ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য

প্রশ্ন ফাঁসে সরকারী চাকরিজীবীদের একাংশও জড়িত

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ৬ আগস্ট ২০১৫

প্রশ্ন ফাঁসে সরকারী চাকরিজীবীদের একাংশও জড়িত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ অন্তত ছয়টি মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে একের পর এক পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে কোচিং সেন্টার, বেসরকারী কিছু লোকের পাশাপাশি প্রশ্ন প্রণয়ন, ছাপানো ও বিতরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ জড়িত। প্রশ্ন প্রণয়ন ও বিতরণের সঙ্গে যে সকল সরকারী লোকজন জড়িত তাদের একাংশ কোন না কোন পর্যায়ে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গেও জড়িত। এই প্রশ্নপত্র ফাঁসে ২০ টাকা থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। ‘পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস : প্রক্রিয়া, কারণ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। টিআইবি সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গাইড বইয়ের আদলে প্রকাশিত সহায়ক গ্রন্থাবলী বন্ধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে। শিক্ষামন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে টিআইবির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতায় প্রশ্ন ফাঁস চক্রের বিরুদ্ধে গত এক সপ্তাহ ধরে চলা গ্রেফতার অভিযানের মধ্যেই ধানম-ির মাইডাস সেন্টারে বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে টিআইবি। প্রশ্ন ফাঁসের নানা অভিযোগ তুলে টিআইবি ফাঁস রোধে সাত দফা সুপারিশও দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি তার প্রতিবেদনে বলেছে, গত চার বছরে বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় মোট ৬৩টি প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে। দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রশ্ন তৈরি, ছাপানো ও বিতরণের তিনটি পর্যায়ে প্রায় ১৯টি ধাপে ফাঁসের ঝুঁকি বিদ্যমান। প্রশ্ন প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণের প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট সরকারী কর্মকর্তাদের একাংশের সম্পৃক্ততা, প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়ে উচ্চ পর্যায় থেকে অস্বীকারের প্রবণতা, জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া এবং অভিযোগের বিষয়ে যথাযথ প্রশাসনিক পদক্ষেপের ঘাটতির কারণে সঙ্কটের সমাধান হচ্ছে না। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট আইন পুনরায় কঠোরতর করে কার্যকর করা জরুরী। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি বলে শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন সময় দেয়া বক্তব্যের সমালোচনা করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, উট পাখির মতো এড়িয়ে যাওয়া সমাধান নয়। সাংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটির নানাদিক নিয়ে কথা বলেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপ-নির্বাহী পরিচালক ড. সুমাইয়া খায়ের, রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। গবেষণা প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছেন টিআইবির রিসার্চ এ্যান্ড পলিসি বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার নিহার রঞ্জন রায়, নীনা শামসুন নাহার ও রুমানা শারমিন। টিআইবির তার গবেষণায় বলছে, প্রশ্ন ফাঁস প্রতিরোধে গৃহীত সরকারী পদক্ষেপসমূহের মধ্যে রয়েছে ২০১৪ সালে পিএসসি ও ২০১৫ সালের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার, থানায় অভিযোগ ও মামলা দায়ের, পরীক্ষা কেন্দ্র স্থগিত, ২০১৪ সালে এইচএসসি পরীক্ষার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষা স্থগিত করাসহ নজরদারি বৃদ্ধি করা। এ ছাড়া প্রশ্ন ফাঁস রোধে বিজি প্রেসে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে প্রশ্ন শাখায় মেটাল ডিটেক্টর, পেপার ডিটেক্টর, ভল্ট ডোর, নতুন গোপন ক্যামেরা, সিসিটিভি বসানো হয়েছে ও মুদ্রিত প্রশ্ন সিলগালা করতে স্ট্রংরুম তৈরি করা ইত্যাদি। তবে এ সকল পদক্ষেপ সত্ত্বেও নীতি-নির্ধারণী পর্যায় থেকে অস্বীকারের প্রবণতা, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাব, তদন্ত কমিটির ফলাফল জনসম্মুখে প্রকাশ না করা এবং প্রশ্ন প্রণয়নে দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ, ম্যানুয়েল প্রক্রিয়া ও সরকারী সকল অংশীজনের সংশ্লিষ্টতার কারণে প্রশ্ন ফাঁস অব্যাহত রয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, প্রশ্ন প্রণয়ন, ছাপানো ও বিতরণ প্রক্রিয়ায় ফাঁসের সম্ভাব্য বিভিন্ন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেÑ একই শিক্ষকের প্রতি বছরই প্রশ্ন প্রণেতা ও মডারেশনকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়া, প্রশ্ন প্রণয়নকারী ও মডারেশনকারীর একাংশ প্রশ্নপত্র প্রণয়নকে পুঁজি করে নিজ নিজ স্কুল ও কোচিং সেন্টারে অর্থের বিনিময়ে সাজেশন বিতরণ, ম্যানুয়ালি গণনা ও প্যাকেট করা। কম্পোজ ও সংরক্ষণের সময়, প্রশ্ন এন্ট্রি করার সময় ভুলত্রুটি পরিমার্জনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মডারেটর মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান যে তার প্রশ্নগুলো নির্বাচিত, কম্পোজের পর প্রুফ দেখার সময় ও ছাপানোর কাজে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের এককভাবে