ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

৭৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে ॥ বর্ষণের ক্ষতি

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ৪ আগস্ট ২০১৫

৭৬ হাজার হেক্টর ফসলি জমি তলিয়ে গেছে ॥ বর্ষণের ক্ষতি

এমদাদুল হক তুহিন ॥ টানা বর্ষণে সারাদেশের মানুষের মতো দিশেহারা হয়ে পড়েছে কৃষক। একের পর এক তলিয়ে যাচ্ছে ফসলি জমি। ধানী জমি ও বীজতলা নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাকশব্জি, মরিচ ক্ষেত ও পানের বরজও! ফলে সারাদেশের চাষীদের মুখে এখন নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, সারাদেশে আংশিক কিংবা পুরো নিমজ্জিত হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৬১ হেক্টর আউশ ধানের জমি। তলিয়েছে আমনের বীজতলাও। তলিয়ে যাওয়া আমনের বীজতলার পরিমাণ ২৮ হাজার ৮২৫ হেক্টর। রোপা আমন তলিয়ে গেছে ৭ হাজার ৬৩৪ হেক্টর, বোনা আমন ২ হাজার ৫৭০ হেক্টর, শাকসব্জি ১হাজার ৬০৪ হেক্টর, মরিচ ক্ষেত ১ হাজার ২১৬ হেক্টর এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২০০ হেক্টর পানের বরজ। একাধিক কৃষিবীদ, কৃষক ও কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিবর্গের সাথে কথা বলে জানা গছে, চলতি আউশ ও আমন মৌসুমে একদিকে রয়েছে বাম্পার ফলনের হাতছানি। অন্যদিকে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে! তবে বসে নেই কৃষকরা। প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে চাষাবাদ। কৃষকদের প্রত্যাশা মৌসুম শেষে পরিশ্রমের সঠিক মূল্যায়ন পাবেন তারা। তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে ফসলের তেমন কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই। জেলা ভিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতির ওই প্রতিবেদনের মন্তব্য অংশে বলা হয়, রোপা আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। বড় ধরনের কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে ফসলের আর কোন ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। জানা গেছে, একই সঙ্গে আর্থিক ও ফসলের ক্ষয়ক্ষতির কারণে কৃষকের মুখে লেগে থাকা বিষাদের ছায়া এখন পর্যন্ত কেটে ওঠেনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জেলা ভিত্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে আউশ ধানের নিমজ্জিত ফসলি জমির পরিমাণ ৩৭ হাজার ৪৬১ হেক্টর। ২৮ হাজার ৮২৫ হেক্টর পরিমাণ আমনের বীজতলা তলিয়ে গেছে। রোপা আমন ধানের তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ৭ হাজার ৬৩৪ হেক্টর, আর ২ হাজার ৫৭০ হেক্টর বোনা আমন ধানের জমি তলিয়ে গেছে। শুধু ধান নয়, ক্ষতি হয়েছে শাকসব্জিরও। সারাদেশে ১হাজার ৬০৪ হেক্টর শাকসব্জির জমি তলিয়ে গেছে। বন্যা ও ভারি বৃষ্টিপাতে ক্ষতি হয়েছে মরিচ ক্ষেত ও পানের বরজেরও। মরিচ ক্ষেতের তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ১ হাজার ২১৬ হেক্টর, আর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ২০০ হেক্টর পানের বরজ। প্রতিবেদনটির মন্তব্য অংশে বলা হয়েছে, রোপা আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। আর বৃষ্টিপাত না হলে অন্যান্য ফসলের ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। অতি