ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

সাকাচৌর রায় ও আদালত অবমাননা

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ৪ আগস্ট ২০১৫

সাকাচৌর রায় ও আদালত অবমাননা

রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে খালেদা জিয়া এবং তার সঙ্গীরা আদালত নিয়ে প্রচুর আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন। কখনও শুনিনি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত ব্যবস্থা নিয়েছে। গতকালের পর আজ পড়ুন দ্বিতীয় কিস্তি... সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রায়ের ক্ষেত্রেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনের আলোচনায় বিষয়গুলো এসেছে। কারণ, অতীতে সাকাচৌ যা খুশি তা করেছেন, কেউ কোন কথা বলার সাহস রাখেনি। তার অর্থ অজস্র, বিভিন্ন উপায়ে সেগুলো উপার্জিত। বলা যেতে পারে, তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যার কখনও বিচার হতে পারে এটি কেউ ভাবেনি। তিনি নিজেও ভাবেননি। পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, এখনও ভাবছেন না। সরকারী দলের বেশ ক’জন নেতা তার আত্মীয়। আইএসআইয়ের তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি বলে পরিচিত। পাকিস্তানী বাঙালীদের দল বিএনপি-জামায়াত তার পেছনে আছে। তার আত্মীয়রা ব্যবসায়ী, প্রচুর টাকা তাদের, সাকার নিজেরও টাকা প্রচুর। এখন শুধু নয়, আগে বলতেন প্রায়ই যে, তিনি প্রয়াত শেখ কামালের বন্ধু, শেখ হাসিনা তার বোন। এ কারণে প্রকাশ্যে তিনি বলতেন, তিনি রাজাকারের পুত্র। এটা ঠিক রাজাকারের পুত্র ছিলেন বলেই বিএনপি তাকে ওআইসির মহাসচিব পদে মনোনয়ন দিয়েছিল। তাদের ধারণা ছিল, যেহেতু পাকিস্তান ও তার মিত্ররা রাজাকারদের পক্ষে এবং দল হিসেবেও তারা রাজাকারদের প্রতিনিধি সে কারণে জয় সাকাচৌর অবশ্যম্ভাবী। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ঐ সময় ঐ নিয়োগের সমালোচনা করায় সাকা বলেছিলেন, ‘বাবু ওআইসি নিয়ে কথা বলার কে? উনাকে ওআইসি নিয়ে কথা বলতে হলে আমি ছোটবেলায় যে জিনিসটা কেটে ফেলে দিয়েছি আগে ঐ জিনিসটা কেটে ফেলতে হবে।’ তার সোনা চোরাচালান নিয়ে কথা উঠলে সাকা জাতীয় সংসদে বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা কেন আমার সোনা নিয়ে টানাটানি করছেন।’ খালেদা জিয়া সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এতদিন কুকুর লেজ নাড়ে জানতাম, এখন দেখছি লেজ কুকুর নাড়ে।’ বাংলাদেশের এমন কিছু ছিল না যা তার ঠাট্টা তামাশার বিষয়বস্তু হয়নি। শুধু তাই নয়, ছয়বার তিনি ‘নির্বাচিত’ হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরকম অশ্লীল প্রভাবশালী অর্থশালী ও মস্তান ব্যক্তির আগমন আগে হয়নি। সাকাচৌ যা করতেন তা কি রাজনীতি? না, রাজনীতি নয়, মস্তানি। এই মস্তানদের রাজনীতিতে নিয়ে আসেন জেনারেল জিয়া। এসব ব্যক্তিকে রাজনীতিতে পোক্ত করেন জেনারেল এরশাদ। আমার মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে যারা এরশাদকে নির্বাচিত করেন বা সাকাকে, তারা কোন্্ ধরনের মানুষ? এবং যেই রাজনীতিতে এরশাদ-সাকারা রাজনীতি করতে পারেন সেই রাজনীতি কেমন! সাকা রাজনীতিতে কেমন ত্রাসের সৃষ্টি করেছিলেন তার একটি উদাহরণ দিই। তার মৃত্যুদ-ের রায়ের দিনও তার নির্বাচনী এলাকার মানুষজন ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করেছিলেন। যেখানে খুশিতে বিভিন্ন জায়গায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে সেখানে ঐ এলাকায় মানুষজন ছিলেন নিশ্চুপ। সাকাচৌ কতটা শক্তিশালী বা তার মস্তানিতে কতটা প্রভাবিত একটি দল তা বোঝা যাবে তার মৃত্যুদ-ের রায়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়ায়। বিএনপি