ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উপকূলের নতুন এলাকা প্লাবিত পানিবন্দী হাজার হাজার মানুষ

পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি, দুর্ভোগ কমেনি বন্যার্তদের

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৩ আগস্ট ২০১৫

পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি, দুর্ভোগ কমেনি বন্যার্তদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও কমেনি বন্যার্তদের দুর্ভোগ। বহু গ্রাম এখনও পানিতে তলিয়ে রয়েছে। রবিবারও অনেক বাঁধ ভেঙ্গে ও জোয়ারের পানিতে উপকূলীয় অঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কয়েকদিন ধরে হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী। পানিতে নিমজ্জিত কয়েক হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন আবাদ নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছে কৃষককুল। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের প্রায় ৫১টি গ্রাম, কলাপাড়ার ২৫টি এবং ভোলার ৫০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে দুর্ভোগে পড়েছে বরগুনার ২৫ হাজার পরিবার। রবিবারও পানি উন্নয়ন বোর্ডের পর্যবেক্ষণাধীন সারাদেশের ৮৫টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে ৫০টির পানি বৃদ্ধি পায়। ভারতের কয়েকটি রাজ্যে বন্যা দেখা দিয়েছে। উজানের পানি প্রবেশের পাশাপাশি বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বন্যা দূর হতে সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। রবিবারও রাজধানীসহ দেশের অনেক স্থানে মাঝারি থেকে ভারি বর্ষণ হয়েছে। আগামী দু’দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা হ্রাস পাবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, গঙ্গা-পদ্মা নদীসমূহের পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় গঙ্গা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে এবং পদ্মা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবন জেলার কতিপয় অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকতে পারে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৯৬ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল হ্রাস পাচ্ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। স্টাফ রিপোর্টার বাগেরহাট থেকে জানান, অতিবর্ষণ ও নদ-নদীতে জোয়ারে পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাগেরহাটের বিভিন্ন স্থানে বেড়িবাঁধ উপচে ও ভেঙ্গে নিম্নাঞ্চলের কমপক্ষে ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে নদী তীরবর্তী হাট-বাজার, মিল-কল-কারখানা, মাছের ঘের, পুকুর, ফসলী জমিসহ কয়েকটি গ্রামের সহস্রাধিক ঘরবাড়ি। চিত্রা নদীর জোয়ারের পানি বৃদ্ধি ও দু’পাশের বেড়িবাঁধ ভেঙে ফকিরহাট ও চিতলমারীর ১০টি গ্রাম পানিতে তলিয়ে মাছের ঘের ও ফসলী জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে মানবেতর অবস্থায় রয়েছে গ্রামবাসী। স্টাফ রিপোর্টার সাতক্ষীরা থেকে জানান, সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার চাকলায় কপোতাক্ষ নদের ২শ’ ফুট বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে একটি গ্রাম ও ২শ’ বিঘা মৎস্য ঘের প্লাবিত হয়েছে। শনিবার রাতে উপজেলার প্রতাপনগর ইউনিয়নের চাকলা গ্রামে এ বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যায়। স্থানীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এলাকাবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বেড়িবাঁধটি সংস্কারের চেষ্টা চালালেও বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে রবিবার দুপুরে বাঁধটি ফের ভেঙ্গে গেছে। বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের পানিতে চাকলা গ্রামসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বাঁধভাঙ্গা পানিতে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় আড়াই শ’ পরিবার। বাঁধটি দ্রুত স্থায়ীভাবে সংস্কার করা না হলে প্রতাপনগর ইউনিয়নের শূভাদ্রাকাটি, তালতলা, রুয়েরবিলসহ নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। এদিকে, উপজেলার কপোতাক্ষ তীরের আরও তিনটি পয়েন্টে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা কলাপাড়া থেকে জানান, অস্বাভাবিক জোয়ারে প্লাবিত হয়েছে কলাপাড়ার ২৫টি গ্রাম। কোথাও কোমর, কোথাও বুক সমান পানি। রবিবার থেকে অস্বাভাবিক প্লাবনে অন্তত পাঁচ হাজার কৃষক পরিবার চরম বিপাকে পড়েছে। চাল-চুলা থেকে সব পানিতে ডুবে গেছে। ২৪ ঘণ্টায় এভাবে দুই দফা প্লাবনের শিকার লোকজন এখন দু’চোখে সব অন্ধকার দেখছে। বাড়িঘর থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট, আবাদি জমি, স্কুল, মাদ্রাসা-মসজিদ সব জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকছে। নিজস্ব সংবাদদাতা আমতলী (বরগুনা) থেকে জানান, ঘূণিঝড় ও পূর্ণিমার প্রভাবে পায়রা নদীতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে রবিবার পানি বৃদ্ধি পেয়ে আমতলী ও তালতলী উপজেলার চর ও নিম্নাঞ্চলের ৫০টি গ্রাম ফের প্লাবিত হয়েছে। এ গ্রামগুলোর ২৫ হাজার পরিবার সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। নিজস্ব সংবাদদাতা নওগাঁ থেকে জানান, দ্বিতীয় দফায় অবিরাম বৃষ্টিপাতের কারণে নওগাঁর নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। জেলার