বৃষ্টিপাতে নিমজ্জিত ফসলের ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদনটিতে ১ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির পরিমাণ অন্তর্ভক্ত হয়েছে। জেলাওয়ারী প্রতিবেদনটিতে খাতওয়ারী আবাদী জমির পরিমাণ, নিমজ্জিত ফসলি জমির পরিমাণ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ দেখানো হলেও প্রতিবেদনটির কোথাও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। তবে প্রতিবেদন তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত খামারবাড়ীর এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতিবেদনটির নিমজ্জিত ফসলি জমির পরিমাণের মধ্যেই আংশিক কিংবা পুরো নিমজ্জিত জমির পরিমাণ অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। প্রতিবেদনে মোট ২৭টি জেলার নিমজ্জিত জমির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যশোর জেলায় আউশ, আমনের বীজতলা, শাকসব্জী ও মরিচক্ষেতসহ তলিয়ে যাওয়া জমির পরিমাণ ১০ হাজার ৩০৫ হেক্টর। ঝিনাইদহ জেলায় তলিয়ে গেছে ৯ হাজার ২৪৫ হাজার হেক্টর পরিমাণ ফসলি জমি। মাগুরা জেলায় অন্যান্য ফসলের সঙ্গে তলিয়ে গেছে বোনা আমন ধানের ক্ষেত, নিমজ্জিত ফসলি জমির পরিমাণ ১ হাজার ৮১৭ হেক্টর। কুষ্টিয়ায় তলিয়ে গেছে ৮৫৮ হেক্টর জমি, চুয়াডাঙ্গায় ২ হাজার ৯৫৫ হেক্টর, বরিশালে ২ হাজার ২৫৭ হেক্টর, পিরোজপুরে ২ হাজার ২০৪ হেক্টর, ঝালোকাঠিতে ১ হাজার ৫২৬ হেক্টর, পটুয়াখালিতে ৪ হাজার ৩৫৯ হেক্টর, বরগুনায় ১ হাজার ৫০ হেক্টর এবং খুলনায় ৪৩১ হেক্টর। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম জেলায় নিমজ্জিত জমির পরিমাণ ২৯ হাজার ৪৫৩ হেক্টর। সাতক্ষীরায় ৬৪৫ হেক্টর, নড়াইলে ৭ হাজার ৮৪৫ হেক্টর, মাদারীপুরে ২৫৯ হেক্টর, গোপালগঞ্জে ২৩৭ হেক্টর, রাজবাড়ীতে ১ হাজার ২৫৩ হেক্টর, শরীয়তপুরে ১২২ হেক্টর, কুমিল্লায় ৭২৩ হেক্টর, ফরিদপুরে ২ হাজার ৫০০, নোয়াখালীতে ৭ হাজার ৪৮১ হেক্টর, পাবনায় ১২৭ হেক্টর, চাদপুরে ২৯৫ হেক্টর, ফেনীতে ২ হাজার ৫১৫ হেক্টর, কক্সবাজারে ৩ হাজার ২১৪ হেক্টর এবং সিলেটে ৩৭ হেক্টর পরিমাণ জমি অতি বৃষ্টিপাতে নিমজ্জিত হয়েছে বলে ওই প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে। তবে সব জেলায় একই ফসল নয়, কোথাও কোথাও রয়েছে শুধুমাত্র আউশ বা রোপা আমার, আবার কোথাও পানের বরজ। যশোর : যশোরের প্রতিনিধি সাজেদ রহমান জানান, টানা বর্ষণে যশোরের ৮টি উপজেলার অনেক এলাকার ফসল বিশেষ করে রোপা আমন পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফলে আমন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে। যশোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক নিত্যরঞ্জন বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, টানা বৃষ্টিপাত চলছে কয়েক দিন। অনেক এলাকার রোপা আমান ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তবে পানিতে ধান ক্ষেত তলিয়ে গেলেও পানি নেমে গেলে ধানের তেমন কোন ক্ষতি হবে না। কক্সবাজার : কক্সবাজার প্রতিনিধি এইচ এম এরশাদ জানান, একমাস আগে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে ঝড়ো হাওয়ায় কুতুবদিয়া ও টেকনাফে শাহপরীরদ্বীপের বেড়িবাঁধ ছিড়ে খান খান হয়ে গেছে। পাশাপাশি পূর্ণিমার তিথিতে