এর আগে মানবতাবিরোধী রায়ে খুব একটা প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু সাকার রায়ে জানিয়েছে। এই প্রতিক্রিয়াটি আমাদের ভালভাবে পড়া উচিত। এই প্রতিক্রিয়ায় ভালভাবে উন্মোচিত হয়েছে বিএনপির রাজনৈতিক চরিত্র, লক্ষ্য। সে কারণে, অন্তত রেকর্ডের খাতিরে বিএনপি’র আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান রিপনের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, “সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এদেশের একজন জনপ্রিয় ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ। তাকে ছয়বার জাতীয় সংসদে তার নির্বাচনী এলাকার জনগণ প্রতিনিধিত্ব করার জন্য ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি দেশ ও মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করেছেন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তার কণ্ঠ ছিল সুউচ্চ। রিপন বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী যেসব অভিযোগ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা হয়েছে, তিনি তার সংশ্লিষ্টতা সব সময় অস্বীকার করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন তিনি যে দেশে ছিলেন না, এর সপক্ষে উপযুক্ত প্রমাণাদিও আদালতের বিবেচনায় উপস্থাপন করেছিলেন। ওই সময়ে দেশে তার অনুপস্থিতির দাবির সপক্ষে তিনি দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিককেও সাক্ষী মেনেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি। তা সত্ত্বেও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী অভিযুক্ত হওয়ায় আমরা বিস্মিত। রিপন বলেন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীদের মতো আমাদের দলও মনে করে, তিনি ন্যায় বিচার লাভ করেননি। অন্যায়ভাবে তাকে মৃত্যুদ-াদেশ দেয়া হয়েছে। আমরা এ রায়ে সংক্ষুব্ধ ও সত্যিই মর্মাহত। আমাদের দল মনে করে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন। আমাদের দল আরও মনে করে, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিচারে আইনী স্বচ্ছতার অভাব ও নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে।” [জনকণ্ঠ ৩০.৭.১৫] ১. সাকাচৌর রাজনীতিকে মস্তানি বা ক্রিমিনালের রাজনীতি না বলে বলতে হবে, ‘দেশ ও কল্যাণের রাজনীতি’। ২. কোন্্ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে তিনি ছিলেন সোচ্চার? বাংলাদেশের? একটি উদাহরণও দেয়া যাবে না। রিপন বোঝাতে চেয়েছেন, সাকাচৌ পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সোচ্চার, যেটি বিএনপি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। ৩. মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে সাকাচৌ দেশে ছিলেন না এমন একটি মিথ সব সময় তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। আসলে, তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মুক্তিযোদ্ধারা যখন তার ওপর আক্রমণ করেন ও আহত করেন তখন তিনি পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে হত্যা-লুণ্ঠন যা করার তিনি করেছেন এবং সেসব তথ্য প্রমাণ দেয়া হয়েছে। এ্যাটর্নি জেনারেলও দিয়েছেন। সুতরাং বিষয়টি আমলে নেয়া হয়নি এটি অসত্য। ৪. সাকাচৌ রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। অর্থাৎ সরকার আদালতের মাধ্যমে রায় দিয়েছে। অর্থাৎ আদালত রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে, আইনকে নয়। এটি আদালত অবমাননা। শুধু তাই নয়, এটি ভবিষ্যতে জুডিসিয়াল মার্ডার হিসেবেও বিবেচিত হতে পারে বলে মনে করে বিএনপি। বাংলাদেশের কোন আদালতে এমন কোন উদাহরণ নেই। তারা প্রত্যাশা