞ্ছনীয়। তারযুক্ত ফোন এবং মোবাইল ফোন ব্যবহারও ঠিক নয়। কারণ মোবাইল ফোনের টাওয়ার বজ্রপাত টেনে নেয়। বর্তমানে ভূমিকম্পের প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ ভূমিকম্প থেকে রক্ষা পেতে সচেতন হয়ে উঠেছে কিন্তু বজ্রপাতের বিষয়ে তেমন উদ্যোগ নেই।
×