ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওমানে পাচার দুই যুবক নিখোঁজ

মানিকগঞ্জে পাচারকারী চক্রের হোতা সালমা

প্রকাশিত: ০৪:২৮, ৮ আগস্ট ২০১৫

মানিকগঞ্জে পাচারকারী চক্রের হোতা সালমা

নিজস্ব সংবাদদাতা, মানিকগঞ্জ, ৭ আগস্ট ॥ মানবপাচারকারী সালমা বেগমের খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অনেক নিরীহ মানুষ। নারীরা হচ্ছে পাশবিক নির্যাতনের শিকার। ছেলের সন্ধান ও দেশে ফিরিয়ে আনতে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন নিখোঁজ আশরাফুলের বাবা এসএম সোহেল। মানবপাচারকারী দলের খপ্পরে পড়ে বেশি বেতনের কথা শুনে ধারদেনা করে চার লাখ টাকা খরচ করে বাবা এসএম সোহেল ছেলে আশরাফুল হককে ওমান পাঠান। কিন্তু ভাল বেতনের পরিবর্তে বিদেশে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয় সে। এরপর থেকে নিখোঁজ হয় আশরাফুল। তার বাড়ি মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বরঙ্গখোলা গ্রামে। মানবপাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে নিখোঁজ আছে রৌহাদহ গ্রামের আকেল মিয়ার ছেলে জাকির মিয়া। ওই চক্রের মাধ্যমে ওমানে গিয়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার ঘিওর উপলোর করচাবাধা গ্রামের গৃহবধূ রাশিদা বেগম (ছদ্মনাম) ও নির্যাতনের শিকার হরিরামপুর উপজেলার সোনাকান্দর গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে মঈনুল ইসলাম সম্প্রতি দেশে ফিরেছে জানিয়েছেন বিদেশের কাহিনী। ঘিওরের রামদিয়া গ্রামের ওমান প্রবাসী হাসানের স্ত্রী সালমা বেগমের বাবার বাড়ি আর সোহেলের বাড়ি একই গ্রামে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে ভাল বেতনে আশরাফুলকে ওমানের হোটেলে চাকরি দেয়ার আশ্বাস দেন সালমা। তার কথামতো গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর ধারদেনা করে চার লাখ টাকা দিয়ে সালমার মাধ্যমে ছেলেকে ওমান পাঠান সোহেল। সোহেল জানান, ওমান যাওয়ার পর থেকে তার ছেলের কোনো খোঁজখবর পাননি। প্রায় ছয় মাস পর মোবাইল ফোনে ছেলে জানায়, ‘আব্বু আমাকে বাঁচাও, আমি অনেক কষ্টে আছি। আমাকে কোনো কাজ না দিয়ে এক ঘরে আটকে রেখেছে। কাজের কথা বল্লে মারধর করে। এই শেষ কথা। এরপর থেকে ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি। মানবপাচারকারী দলের সদস্য হাসান ওমানে থাকায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। হাসানের স্ত্রী সালমা বেগমও গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে আছে। আরেক পাচারের শিকার জাকির মিয়া, স্বামীর খোঁজ না পেয়ে দুই সন্তানকে নিয়ে উৎকণ্ঠা আর হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন মুক্তা আক্তার। তিনি জানান, প্রায় সাত মাস আগে চার লাখ টাকা নিয়ে সালমা বেগম তার স্বামী জাকিরকে ওমান পাঠায়। বিভিন্ন এনজিও এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে এই টাকা ঋণ নিয়েছিলেন মুক্তা। মুক্তা আক্তার জানান, ওমান যাওয়ার পর থেকে স্বামীর কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। শুনেছি সেখানে নিয়ে পাচারকারী সালমার স্বামী হাসান আমার স্বামীকে কোনো কাজকর্ম না দিয়ে ঘরের ভেতর আটকে রেখেছে, মারধর করে। সালমার মাধ্যমে ওমানে পাশবিক নির্যাতনের শিকার রাশিদা বেগম ও মঈনুল ইসলাম সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। রাশিদা জানান, স্বামীর অভাবের সংসারে সচ্ছলতার কথা ভেবে সালমার প্রলোভনে ৭০ হাজার টাকা খরচ করে গত বছরের জুলাই মাসে ওমান যান তিনি। বিমানবন্দরে যাওয়ার পর সালমার স্বামী হাসান তাকে গাড়িতে করে এক বাড়িতে নিয়ে যায়। তিন দিন থাকার পর চাকরির কথা বলে ওই বাড়ি থেকে এক হোটেলে নিয়ে আটকে রাখা হয়। এরপর সেখানে তাকে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হয়। সেই হোটেল থেকে প্রায় আট মাস পর তিনি পালিয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে আশ্রয় চান। পরে গ্রামের বাড়ি থেকে তার স্বামী বিমান ভাড়ার জন্য ৩০ হাজার টাকা পাঠালে পুলিশ তাকে দেশে পাঠিয়ে দেন। মঈনুল ইসলাম জানান ওমানে থাকাবস্থায় নির্যাতনের ঘটনা। তিনি জানান, চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে সালমা তাকে ওমান পাঠায়। ওমান বিমানবন্দর থেকে হাসান তাকে এক বাড়িতে নিয়ে যায়। এরপর সেখানে তাকে আটক করে রাখে। ওই কক্ষে একসঙ্গে আশরাফুল ও জাকিরকেও আটকে রাখা হয়। দিনে একবার খাবার দিত। কাজের কথা বললেই তাদের অমানবিক নির্যাতন করা হতো। মাসখানেক থাকার পর আশরাফুল ও জাকিরকে ওই বাড়ি থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর থেকে তাদের সঙ্গে আর দেখা হয়নি। তাদের সঙ্গে ওই বাড়িতে বাংলাদেশী আরও ১৫-২০ যুবক ছিল। সুযোগ বুঝে ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন মঈনুল। যোগাযোগের পর দেশের বাড়ি থেকে ২০ হাজার টাকা পাঠালে পুলিশের মাধ্যমে দেশে ফেরেন তিনি। ভুক্তভোগীরা জানান, ওমানে হাসান মানবপাচারের ব্যবসা করে। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে স্ত্রী সালমা ও মানবপাচার চক্রের সদস্যদের মাধ্যমে ওমানে মানবপাচার করা হয়। নারীদের ওমানে নিয়ে বিভিন্ন হোটেলে পতিতাবৃত্তির কাজে ব্যবহার করে হাসান। নিখোঁজদের আত্মীয়স্বজন ও নির্যাতনের শিকার সকলেই সহযোগিতা চেয়েছেন প্রসাশনের কাছে।
×