করছেন, রিভিউতে সাকাচৌ মুক্তি পাবেন। সাকাচৌও তা বিশ্বাস করেন। রিপনের বক্তব্যের কোন প্রতিক্রিয়া আদালত দেখায়নি। (৩) সাকাচৌ কেন সব কিছু প্রভাবিত করতে পারেনÑ এ ধারণা কেন গড়ে উঠছিল তার পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করলাম। স্বাভাবিক কারণেই আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। এবং এ নিয়ে নানা গুজব পল্লবিত হয়েছিল, আদালত ঘিরেও। এর কোন কারণ ছিল না এমন বলা যাবে না। আমাদের জোর-জবরদস্তি করলে আমরা সেগুলো বলতে বাধ্য হব। কিন্তু আমরা চাই না সেগুলো আলোচিত হোক। আমরা সুষ্ঠু বিচার চাই দেখেই আদালতে গেছি। আদালতের ভাবমূর্তি বিপন্ন করতে চাইনি। আদালত একটি প্রতিষ্ঠান এ কথা আমরা মনে রাখি। আশা করি আদালতের সঙ্গে যারা যুক্ত আইনজীবী ও বিচারক তারাও সেটি মনে রাখবেন। যেদিন রায় হয় সেদিন আমি দেশের বাইরে। ২৯ তারিখ সকাল ৯ টায়ই সহকর্মী চৌধুরী শহীদ কাদেরকে বললাম ইন্টারনেট দেখতে। মুহূর্তে জানা গেল সাকাচৌর দ-াদেশ বহাল আছে। এ রায় জানার পর আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে নাস্তা করতে বসলাম। পরদিন ঢাকা এসে শুনি এবং কাগজে দেখি দৈনিক জনকণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক স্বদেশ রায় ও সম্পাদক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ খবর শুধু আমাকে নয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মহলকে ক্ষুব্ধ ও বিব্রত করেছে। শত ডামাডোলেও দৈনিক জনকণ্ঠ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সোচ্চার, অন্য কাগজ নয়, সেটিকেই অভিযুক্ত করা হলো। কেন? কেন বিচারকরা মনে করেছেন এই দুই সম্পাদক আদালত অবমাননা করেছেন? তবে এর মানে এ নয় যে, সেই কাগজ আদালত অবমাননা করবে। আমরা মামলা নিয়ে আলোচনা করব না, কিন্তু আদালত যে অভিযোগ করেছে তাতে কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে যা নিয়ে অবশ্যই এ্যাকাডেমিক আলোচনা করা যেতে পারে, অবশ্যই আইনের এবং মানুষের স্বার্থে। আদালত বলে, নিবন্ধে বলা হয়েছে, “প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আদালতের গঠনমূলক সমালোচনা করা যাবে। তাই তার কাছে বিনীত প্রশ্ন, ১৪৩ জনকে পুড়িয়ে মারার অন্যতম হুকুমের আসামি কিভাবে চিকিৎসার জন্য জামিন পায়। জমির আইল নিয়ে লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে হাজার হাজার দরিদ্র আসামি যেখানে বছরের পর বছর জেলে আটকা, সেখানে রাজনীতির নামে প্রকাশ্যে এই ১৪৩ জনকে খুন করার পরেও সে জামিন পাবে! এই কি বিচারের ন্যায়দ-! বিচারকরা নিশ্চয়ই জানেন, কেন তারা পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে এভাবে নৃশংস হত্যাকা- চালাচ্ছে। বাস্তবে এটা আইএসের পদ্ধতি। আইএস সবখানে এভাবে ভয়াবহ নৃশংসতা সৃষ্টি করে দেশের মানুষকে পাজলড করে দিতে চায়, যাতে কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে না আসে। ফখরুলের জামিনের ভেতর দিয়ে বিচারকরা কি বাংলাদেশকে আইএসের পথে অগ্রসর হওয়ার সুবিধা করে দিলেন না? এসব ঘটে কি ফখরুলের টাকা আছে বলে আর যারা জমির আইল নিয়ে মাথা ফাটায় ওদের টাকা নেই বলে? এখানেই শেষ নয়। ’৭১-এর অন্যতম নৃশংস খুনী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী। নিষ্পাপ বাঙালীর রক্তে যে গাদ্দারগুলো সব থেকে বেশি হোলি খেলেছিল এই সাকা তাদের একজন। এই যুদ্ধাপরাধীর আপীল বিভাগের রায় ২৯ জুলাই। পিতা মুজিব তোমার কন্যাকে এখানেও ত্রুুশে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তাই যদি না হয়, তা হলে কিভাবে যারা বিচার করেছেন সেই বিচারকদের একজনের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে সালাউদ্দিন কাদেরের পরিবারের লোকেরা। তারা