বা দলগতভাবে প্রশ্ন মুখস্ত করা এবং বোর্ডেও একাংশের মাধ্যমে প্রশ্নফাঁস করার অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ছাড়া নির্ধারিত সময়ের পূর্বে প্যাকেট খুলে শিক্ষকের একাংশের মাধ্যমে প্রশ্নের ছবি তুলে মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ফেসবুক, ভাইবারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠানো এবং নির্ধারিত সময়ের ভারপ্রাপ্তদের মাধ্যমে প্যাকেট খুলে প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষার পূর্বেই উত্তর তৈরি করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। গবেষণায় প্রশ্ন ফাঁস ও ফাঁসকৃত প্রশ্ন ছড়ানোর এবং বাজারজাতকরণে সম্ভাব্য অংশীজনের মধ্যে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে টিআইবি। প্রশ্ন ফাঁসের প্রক্রিয়ায় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের একাংশের সঙ্গে সরকারী নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ তুলেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ ছাড়া বিভিন্ন কোচিং সেন্টার, গাইড বই ব্যবসায়ী, ফটোকপিয়ার, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন এবং মোবাইল, ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রশ্ন ফাঁস হয়ে থাকে। প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পূর্বে, প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পর এবং পরীক্ষায় প্রশ্ন মিলে যাওয়ার পর এককভাবে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ও দলগতভাবে ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা লেনদেনের হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। প্রশ্ন ফাঁস রোধে টিআইবির সাত দফা সুপারিশ করেছে। সুপারিশের মধ্যে আছে ‘পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) (সংশোধন) আইন, ১৯৯২’ এর ৪নং ধারা পুনরায় সংশোধন করে শাস্তির মাত্রা চার বছরের পরিবর্তে আগের মতো ১০ বছর নির্ধারণ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থার প্রয়োগ, কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধকরণে সরকারের ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালার অস্পষ্টতা দূর করা, কোচিং বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংশ্লিষ্টদের বিভিন্ন প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি এবং সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে গাইড বইয়ের আদলে প্রকাশিত সহায়ক গ্রন্থাবলী বন্ধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা। টিআইবির অভিযোগ ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া ॥ সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সরকারী ও বেসরকারী এই দু’ধরণের ভাগিদার রয়েছে। তবে সরকারী পর্যায়ের ভাগিদারদের যোগসাজস ছাড়া কোনমতেই প্রশ্ন ফাঁস করা সম্ভব নয়। বেসরকারী পর্যায়ে এ সিন্ডিকেটের সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকেও বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তিনি বলেন, সংসদে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। কিন্তু উট পাখির মতো এড়িয়ে যাওয়া সমাধান নয়। তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনটি নিয়ে আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়েছি। এর আগেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বা বিভাগে আমরা আমাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। তারা মতামত দিয়েছেন। কিন্তু এবার সেটি হয়নি। টিআইবির প্রতিবেদনে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবহেলা, অফরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়াকে দায়ী করা হলেও শিক্ষামন্ত্রী নুরু ইসলাম নাহিদ বলেছেন, প্রশ্নফাঁসকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মন্ত্রী তার বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে টিআইবিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘টিআইবি গণমাধ্যমের খবর দেখুক।’ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, তাদের (টিআইবির কর্মকর্তা) গতকাল-আজকের মিডিয়া-পত্রিকা দেখতে বলবেন, এদেরকে ধরা হয় কি না, কি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে? আগে পড়ুক, তারপর মনিটরিং করতে বলবেন। চলতি বছরের কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় সম্প্রতি বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই নজিরকে সামনে টেনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যারা প্রশ্ন ফাঁস করে তারা গ্রেফতার হয়ে সাত দিন ধরে মিডিয়ার সামনে, আপনারাইতো রিপোর্ট দিচ্ছেন। আগে রিপোর্ট পড়ুক তারপর তারা কথা বলুক। সর্বশেষ এসএসসি-এইচএসসিতে প্রশ্ন ফাঁস হয়নি দাবি করে শিক্ষাসচিব নজরুল ইসলাম খান বলেন, কিছু লোক ভুয়া প্রশ্ন বানিয়ে টাকা পয়সা আয় করেছে। অবশ্য বিষয়টি মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়নি। আমরা ২০Ñ২৫ জনকে ধরেছি, তবে মিডিয়াকে বলিনি, প্রকাশ করিনি। কারিগরিতে প্রশ্ন ফাঁসের খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে। আইটি দিয়ে খুঁজে বের করা হয়েছে, ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ফাঁস স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে প্রশ্ন ছাপার পদ্ধতি পরিবর্তন করে এক্সাম ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম করার কাজে হাত দেয়া হচ্ছে বলেও জানান শিক্ষাসচিব।
×