ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ভ্যাটে অসন্তোষ বাড়ছে বেসরকারী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৪ আগস্ট ২০১৫

ভ্যাটে অসন্তোষ বাড়ছে বেসরকারী কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ভ্যাট আরোপকে কেন্দ্র করে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে অসন্তোষ ক্রমশই বাড়ছে। আরোপিত ভ্যাটের পরিমাণ ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে সাত শতাংশ করা হলেও প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্যোক্তা ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রশমিত হচ্ছে না। এদিকে ভ্যাট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যে ভ্যাট প্রদানকারী হিসেবে নিবন্ধনের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ভ্যাট পরিশোধ সংক্রান্ত কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট এলাকার সার্কেল কার্যালয়ে জমা দিতেও বলা হয়েছে। তবে এ নির্দেশের ফলে বেতন, ফি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কায় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা অধিকার আন্দোলনের ব্যানারে বৃহত্তর আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সংগঠিত হচ্ছেন অভিভাবকরাও। আজ জরুরী বৈঠকে বসছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। কর আরোপকে অগণতান্ত্রিক ও উচ্চ শিক্ষার অগ্রগতি বিরোধী অভিহিত করে অবিলম্বে কর আরোপের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। দাবি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই সমিতির নেতৃবৃন্দ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতও করেছেন। শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ৮৩টি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় চার লাখ ৬১ হাজার এবং ৬৪টি বেসরকারী মেডিক্যাল কলেজে ২০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। করের কারণে সঙ্কটে পড়বে শিক্ষার্থীরা। এমনিতেই এ নিয়ে আন্দোলন চলছে। এ অবস্থার মধ্যে এনবিআরের নির্দেশে অস্থিরতা আরও বেড়ে গেছে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিশেষত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার বাজেটে ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের পর থেকেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে আন্দোলন। সভা সমাবেশ করে প্রতিদিনই প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তারা। অসন্তোষ সামাল দিতে আরোপিত ভ্যাটের হার কিছুটা কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করার ঘোষণা দেয়া হলেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি। জানা গেছে, এমন অবস্থার মধ্যেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোকে আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যে ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধনের নির্দেশ দিয়েছে এনবিআর। এনবিআরের এ নির্দেশনায় তিনটি বিষয় স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে। প্রথমত, এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ১৫ আগস্টের মধ্যে ভ্যাট প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিবন্ধিত হতে হবে। দ্বিতীয়ত, ওই তারিখের মধ্যেই জুলাই মাসে এসব প্রতিষ্ঠানের দেয়া সেবার বিপরীতে যে ভ্যাট সংগৃহীত হয়েছে তা জমা দিতে হবে। তৃতীয়ত, জুন মাসে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফি হিসেবে যে অর্থ আদায় করেছে তার ওপর ভ্যাট জমা দিতেও বাধ্য এসব প্রতিষ্ঠান। এনবিআর এই সংঘবিধিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণ আদেশ (এসআরও) জারি করেছে। এবারই প্রথমবারের মতো সরকার বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এত দিন ভ্যাটের আওতামুক্ত ছিল। ২০১০ সালে একবার ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও অসন্তোষের কারণে পরে তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছিল। সূত্রগুলো বলছে, ইতোমধ্যেই ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় ভ্যাট দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। আইন অনুসারে, প্রতি মাসে ভ্যাট জমা দেয়ার কাগজপত্র পরবর্তী মাসের ১৫ তারিখে মধ্যে স্থানীয় রাজস্ব কার্যালয়ে জমা দিতে হবে। প্রক্রিয়াটা আয়করের মতোই। তবে আয়কর বাৎসরিক হিসাবে জমা দিতে হয়। এ বিষয়ে এনবিআর কার্যালয় থেকে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নোটিস দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে বৈঠক ডেকেছে বাংলাদেশ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। আজ সমিতির বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্যেক্তা থেকে শুরু করে এ খাতের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল উচ্চবিত্তের সন্তানরাই পড়ছে না, উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য মফস্বল থেকে আসা এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষকের সন্তানরাও ভর্তি হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন-ফি পরিশোধের জন্য অভিভাবকরা জমিজমা বন্ধক এমনকি বিক্রি পর্যন্ত করছে। এ অবস্থায় সাড়ে সাত শতাংশ কর আরোপ করা হলে শিক্ষা ব্যয় বহুগুণ বেড়ে যাবে, যা শিক্ষার্থীদেরই পরিশোধ করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রকে আরও সঙ্কুুচিত করবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ওপর কর বসালে তা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই কোন না কোনভাবে আদায় করা হবে। ফলে শিক্ষার্থীদের পেছনে অভিভাবকদের ব্যয় আরও বেড়ে যাবে। এদিকে কেবল উদ্যোক্তারাই নয় শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরাও ইতোমধ্যে এ খাতে ভ্যাট আরোপের নেতিবাচক ফলের কথা তুলে ধরেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. একে আজাদ চৌধুরী বলছিলেন, বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন সংখ্যা সীমিত। তাই অনেক শিক্ষার্থী বাধ্য হয়ে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। এখানে কেবল ধনীদের সন্তান নয়। বহু গরিবের ছেলে-মেয়েরা পড়ছে। সরকারের উচিত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নে ভূমিকা রাখা। তিনি বলেন, জার্মানিতে উচ্চশিক্ষায় কোন টিউশন ফি নেই। যুক্তরাজ্য বছরে ৩৭ বিলিয়ন ডলার দিচ্ছে বেসরকারী শিক্ষায়। আর যুক্তরাষ্ট্র বছরে এক দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার শিক্ষা ঋণ দিচ্ছে। আমাদের এখানে তো তা হচ্ছে না। উল্টো শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ কমছে। বিশিষ্ট এ শিক্ষাবিদ বলছিলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়ছে তাদের এক প্রকার ফ্রি পড়াচ্ছে সরকার। সেখানে বাজেট দিচ্ছে সরকার। আর কিছুটা কম মেধাবী বা ভর্তি পরীক্ষায় হয়ত একটা খারাপ করার কারণে বেসরকারীতে যারা পড়ছে তাদের ওপর কর বসালে সেটা ভাল দেখায় না। এক দেশে দুইভাবে শিক্ষা হয় না। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রস্তাবিত কর প্রত্যাহারের দাবি উঠেছে জাতীয় সংসদের বাজেট আলোচনায়ও। সংসদের গেল অধিবেশনে বগুড়া-৩ আসনের বিরোধীদলীয় সদস্য নুরুল ইসলাম তালুকদার বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, বাজেটে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে সেটা কোন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দেবে না। এটা দিতে হবে আমার আপনার ছেলে-মেয়েদের যারা ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ছে। এর মানে দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ওপরই এই করের বোঝা গিয়ে পড়বে। তাই আমি অর্থমন্ত্রীর প্রতি দাবি জানাব, বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রস্তাবিত এই কর প্রত্যাহার করা হোক। শিক্ষার্থীরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এমনিতেই বেসরকারী বিশ্ববিদ্যায়ের পড়ালেখার খরচ লাগামহীন। সরকার তো কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সেখানে কর আরোপ করা হলে তার পুরো চাপ গিয়ে পড়বে কেবল শিক্ষার্থী ও তার পরিবারের ওপর। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর আরোপের প্রতিবাদে কয়েকদিনের সভা-সমাবেশের পর এবার সারাদেশে একযোগে বৃহত্তর কর্মসূচীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। ক্লাস বর্জন, আমরণ অনশনের মতো বৃহত কর্মসূচী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনশন কর্মসূচী পালন করা হবে।
×