কোন্্ পথে বিচারকের কাছে ঢোকে। আইএসআই ও উলফার পথে, না অন্য পথে। ভিকটিমের পরিবারের লোকদের কি কখনও কোন বিচারপতি সাক্ষাত দেন। বিচারকের এথিকসে পড়ে। কেন শেখ হাসিনার সরকারকে কোন কোন বিচারপতির এ মুহূর্তের বিশেষ সফর ঠেকাতে ব্যস্ত হতে হয়। সে সফরের উদ্যোক্তা জামায়াত-বিএনপির অর্গানাইজেশন। কেন বিতর্কিত ব্যবসায়ী আগে গিয়ে সেখানে অবস্থান নেন। কি ঘটেছে সেখানে। ক্যামেরনই পরোক্ষভাবে বলছেন সকল সন্ত্রাসীর একটি অভয়ারণ্য হয়েছে লন্ডনে। এ মন্তব্যগুলো শুধুমাত্র আদালতের বিশ্বস্ততা ও নিরপেক্ষতার জন্য হানিকর নয়, বরং উচ্চ আদালতের বিচারকদেরও হেয় করে এবং তাতে করে আদালতের কর্তৃত্বকেও খর্ব করে। সে অনুযায়ী আদালত ২০১৫ সালের ১৬ জুলাইয়ের দৈনিক জনকণ্ঠে ‘সাকার পরিবারের তৎপরতা ॥ পালাবার পথ কমে গেছে’ শিরোনামের নিবন্ধের লেখক স্বদেশ রায় এবং দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদক, মুদ্রাকর ও প্রকাশক মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদকে (এম এ খান মাসুদ) ৩ আগস্ট ২০১৫ তারিখে সকাল ৯টায় আদালতে সশরীরে হাজির হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কেন আইনী ব্যবস্থা নেয়া এবং আদালত অবমাননার জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না তা ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দিচ্ছে।’ [জনকণ্ঠ ৩০.৭.১৫] আদালত মনে করছেন, দুটি ক্ষেত্রে অবমাননা হয়েছে। একটি মির্জা ফখরুলের ক্ষেত্রে মন্তব্য করায়, অন্যটি সাকাচৌকে নিয়ে মন্তব্য করায়। স্বদেশ রায় আমাদের অনুজ, বন্ধু। তিন দশক সাংবাদিকতা করছেন। কোথায় কী লিখতে হবে সে ক্ষেত্রে আমাদের থেকে তিনি বেশি সচেতন। আমরা যারা কলাম লিখি তাদের অনেকেই কোন না কোন সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সুতরাং আদালত সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট সতর্ক থাকি। আমাদের চেয়ে আইনজীবীরা গত তিন দশকে আদালতে এমন অনেক কিছু করেছেন যা অবমাননামূলক কিন্তু যার বিরুদ্ধে কোন বেঞ্চ কখনও কোন মন্তব্য করেনি। স্বদেশ রায় এ বক্তব্যে খুব স্পষ্ট করে তার প্রশ্ন করেছেন, আমরা যারা সাকাচৌ নিয়ে লিখেছি তারা প্রশ্নটি অস্পষ্ট রেখেছি। স্বদেশ রায় জনকণ্ঠে লেখার আগে সাউথ এশিয়ান মনিটরে একই বিষয়ে লিখেছেন। হ্যাঁ, আদালত মনে করতে পারেন, স্বদেশের লেখায় আদালত অবমাননা হয়েছে, যদি তাঁর বক্তব্যে সত্য না থাকে। তবে আদালতের কর্তৃত্ব খর্ব হয়নি। একজন লেখক আদালতের কর্তৃত্ব খর্ব করতে পারেন না, রাজনীতিবিদরা সমষ্টিগতভাবে পারেন সংসদের মাধ্যমে। এখানে একটি প্রশ্ন মনে হলো, রাজনীতিবিদরা বিশেষ করে খালেদা জিয়া এবং তার সঙ্গীরা আদালত নিয়ে প্রচুর আপত্তিকর কথাবার্তা বলেছেন। কখনও শুনিনি, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত ব্যবস্থা নিয়েছে। ১. খালেদা বলেছেন- ‘বিচারপতি খায়রুল হক বিচার বিভাগকে ধ্বংস করেছেন। তিনি টাকার বিনিময়ে রায় দিয়েছেন। খায়রুল হক যেন মনে না করেন সারাজীবন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে।’ [জনকণ্ঠ ৩.১.২০১১] ২. বিচারপতিদের উদ্দেশে বেগম জিয়া, ‘আওয়ামী লীগের কথা মতো চললে সেটা ঠিক হবে না। আপনারা জনগণের পক্ষে থাকুন। ভুলে যাবেন না আপনারাও মানুষ। একদিন মরতে হবে। আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবেন। [ঐ ১৯.১২.২০১৪] ৩. খালেদা আরো বলেছেন, একদেশে দুই আইন চলছে। বিচার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। বিচারপতিরা আজ চেহারা দেখে বিচার করছেন। আওয়ামী লীগ হলে তারা গুম-খুন-হত্যা যা-ই করুক না কেন, তাদের সব কিছু মাফ। আওয়ামী লীগের জন্য একরকম আইন ও বিএনপির জন্য অন্যরকম আইন। [দিনকাল, ১৯.