নিয়ামতপুর, মান্দা ও রানীনগরে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় চলতি মৌসুমে রোপা আমন চাষ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা ভোলা থেকে জানান, টানা কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণ আর পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি পেয়ে ভোলা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বেড়িবাঁধের বাইরের ঘরবাড়িসহ বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চলগুলো তলিয়ে গেছে। মনপুরা ফিশারিজের বাঁধ ভেঙ্গে জোয়ারের পানি ভেতরে প্রবেশ করায় মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কমপক্ষে অর্ধশতাধিক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। নিজস্ব সংবাদদাতা বান্দরবান থেকে জানান, টানা বর্ষণে সড়ক ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দু’দিন বন্ধ থাকার পর সারাদেশের সঙ্গে বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ ফের চালু হয়েছে। নিজস্ব সংবাদদাতা বাঁশখালী থেকে জানান, চট্টগ্রামের বাঁশখালীর পুকুরিয়া গ্রাম এখনও পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সংগ্রাম করে পানিবন্দী অবস্থায় বসবাস করছে ওই গ্রামের ২০ হাজার লোক। সেখানে দেখা দিয়েছে চরম খাদ্য সঙ্কট ও পানীয়জলের অভাব। নিজস্ব সংবাদদাতা রূপগঞ্জ থেকে জানান, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বগ্রাম-পশ্চিমগাঁও সড়কের বেহালদশা দেখা গেছে। টানা বর্ষণে সড়কের প্রায় ১শ’ মিটার অংশ ধসে পড়েছে। এতে এ সড়ক দিয়ে অন্তত ১০ গ্রামের মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এ সড়কের কোন সংস্কারকাজ হয়নি বলে এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। নিজস্ব সংবাদদাতা চরফ্যাশন থেকে জানান, ঘূর্ণিঝড় ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে ভোলার চরফ্যাশনের মেঘনাপাড়ের নির্মাণাধীন ৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ঢাল ধসে মাটি ভেসে গেছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে যেতে পারে বেড়িবাঁধ। এ কারণে ১৬ গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ প্লাবন আতঙ্কে রয়েছেন। স্টাফ রিপোর্টার কক্সবাজার থেকে জানান, কক্সবাজার উপকূলে ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে ভারি বর্ষণের কারণে সৃষ্ট কক্সবাজারের বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে উপকূলের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে জোয়ার-ভাটা চলছে। বিশেষ করে মাতারবাড়ী ধলঘাটায় অবস্থা চরম আকার ধারণ করেছে। মাতারবাড়ী এলাকায় কোমেনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে সহস্রাধিক বসতবাড়ি। সাগর এখনও উত্তাল রয়েছে। কক্সবাজার অঞ্চলে দেয়া ৩নং স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত এখনও বলবত রয়েছে। জেলার চকরিয়া, পেকুয়া ও রামুর অধিকাংশ এলাকা পানিতে ডুবে জনদুর্ভোগ বেড়েছে। ওই সব এলাকায় জেলা প্রশাসনের ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। রবিবার সকাল থেকে বৃষ্টি না হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। মাতারবাড়ী এলাকায় বেড়িবাঁধ না থাকায় সমস্যার কথা জানালেন মাতারবাড়ী ধলঘাটা নাগরিক কল্যাণ ফোরাম ও কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি এম রইছ উদ্দিন। তিনি বলেন, মাতারবাড়ী ধলঘাটার ছয় হাজার মানুষ বন্যায় গৃহহারা হয়েছে। কক্সবাজারের চকরিয়া, পেকুয়া, রামু ও কুতুবদিয়ায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় চার লাখ মানুষ। জোয়ারে অভ্যন্তরীণ সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় অত্র অঞ্চলের যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড় কোমেনের আঘাতে প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনে সাড়ে ১১শ’ বাড়িঘর, চার হাজার গাছপালা, ৩০ একর আবাদি জমি, ২০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ ২৩টি ট্রলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ সময় এক বৃদ্ধ নিহত ও আহত হয়েছেন ১০ থেকে ২০ জন। নিজস্ব সংবাদদাতা রাঙ্গুনিয়া থেকে জানান, অবিরাম বর্ষণ, পাহাড়ী ঢল ও উজান থেকে ধেয়ে আসা পানির চাপ কমাতে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী পানি বিদ্যুতকেন্দ্রের স্পিলওয়ের ১৬টি গেট খুলে দেয়া হয়েছে। কাপ্তাই বাঁধের পানি ছাড়ার খবরে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া, রাউজানসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে বন্যা আতঙ্ক বিরাজ করছে। কর্ণফুলী পানি বিদ্যুতকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক আবদুর রহমান জানান, কাপ্তাই হ্রদের পানি রুলকার্ড অনুযায়ী স্বাভাবিক নিয়মে ৯০ এমএসএল (মিনস সি লেভেল) থাকার কথা। বর্তমানে পানি বেড়ে তা হয়েছে ১০৫ এমএসএল। বিপদসীমার একেবারে কাছাকাছি। ধারণক্ষমতা ১০৯ ফুট। বিপদসীমার কাছাকাছি উচ্চতায় এলে উজানের পানি কমাতে গেটগুলো খুলে দেয়া হয়। অন্যথায় পানির চাপ সামলানো যাবে না। এ ছাড়াও পানির চাপ কমাতে দিনরাত কেন্দ্রের ৫টি বিদ্যুত উৎপাদন ইউনিট চালু রাখতে হচ্ছে। এতে সর্বোচ্চ ২৩৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে প্রতিদিন। বিদ্যুত উৎপাদনের কারণে পানি বের হয়ে গেলেও উজানের ঢলের পানির চাপ কমানো যাচ্ছে না।
×