লোনাজলে বিস্তীর্ণ এলাকার চলতি মৌসুমের আউশ ধানের ব্যাপক ক্ষতিসহ তলিয়ে গেছে বহু বসতঘর। তিনি জানান, জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বীজতলা, ফসলি জমি, চিংড়ি ঘের ও ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। ফলে চলতি মৌসুমের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। বরিশাল : বরিশাল প্রতিনিধি খোকন আহম্মেদ হীরা জানান, প্রবল বর্ষণে চলতির মৌসুমের আমন ও আমনের বীজতলায় কোমর পানি জমে থাকায় এ অঞ্চলের কয়েক লাখ চাষীর মুখে এখন বিষাদের ছায়া। অধিকাংশ জমিতে রোপণ করা চারা ও বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন এলাকার কৃষকেরা। আজিমপুর গ্রামের কৃষক মাহাবুব আলম খোকন জানান, গত পনেরো দিনের প্রবল বর্ষণ ও ঘূর্ণিঝড় কোমেনের প্রভাবে মেঘনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আমনের ক্ষেতে বুক সমান পানি জমে আছে। দীর্ঘদিনেও পানি কমে না আসায় রোপণ করা আমনের চারা ও বীজতলা এখন পচে নষ্ট হয়ে গেছে। বরিশাল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক আব্দুল আজিজ ফরাজী জানান, গতবারের বাম্পার ফলন পেয়ে চলতি মৌসুমে আগে ভাগেই আমন চাষ শুরু করেছিলেন কৃষকেরা। কয়েকদিনের টানা প্রবল বর্ষণে অধিকাংশ এলাকার আমন ক্ষেত ও বীজতলায় কোমর সমান পানি জমে যায়। তবে এই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলে মনে করেন কৃষিবিদরা। শুধু যশোর, কক্সবাজার ও বরিশালে নয়, কৃষি সম্প্রসারণের প্রতিবেদনে উঠে আসা ওই ২৭টি জেলার চিত্র একই। জানা গেছে, ওই জেলাগুলোর কৃষকরা টানা বর্ষণে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়েছে। ইতোমধ্যে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও হয়েছে আর্থিক ক্ষতি। তবে আশার খবর হচ্ছে, সারা দেশে আউশ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১০ লক্ষ ৮০ হাজার হেক্টর। অন্যদিকে আমনের বীজতলাও নির্মাণ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৩৯ হাজার ৫৪ হেক্টর বেশি। ফলশ্রুতিতে টানা বর্ষণের নেতিবাচক প্রভাব অল্প সময়েই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করেন একাধিক কৃষি বিশেষজ্ঞ। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের জৈব কৃষি গবেষক ড. মোঃ নাজিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, অগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যান্ত আমন ধান রোপণ করা সম্ভব। বৃষ্টিপাত হচ্ছে, তবে বন্যা নয়। জলবদ্ধতা দূর হলে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। তিনি বলেন, সব্জি উৎপাদনের ক্ষেত্রে জলদ্ধতা অনেক বড় একটি ফ্যাক্টর। উচুঁ জমিতে সব্জি চাষ করা হলেও ক্ষতি তেমন হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ক্ষতি যদি মারাত্মক আকার ধারণ করে তবে নতুন করে বীজ বপনের বিকল্প নেই। একই সঙ্গে জলাবদ্ধতা দূরে কৃষকদের সজাগ থাকার পরামর্শও দেন তিনি। অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজ বিজ্ঞান অনুষদের ডিন পরেশ চন্দ্র মোদক জনকণ্ঠকে বলেন, টানা বর্ষণে ফসলের যে ক্ষতি হয়েছে তা কোন ক্রমেই পুষিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে চলতি মৌসুমী ফসল ছাড়াও অন্যান্য ফসলের দিকে কৃষককে মনোনিবেশ করতে হবে।
×