১২.২০১৪] ৪. খালেদা আরো বলেছেন, বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে ঠিকই কিন্তু বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়নি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এখনো খর্ব হচ্ছে। বরং এখন আরো বেশি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করতেই সরকার বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা পার্লামেন্টের কাছে হস্তান্তর করেছে। ...সরকারি দলের হলে একরকম বিচার হয় আর বিরোধী দলের বা সাধারণ মানুষ হলে অন্য রকম বিচার হয়। [নয়া দিগন্ত, ০৫.০৭.২০১৫] ৫. খালেদা বলেছেন, আজ বিচার হয় দুই রকমের। সরকারী দলের হলে একরকম, আর বিরোধী দল হলে ভিন্ন রকম বিচার হচ্ছে। তারা জামিন পায় না, দিনের পর দিন কারাগারে থাকতে হচ্ছে। বিরোধী নেতাকর্মীরা সুবিচার পায় না। [দিনকাল, ২১.০৭.২০১৫] আরও আছে। সংক্ষিপ্ত সময় দেখে আরও উদাহরণ দেয়া গেল না। এ ধরনের বক্তব্য শুধু খালেদা নন, অনেক রাজনীতিবিদই দিয়েছেন। প্রথমে আসা যাক মির্জা ফখরুলের বিষয়ে। আমি তো মনে করি, পাকিস্তানী বাঙালীদের রাজনীতি করতে দেয়াই উচিত নয় গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থে। অবশ্য রুলিং পার্টি তা মনে করে না। এ বিষয়ে রুলিং ও অপজিশন পার্টি সব এক। যাক সে অন্য প্রসঙ্গ। প্রসঙ্গ হলো- ১. খালেদা-ফখরুল যে গৃহযুদ্ধের অবতারণা করেছিলেন সেখানে ১৪৩ জন নিহত হয়েছিল কিনা? উত্তর, হয়েছিল। এ সংখ্যা মনে হয় খানিকটা কম। অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল কতজন? এরকম বীভৎস অবস্থা আগে কখনও হয়েছিল কিনা? নিরাপত্তারক্ষী মারা গিয়েছিল ক’জন? সুতরাং বিষয়টি অসত্য নয় এবং ঐতিহাসিক সত্য। ২. এইভাবে তারা প্ররোচনা দিয়েছিলেন কিনা? গোলাম আযমকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির দায়ে। ফখরুলের দায় সেরকম কিনা! ৩. পাকিস্তানী-বাঙালীদের দল বিএনপি-জামায়াত জঙ্গী মৌলবাদকে সমর্থন করে কিনা? আগে এ প্রশ্নের সমাধান হতে হবে। কে কি মনে করলেন তাতে মাথা না ঘামিয়ে বলা যেতে পারে, এটি ঐতিহাসিক সত্য। জামায়াতকে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রিমিনাল অর্গানাইজেশন বলা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ে একই কথা বলা হয়েছে। অভিযুক্ত সবাই বিএনপি-জামায়াত নেতা। আমরা এ দেশে জঙ্গী মৌলবাদ চাই না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আদালতও চান না। তা হলে এদের ক্ষেত্রে কেন নমনীয়তা প্রদর্শিত হবে? পত্রিকায় পড়েছি, অনেক জঙ্গীকে জামিন দেয়া হয়েছে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী যতদূর মনে পড়ে, আদালতে এভাবে জঙ্গীদের জামিন দেয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। এবং বলেছিলেন এটি ঠিক নয়। এ নমনীয়তা জঙ্গীদের সহায়তা করে কিনা? এটি কি আগে উল্লিখিত সেই ডিফেন্স মেকানিজম? একটি উদাহরণ দিই। আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার প্রথম আমলে চারজন বিএনপি নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের পক্ষে রিট করলে, বিচারপতি তাদের শুধু মুক্ত নন, সরকারকে এক লাখ টাকা করে প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দিতে বলেন। আমি ও শাহরিয়ার যখন রিট করি বা আমাদের মুক্তির জন্য যখন রিট করা হয় তখন আমাদের মুক্তি দেয়া হয়, কিন্তু ক্ষতিপূরণ দেয়া হয়নি। বিচারক তাঁর রায়ে তা বলেননি। এর অর্থ, একই বিষয়ে ভিন্ন রায় হতে পারে। তা হলে রায়ে কি একজন সুবিধা পাবে আরেকজন পাবে না? আলাদা ক্ষতিপূরণ মামলার রায়ের সময় বিএনপি আমলে নিযুক্ত বিচারক বিব্রতবোধ করায় সে মামলা আর চলেনি। এসব কারণেই এ ধরনের প্রশ্ন ওঠে? (চলবে)
×