ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজধানীর ফুসফুস হাতিরঝিল এখন ময়লার ভাগাড়!

প্রকাশিত: ০৬:১৫, ৭ আগস্ট ২০১৫

রাজধানীর ফুসফুস হাতিরঝিল এখন ময়লার ভাগাড়!

শাহীন রহমান ॥ পরিচ্ছন্ন পরিবেশে ঢাকাবাসীকে নির্মল আনন্দ দিতে তৈরি হাতিরঝিল এখন ময়লার ভাগাড়। দুর্গন্ধে টেকা দায়। রমনার পর হাতিরঝিলকেই বলা হতো রাজধানীর ফুসফুস। সেই প্রকল্পটি দিন দিন বুড়িগঙ্গার ভাগ্যই বরণ করেছে। এখন দুর্গন্ধযুক্ত পানির ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে হাতিঝিল। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোন ভ্রƒক্ষেপ নেই। ফলে নির্মল আনন্দ পেতে যারা ক্ষণিকের জন্য হাতিরঝিলে ছুটে আসেন তারা হাতিরঝিলকে অভিহিত করছেন আরেক বুড়িগঙ্গা হিসেবে। হাতিরঝিলের পানিতে এখন অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্যের কোটায়। দিন দিন বর্জ্যমিশ্রিত ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে স্বপ্নের এই হাতিরঝিল। অথচ জনগণের জন্য হাতিরঝিল উন্মুক্ত করার সময় সবার নজর কেড়েছিল প্রকল্পটি। এর নির্মাণশৈলী আর অপরূপ সৌন্দর্য নগরবাসীকে হাতছানি দিয়েই ডেকেছিল। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে এক চিলতে সবুজের সমারোহে যেন সবাইকে স্বস্তির নিঃশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ না করায় তার ছেদ পড়তে শুরু করেছে। পচা দুর্গন্ধময় পানির কাছে গিয়ে এখন আর কেউ নির্মল আনন্দ উপভোগ করছে পারছেন না। হাতিরঝিলের পাড়ে বসলে বুড়িগঙ্গার পানির মতো নাকে এসে লাগছে ঝাঁজালো গন্ধ। আনন্দ ভ্রমণে আসা লোকজনের জন্য এখন হাতিরঝিল অস্বস্তিকর বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। সরেজমিন হাতিরঝিলে দেখা গেছে, সোনারগাঁও হোটেলের পেছন থেকে শুরু হয়ে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত পানির রং মিশমিশে কালো। মানুষ নাকে রুমাল চেপে নান্দনিক এই লেক অতিক্রম করছেন। ঝিলের আশপাশে নাক চেপেই হাঁটতে হচ্ছে। বেড়াতে আসা লোকজন এখন বিরক্তি ও হতাশা প্রকাশ করছেন। তারা বলছেন, বর্জ্যমিশ্রিত ঝিলের পানির দুর্গন্ধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এখানে ক্ষণিকের জন্য নির্মল আনন্দ নিতে আসাটাই দায় হয়ে পড়েছে। দিন দিন হাতিরঝিলে বেড়াতে আসা লোকজনের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। দেখা যায়, ওয়াসার পয়ঃবর্জ্য নিয়মিত পড়ছে এর পানিতে। বৃষ্টির সঙ্গে বিভিন্ন ময়লা-আবর্জনা ও পলিথিন গড়িয়ে পড়ছে ঝিলের পানিতে। ময়লা-আবর্জনাসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর খালি প্যাকেট, পলিথিন ফেলার জন্য ডাস্টবিন হিসেবে যেসব প্লাস্টিকের ড্রাম রাখা হয়েছিল তার বেশিরভাগ এখন নেই। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং বাসাবাড়ির বর্জ্যরে সরাসরি সংযোগ থাকায় হাতিরঝিলের পরিবেশ ক্রমেই দূষিত হচ্ছে। স্যানিটেশনের ময়লা-আবর্জনা এখানে প্রবেশ করায় এখানকার পানি নোংরা হচ্ছে। বাড়ছে দুর্গন্ধ। ভাসমান মলমূত্র ও গৃহস্থালির বর্জ্য হাতিরঝিলের পরিবেশ দূষণ করছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাতিরঝিলে ওয়াসার বর্জ্য আসার পাশাপাশি তেজগাঁও থেকে ধেয়ে আসছে শিল্পবর্জ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাতিরঝিলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শোধনাগার করার কথা থাকলেও এখনও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শুধুমাত্র সোনারগাঁও হোটেলের পেছন দিয়ে ইলেক্ট্রনিক ছাঁকনি দিয়ে পানির সঙ্গে আসা ভারি বস্তু অপসারণের ব্যবস্থা নেয়া হলেও পানি পরিশোধনের কোন ব্যবস্থা নেই। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচলক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বাধায় এখানকার পানির মান পরীক্ষা করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু হাতিঝিলের পানি গুলশান শূটিং ক্লাবের পাশ দিয়ে বের হয়ে গুলশান লেকেও যাচ্ছে। শূটিং ক্লাবের পানির মান পরীক্ষা করে দেখা গেছে, সেখানে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ মাত্র ০.৪ অথবা ০.৫। তিনি বলেন, হাতিরঝিলের পানির মান কিছুতে এর বেশি হবে না। অথচ পানিতে এ পরিমাণ অক্সিজেন থাকলে তাকে আর পানি হিসেবে গণ্য করা যায় না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি মিলিলিটারে ৮-এর নিচে থাকলে সে পানি ব্যবহার ও খাওয়ার অনুপযোগী। এর মাত্রা ৪-এর নিচে থাকলে কোন কাজেই এ পানি ব্যবহার করা যায় না। আবার অক্সিজেনের পরিমাণ ৩-এর নিচে থাকলে সে পানিতে কোন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। আবার এর নিচে অক্সিজেন থাকলে তাকে আর পানি বলা যায় না। তাদের মতে, মানুষের আনন্দ দেয়ার জন্য হাতিরঝিল তৈরি করা হলেও সেখানে এখন কোন পানি নেই। যা আছে তা বর্জ্যমিশ্রিত পানি। কোনভাবেই হাতিরঝিল ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে আনন্দ দিতে পারে না। প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, হাতিরঝিল দূষণমুক্ত করতে হলে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। সরেজমিন দেখা গেছে, হাতিঝিলের পানি বনশ্রীর পাশ দিয়ে বেগুনবাড়ি ও নড়াই খাল দিয়ে আশপাশের লোকালয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ওই এলাকায় আগের মতো দূষণ বাড়ছে। বর্ষাকালে বর্জ্যরে সঙ্গে পানিপ্রবাহ মিশে আরও দূষিত করছে। অথচ সংশ্লিষ্টদের মতে, হাতিরঝিল যান্ত্রিক শহরের বুকে ছিল এক চিলতে সবুজের হাতছানি রাজধানীর ফুসফুস। দু’পাশে গাঢ় সবুজ চাদর বিছিয়ে দেয় দুর্বাঘাসের পাতা। মাঝখানে সিরামিকের হাঁটার পথ। এর পাশ দিয়ে নির্মল পরিবেশে হাঁটতে কার না ভাল লাগে। হাতিরঝিল থেকে এখন হিমেল হাওয়া ভেসে এলেও তাতে রয়েছে প্রচুর দুর্গন্ধ, যে কারণে লেকের পাশ দিয়ে হাঁটাও দায় হয়ে পড়ছে। অথচ সন্ধ্যায় দূর থেকে হাতিঝিলের সৌন্দর্য সবার নজর কাড়ে। গোধূলি বেলায় এ সৌন্দর্য আরও উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। রাতের মিটিমিটি আলোর লুকোচুরিতে অপরূপার বেশে ধরা দেয়। কিন্তু দুর্গন্ধময় পানির কারণে এটি তার সৌন্দর্য হারাচ্ছে দিন দিন। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি থেকে সবার জন্য উন্মুক্ত হয় স্বপ্নের এই হাতিরঝিল প্রকল্প। ঝিলের চারদিকে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, ওভারপাসসহ ঝিলের দু’পাশে পূর্ব-পশ্চিমে সড়ক নির্মাণ করা, লেকের এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য দৃষ্টিনন্দন সেতু, নজরকাড়া বাহারি ফোয়ারা ও চমৎকার শ্বেতশুভ্র সিঁড়ি নির্মাণ করা হয়। সারাবছর ঝিলের পানি স্বচ্ছ রাখার ব্যবস্থা থাকার কথা থাকলেও তা এখনও অধরা রয়ে গেছে। এর স্বচ্ছ পানিতে পালতোলা নৌকায় নৌবিহারের স্বপ্ন এখন ফিকে হয়ে আসছে।
×