ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিক্ষোভ, অবরোধ অভিযুক্তরা গ্রেফতার

বর্বরতা ॥ এবার খুলনায় প্রাণ গেল শিশু রাকিবের

প্রকাশিত: ০৫:৪৭, ৫ আগস্ট ২০১৫

বর্বরতা ॥ এবার খুলনায় প্রাণ গেল শিশু রাকিবের

স্টাফ রিপোর্টার, খুলনা অফিস ॥ সিলেটে পৈশাচিক নির্যাতনে শিশু সামিউল আলম রাজনের অকাল মৃত্যুর পর এবার খুলনায় বর্বরতার বলি হয়েছে মোটরসাইকেল গ্যারেজের কর্মচারী শ্রমিক রাকিবুল ইসলাম রাকিব। এক কর্মস্থল ছেড়ে অন্য স্থানে যোগ দেয়ায় তাকে নির্মমভাবে প্রাণ হারাতে হলো। মোটরসাইকেলে হাওয়া দেয়া পাইপের মুখ তার মলদ্বারে ঢুকিয়ে পেটে হাওযা দেয়ায় তার মৃত্যু হয়। সোমবার রাতে সে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এলাকাবাসী এ ঘটনাকে পরিকল্পিত হত্যাকা- দাবি করে দোষীদের শাস্তির দাবিতে মঙ্গলবার সকালে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করে। নিহত শিশু রাকিবের বাবা নুরুল আলম হাওলাদার বাদী হয়ে তিন জনকে আসামি করে খুলনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামিদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেল তিনটার দিকে রাকিবের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। শিশুটির পরিবার ও এলাকাবাসী জানায়, নগরীর সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা দিনমজুর আলম হাওলাদারের শিশু পুত্র রাকিব (১৩) টুটপাড়া কবরস্থানের নিকটবর্তী শরীফ মেটাল সাইকেল গ্যারেজে কাজ করত। কিছুদিন আগে সে ওই গ্যারেজ ছেড়ে দিয়ে পিটিআই মোড় এলাকার একটি গ্যারেজে কাজ নেয়। এতে আগের গ্যারেজ মালিক ক্ষুব্ধ হয়। সোমবার সন্ধ্যায় শিশুটি পূর্বের গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে ডেকে নেয় সাবেক মালিক শরীফ। এর পর তাকে মারধরের এক পর্যায়ে শরীফ ও তার সহযোগী মিন্টু মিয়া মোটরসাইকেলের টায়ারে হাওয়া দেয়া মেশিনের পাইপের মাথা শিশুটির মলদ্বারে ঢুকিয়ে দেয়। পেটে বাতাস ঢুকে শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে শিশুটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। বিপদ আঁচ করে নির্যাতনকারীরা শিশুটিকে প্রথমে স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ও পরে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। রাত ১২টার পরে সেখানে তার মৃত্যু হয়। হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শিশু রাকিবের শরীরের অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে যায়, ফুসফুস ফেটে যাওয়াসহ শরীরের বিভিন্ন অর্গান অকেজো হয়ে যাওয়ায় সে মারা যায়। জানা গেছে, পৈশাচিক এ ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হয়ে শিশুটিকে নির্যাতনকারী শরীফ তার সহযোগী মিন্টুকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করে। এসময় শরীফের মা বিউটি বেগমও হামলার শিকার হন। তিনি ঘটনাটি দেখে বাধা না দেয়ায় তাকেও পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। নির্যাতনকারী শরীফ ও মিন্টুকে আহত অবস্থায় খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এদিকে শিশু রাকিব হত্যার প্রতিবাদে ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে নারী, পুরুষ, শিশুসহ এলাকাবাসী মঙ্গলবার সকালে নগরীতে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তারা খানজাহান আলী রোড় ও সেন্ট্রাল রোডে অবস্থান নিয়ে পথরোধ করে। পুলিশ জানায়, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ (কেএমপি) কমিশনার নিবাস চন্দ্র মাঝিসহ পুলিশের অন্য কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। কেএমপি কমিশনার নিহত রাকিবের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশ্বাস দিয়েছেন। খুলনা সদন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকুমার বিশ্বাস জানান, মঙ্গলবার সকালে শিশু রাকিবের বাবা নুরুল আলম হাওলাদার বাদী হয়ে তিন জনকে আসামি করে খুলনা থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। আসামিরা হচ্ছে শরীফ, মিন্টু ও বিউটি বেগম। আসামিরা পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। তাদের আদালতে উপস্থিত করে পরবর্তী আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে। নিহত রাকিবের স্বজনরা জানায়, রাকিবের বাবা সাতক্ষীরার দরিদ্র দিনমজুর নূর আলম হাওলাদার বছর তিনেক আগে সপরিবারে খুলনায় আসেন। বাসা ভাড়া নেন নগরীর সেন্ট্রাল রোডের একটি বস্তিতে। সংসারে অভাবের কারণে বছর দেড়েক আগে পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে রাকিবকে টুুটপাড়া কবরস্থানের পাশের মোটরগ্যারেজে কাজে পাঠান। কারণে অকারণে গ্যারেজ মালিক ও তার লোকজন রাকিবকে গালাগাল ও মারধর করত। এ কারণে কিছুদিন আগে রাকিব ওই গ্যারেজ ছেড়ে আর একটি গ্যারেজে কাজ নেয়। এতে শরীফ ক্ষুব্ধ হয়। নিহত রাকিবের বাবা আলম হাওলাদার ও খালা পারুল বেগম বলেন, নির্যাতনের খবর পেয়ে তারা রাকিবকে খুঁজতে গ্যারেজে যান। ওখানে গিয়ে শুনতে পান তাকে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এরপর হাসপাতালে গিয়ে তারা জানতে পারেন রাকিবের শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ বাতাস প্রবশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুঁড়ি ছিঁড়ে গেছে, ফুসফুসও ফেটে গেছে। পরে রাকিব মারা যায়। দুই ছেলে মেয়ের মধ্যে একমাত্র ছেলেটিকে হারিয়ে বাবা-মা এখন পাগলপ্রায়। মা লাকি বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার অবোধ বাচ্চাটা ওদের কি ক্ষতি করেছে? কেন ওরা আমার ছেলেকে মারল? কাঁদতে কাঁদতে তিনি মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। প্রতিবেশীরাও রাকিবের এই অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছেন। এলাকাবাসী অবিলম্বে রাকিবের হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি জানিয়েছেন। জনউদ্যোগ ও বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা, খুলনা এ ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে শিশু রাকিব হত্যার বিচারের দাবি জানান।
×