ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জাতির আবেগ

প্রকাশিত: ০৪:২১, ৭ আগস্ট ২০১৫

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জাতির আবেগ

একাত্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি পাকিস্তানের সামরিক সরকার। এক যুগের সামরিক শাসনের সময় দেশ থেকে সভ্যতা-ভব্যতা বিদায় নিয়েছিল। এর অংশ হিসেবে সামরিক বাহিনীর শতকরা ৯০ জনের বাসস্থান পশ্চিম পাকিস্তানকে তারা মূল দেশ আর পূর্ব পাকিস্তানকে প্রায় উপনিবেশে পরিণত করে ফেলে। রাজনৈতিক ধারা না থাকায় তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ক্ষোভ বুঝতে অক্ষম হয়। বাঙালীর প্রাণের দাবি ছয় দফাকে তারা বিচ্ছিন্নতাবাদের সেøাগান আখ্যা দেয়। অস্ত্রের জোরে তারা পূর্ব পাকিস্তানীদের দমনের চেষ্টা করে। সঙ্গে যোগ দেয় বাংলায় কথা বলা কিন্তু মানসিকভাবে কিছু অবাঙালী। এরপরের ইতিহাস বড়ই নির্মম। সেকথা আমরা ভুলতে পারি না। কি করে ভুলব? আমরা স্বজনদের হারিয়েছি। হারিয়েছি বন্ধুদের। হারিয়েছি শিক্ষকদের। হারিয়েছি লাখ লাখ দেশবাসীকে। ধর্ষণ, অগ্নিকা- আর ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল খানসেনারা আর তাদের দোসররা। নরঘাতক হানাদাররা বিতাড়িত হলে স্বভাবতই শোকসন্তপ্ত জাতি পাকিসেনাদের দোসরদের বিচার দাবি করে। প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশের মানুষকে বাঁচাবার গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত হয় সরকারের ওপর। নানা রকমের সমস্যার সৃষ্টি করতে থাকে দেশদ্রোহীরা। শুধু দেশদ্রোহীরাই নয়, একদল রোমান্টিক পথভ্রষ্ট হয়ে জাতির অনিষ্টসাধনে ব্রতী হয়। তবু দেশদ্রোহীদের বিচারের চেষ্টা করে সরকার। অবশেষে ৭৫-এ চরম আঘাত হানে দেশদ্রোহীরা। ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। ব্যাক গিয়ারেই ইতিহাস চলল ’৯৬ সাল পর্যন্ত। নানা কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রস্তুতি নেয়া গেল না ২০০১-এর নির্বাচনের আগে। জনৈক বিচারপতির কারসাজিতে নির্বাচনে বিপর্যয় ঘটল স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির। ২০০৮-এর নির্বাচনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের শপথ নেয় স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি। নির্বাচনী ইশতিহারে স্থান পায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সেই শপথ। এখানে লুকোচুরির কোন ব্যাপার নেই। নির্বাচনে বিজয়ী হলে স্বাধীনতার পক্ষের সরকার বিচারের ব্যবস্থা করে যুদ্ধাপরাধীদের। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সমস্ত জাতি। আর কি প্রতিক্রিয়া দেখা গেল স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির? তারা প্রথমে বলল ‘আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, কিন্তু...।’ বিশ্ববিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ এরিক বার্ন তাঁর বই ‘গেমস পিপল প্লে-তে ইয়েস বাট’ মনস্তত্ত্ব ব্যাখ্যা করেছেন। এই মনস্তত্ত্ব বিকারগ্রস্ত। তারা বিচার চায় বলেছে; কিন্তু বিচারের কোন ব্যবস্থা কোনদিন করেনি। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে কোনদিন এগিয়ে আসেনি। বরং তারা উল্টোটা সব সময় করেছে। বিএনপির তিন মহারথীর বাণী উদ্ধৃত করেছেন কলামিস্ট একে মোহাম্মদ আলী শিকদার। গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা সেগুলো এখানে উল্লেখ করছি। ২০১১ সালের অক্টোবরে বেগম জিয়া নবাবগঞ্জে বলেন, ‘মুজাহিদ, নিজামী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এরা কেউ অপরাধী নয়। এদের মুক্তি দিতে হবে।’ ২০১১ সালের ৩ ডিসেম্বর মওদুদ সাহেব এক সাংবাদিক সম্মেলনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে ট্রাইব্যুনাল ভেঙ্গে দিতে বলেন। এ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, আগামীতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই বিচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বিচার করা হবে। বিএনপির দুই আইনজ্ঞ কি বলেছেন সে কথা যদি ছেড়েই দেই স্বয়ং ‘ম্যাডাম’ যা বলেছেন তাতে কি মনে হয় বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়! তবে এটা ঠিক যে, তারা বিচার চাওয়ার ভান করেছিল। কাজেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, তারা জেনে-শুনে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল। এরিক বার্নের ‘গেমস পিপল প্লে’ বইটির কথা আবার মনে পড়ে। অন্যান্য দিক দেখবার চেষ্টা করা যাক, এক জামায়াত নেতা লাখ লাখ ডলার খরচ করেছে ‘লবিং’ করবার জন্য। কোথা থেকে এলো এত ডলার এত অল্প সময়ে? একজনের প্রত্যাশিত ফাঁসির আদেশের বদলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে তিনি বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তোলেন। শাহবাগ চত্বরের জনতার ঢল এই ক্ষুব্ধতার আকার সম্বন্ধে একটা ধারণা দেয়। আর এক আসামির অনুসারীরা তার ছবি চাঁদে দেখা গেছে বলে সরল মানুষদের ক্ষেপিয়ে পাওয়ার হাউসে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে ব্যাপক নরহত্যা ছিল একাত্তরের ঘাতকদের বাঁচানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা। দেশে-বিদেশে ধরনা দিয়ে বেড়িয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করার জন্য। ইদানীং সৌদি সরকারের ভূমিকার কথাও শুনেছি আমরা। ডালিম বা নূরদের রক্ষা করছে কারা? এসব ঘটনায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পর্কে মানুষের মনে একরকমের সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কেউ কি তবে সমস্ত বিচার প্রক্রিয়াটিকে বানচাল করে দেবে? স্বভাবতই মানুষের মনে এ প্রশ্ন জাগে। বিচারে সাঈদী ফাঁসির দড়ি থেকে বেঁচেছিল কি করে? গোলাম আযম কি কারাবাস করেছিলেন, না আয়েসে বাস করেছিলেন? এইসব কারণে মানুষের মনে একটা তীব্র আবেগের সৃষ্টি হয়। একরকমের ক্রোধের জন্ম হয়। শাহবাগ চত্বরের কথা আমরা আগেই বলেছি। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নিরলস প্রচেষ্টা মানুষের মনে এক ধরনের চেতনার জন্ম দিয়েছে। বাংলার স্বজনহারা মানুষের এই যে আবেগ, এই যে সন্দেহ আর এই যে ক্রোধ সেটা বিস্ফোরিত হয়েছিল শাহবাগে। ইমরান এই আবেগের কণ্ঠস্বর। স্বদেশ রায়ের লেখনীর মাধ্যমে গণমানুষের আবেগ ভাষা পেয়েছে। ইমরানের কণ্ঠের এই ভাষা আর স্বদেশের লেখনীর ভাষা আসলে আবেগমন্থিত দেশবাসীর ভাষা। ইমরান আর স্বদেশ এখন আর ব্যক্তি মাত্র নন, ওরা জাতির মুখপাত্র। আমার একটুখানি পরিচয় এখানে না দিয়ে পারছি না। আমি পেশায় চিকিৎসক। আইন আমার পেশা নয়। অন্যান্য দেশের মতো ইংল্যান্ডেও গুরুতর মানসিক রোগীদের তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাসপাতালে ভর্তি করা যায়। একে বলা হয় ‘আন্ডার সেকশন ভর্তি করা।’ বিশেষভাবে অনুমোদিত মনোচিকিৎসকরাই শুধু এভাবে রোগীদের ভর্তি করতে পারেন। এইসব অনুমোদিত চিকিৎসককে ‘সেকশন টুয়েলভ এ্যাপ্রুভড’ চিকিৎসক বলা হয়। একজন চিকিৎসক অনুমোদিত হলে একটি বিশেষ কমিটি তাঁদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর তাঁদের নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এইসব চিকিৎসকের প্রশিক্ষণদাতা হিসেবে আমি বেশ কয়েক বছর কাজ করেছি। রোগী সন্তুষ্ট না হলে সেকশনের বিরুদ্ধে আপীল করতে পারে। সেক্ষেত্রে ‘মেন্টাল হেলথ কমিশন’ একজন বিশেষভাবে নিয়োজিত মনোচিকিৎসককে দায়িত্ব দেন সমস্ত ব্যাপারটি পরীক্ষা করার জন্য। এইসব ডাক্তারকে বলা হয় ‘সেকেন্ড ওপিনিয়ন এ্যাপ্রুভড ডক্টর।’ আমি বেশ কয়েক বছর সেকেন্ড ওপিনিয়ন এ্যাপ্রুভড ডাক্তারের দায়িত্ব পালন করেছি। সেকশন টুয়েলভ এ্যাপ্রুভড ডাক্তারদের শিক্ষক ও সেকেন্ড ওপিনিয়ন এ্যাপ্রুফড ডাক্তার হিসেবে কাজ করার জন্য আমাকে প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছিল, যার একটি অংশ হিসেবে আমাকে কিছুটা আইন শিখতে হয়। কাজেই বলা যেতে পারে যে, আমি আইন বিশেষজ্ঞ নই; কিন্তু আইন সম্বন্ধে অজ্ঞও নই। আমার একটা চিন্তা ‘কমন ল’ সম্বন্ধে। আইন প্রণয়ন করেন সংসদ সদস্যরা। যাঁদের অনেকেই আইনজ্ঞ নন। আইন যখন আদালতে বিচারক বিশ্লেষণ করেন তখন সেটি আইন হয়ে যায়। সাঈদী আর গোলাম আযমের মামলা তাই আমাকে চিন্তিত করে। আমাদের একটি সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশ। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো এখনও ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সমালোচিত তারা হতেই পারে। কিন্তু তাদের উন্নতি সাধনে যারা অবদান রাখবেন তারাই সত্যিকারের প্রশংসারপাত্র। বর্তমান প্রধান বিচারক একটি একাডেমিক সভায় বলেছেন যে, যেখানে হাজার হাজার মামলা পড়ে আছে সেখানে বিচারকদের ছুটির পরিমাণ অত্যন্ত বেশি। আমি তাঁর এই বক্তব্যকে প্রশংসা করে একটি দৈনিকে লিখেছিলাম। বিচারকদের ছুটির পরিমাণ কমিয়ে আদালতের কাজের গতি বাড়ানোতে তিনি যেন সফল হন এই কামনা করেছি। প্রধান বিচারক যখন ‘গঠনমূলক সমালোচনা’ আহ্বান করেছিলেন তখন খুব উৎসাহিত হয়েছিলাম। গঠনমূলক সমালোচনার সংজ্ঞা সম্বন্ধে আমাদের সাবধান হতে হবে। গঠনমূলক সমালোচনা মানে এই নয় যে, সমালোচনা আমার পক্ষে হতে হবে। বিচারকদের ছুটির বিষয়ে প্রধান বিচারকের সমালোচনা বিচারকদের পক্ষে যায়নি। কিন্তু তাঁর এই সমালোচনা গঠনমূলক একটা বিশাল আর মহৎ কাজের দিকনির্দেশনা। সেজন্যই তাঁর এই সমালোচনা গঠনমূলক সমালোচনা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে আদালতে এবং আদালতের বাইরে কিছু ঘটনা ঘটেছিল তা মানুষকে আবেগপ্রবণ করে তুলেছিল। সেটা অস্বাভাবিক কিছু নয় এটা আমাদের বিজ্ঞ বিচারকরা বুঝবেন। সাকা চৌধুরীর আত্মীয়রা বিচারকের সঙ্গে দেখা করেছে এটা মানুষকে সন্দিহান করে তুলবে এটা আমাদের বিজ্ঞ বিচারকরা বুঝবেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে স্বদেশ রায় জনগণের আবেগ তুলে ধরেছেন। এটা যে তাঁর দায়িত্ব এই সত্য মাননীয় বিচারকরা বুঝবেন। ইমরান তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন কাদের মোল্লার বিচারের রায়ের পর থেকে সেটা বিচারকরা বুঝবেন। সাকা চৌধুরীর ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে বিচারকরা মানুষের সন্দেহ দূর করেছেন। আসল বিচারের কাজ সুস্থভাবে শেষ হয়েছে। আদালত অবমাননার মামলা একটা বিরাট ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে না বলে আশা করি। আদালত অবমাননা কারো কাম্য নয়। কিন্তু আমরা দেখেছি অনেক রায়ের পরে আইনজীবীরা মিছিল করে এসে রায়ের সমালোচনা করেছে সংবাদ মাধ্যমে। তখন আদালত অবমাননার কোন অভিযোগ আনা হয়নি। কোন কোন দলীয় প্রধান আদালতের বিরুদ্ধে চরম অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়নি। দুঃখজনক অভিজ্ঞতার জন্য মানুষের মনে যে আবেগের সৃষ্টি হয়েছিল সেটা তুলে ধরার জন্য কেউ নিগৃহীত হলে মানুষের মনে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হবে। আইন শিখবার সময় বিলেতের বিখ্যাত আইনজ্ঞদের কাছে শুনেছিলাম যে, আইন হচ্ছে ‘গাইড লাইন’। লেখক : রয়্যাল কলেজ অব সাইকিয়াট্রিস্টের একজন ফেলো
×