ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাধ্যতামূলক অবসর প্রথা বাতিল হচ্ছে

দক্ষ প্রশাসনের লক্ষ্যে সরকারী কর্মচারী আইন হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০৯, ৮ আগস্ট ২০১৫

দক্ষ প্রশাসনের লক্ষ্যে সরকারী কর্মচারী আইন হচ্ছে

তপন বিশ্বাস ॥ কর্মকর্তাদের আইনী সুরক্ষা নিশ্চিত করা, নতুনদের কাছে সিভিল সার্ভিস আকর্ষণীয় করে তোলা, জনসাধারণের আপত্তিগুলো নিষ্পত্তির ব্যবস্থা রেখে দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সরকারী কর্মচারী আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। আইনের খসড়া বিগত ১৩ জুলাই মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সরকারী কর্মচারীদের গ্রেফতার করা যাবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আইনের খসড়াটি মন্ত্রিসভায় অনুমোদনের পর তা ভেটিংয়ের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। ভেটিং শেষে খুব শীঘ্রই এটি আবার মন্ত্রিসভায় উত্থাপন করা হবে। মন্ত্রিসভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের পর আগামী সংসদ অধিবেশনে এটি অনুমোদনের জন্য উত্থাপন করা হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে। আইনের খসড়ার ওপর ২০১১ সালের ১ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত দেশের ছয়টি বিভাগীয় শহরে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এতে অংশ নেয় সুশীল সমাজসহ প্রশাসনের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা। এ সময় তাদের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে তা যাচাই-বাছাই করা হয়। ২০০৭ সালে ইউএনডিপির সহায়তায় সিভিল সার্ভিস এ্যাক্টের খসড়া তৈরি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তিন বছর ধরে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হয়। আইনটিতে ২৩টি ধারা সন্নিবেশিত করা হয়। এ নিয়ে বেশকিছু বৈঠক করার পর রহস্যজনক কারণে শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তার নির্দেশে তা স্থগিত হয়ে যায়। এর পর মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট করার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। এর প্রেক্ষিতে নতুন করে খসড়া তৈরি করে যাচাই-বাছাই শেষে তা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন সাপেক্ষে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে জনমত যাচাই করা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন বিভাগে কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এরপর বিষয়টি প্রাথমিক চূড়ান্ত করা হলেও এতে বাদ সাধে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে যে কোন পদে নিয়োগের বিধানটি। শেষ পর্যন্ত ইউএনডিপিও এতে আপত্তি জানায়। যে কারণে মহাজোট সরকারের শেষ সময়ে এসে শেষ পর্যায়ে থাকা আইনটি চূড়ান্ত করতে পারেনি। প্রসঙ্গত ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস এ্যাক্ট করতে মোট সময় লাগে ৮ বছর। ২০০৭ সালে খসড়া তৈরি করে ভারত এখনও তা চূড়ান্ত করতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই আইনের কোন বিতর্কিত ধারা থাকলে তার একটির কারণে সিভিল সার্ভিস ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সে লক্ষ্যে ভালভাবে যাচাই-বাছাই করে আইনটি করা উচিত। ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা খসড়ায় বলা হয়েছে, বাধ্যতামূলক অবসর প্রথা বাতিল, অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণ, তিন স্তরে কর্মকর্তা বিন্যাসের বিধান রাখা হয়েছে। সরকারের অনুমতি ব্যতীত কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ বা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা যাবে না। একই সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সকল কর্মকর্তাকে দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে এই আইনে। তিনটি স্তরের প্রতি স্তরে পদোন্নতির যোগ্যতা নির্ধারণে পরীক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করা হবে। তবে কোন কর্মকর্তা একটানা চারবার পদোন্নতির এই পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে সরকার কোন কারণ দর্শানো ব্যতিরেকে তাকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারবে। জনসেবা নিশ্চিত করাই আইনটির মূলমন্ত্র নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে বলা আছে, কোন সদস্য আইনানুগভাবে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষতিগ্রস্ত হলে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকারী হবে। দায়িত্ব পালনকালীন উদ্ভূত কোন ঘটনার কারণে কোন ফৌজদারি অপরাধ সংঘটিত হলে সরকারের পূর্ব অনুমোদন ব্যতীত কোন আদালত উক্ত অপরাধের জন্য কোন মামলা গ্রহণ করতে পারবে না বা কোন কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করতে পারবে না। কোন সদস্য দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ ব্যতীত অন্য কোন অপরাধে আদালত কর্তৃক তিন বছর মেয়াদে কারাদ-ে দ-িত হলে তাকে চাকরিতে বহাল রাখার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। তিন বছরের অধিক কারাদ-ে দ-িত হওয়ার ক্ষেত্রে এবং দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধের কারণে যে কোন মেয়াদে কারাদ-ে দ-িত হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীতে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি থেকে চূড়ান্তভাবে বরখাস্ত বলে গণ্য হবে। গণকর্মচারী অবসর আইনের ৯ (২) ধারা বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। এই বিধান মতে সরকার চাইলে কোন কারণ দর্শানো ছাড়াই প্রজতন্ত্রের যে কোন কর্মচারীকে চাকরির ২৫ বছর পূর্তিতে বাধ্যতামূলক অবসর দিতে পারবে। এ হাতিয়ার ব্যবহার করে চারদলীয় জোট সরকার প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর দলীয়করণের খড়গ ব্যবহার করেছে। বিগত আমলে এ আইন প্রয়োগ করে ৭৬ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বর্তমান সরকারের সময়ও একজন সচিবকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে কটাক্ষ করে কবিতা লেখার অপরাধে বর্তমান সরকার তথ্য সচিবকে আইনের এই ধারা মোতাবেক বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করে। নতুন আইনে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়ার বিধান বাতিল করার কথা বলা হলেও শৃঙ্খলাজনিত অপরাধ, নৈতিক স্খলন ও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে সরকার তাকে বাধ্যতামূলক অবসর কিংবা অপসারণ করতে পারবে। কিন্তু বিভাগীয় মামলা দায়ের ছাড়া এ ব্যবস্থা নেয়া যাবে না। আইনে সিভিল সার্ভিসকে তিনটি স্তরে বিভক্ত করা হবে। সুপিরিয়র স্তর, সিনিয়র স্তর ও জুনিয়র স্তর। সুপিরিয়র স্তরভুক্ত হবেন জাতীয় বেতন স্কেলের ১ম ও ২য় গ্রেডের কর্মকর্তারা। ৩য় থেকে ৯ম গ্রেডের কর্মকর্তারা থাকবেন সিনিয়র স্তরে এবং জুনিয়র স্তরে অন্তর্ভুক্ত হবেন ১০ম গ্রেড থেকে ১২শ’ গ্রেড পর্যন্ত কর্মকর্তা। সুপিরিয়র স্তরের পদ হবে নীতিনির্ধারণীমূলক। সিনিয়র স্তরের পদধারী কর্মকর্তারা সরকারের নীতি বাস্তবায়নে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ক্ষমতাসম্পন্ন হবেন। এ ক্ষেত্রে জুনিয়র স্তর হবে সহায়তা প্রদানকারী স্তর। সুপিরিয়র স্তরের দ্বিতীয় গ্রেড সিনিয়র স্তরের ৩য় গ্রেডের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে সমগ্র চাকরি জীবনের কর্মদক্ষতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে নির্ধারিত পদ্ধতিতে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। সুপিরিয়র স্তরের দ্বিতীয় গ্রেড থেকে প্রথম গ্রেডে পদোন্নতি নির্ধারিত পদ্ধতিতে হবে। সিনিয়র স্তরের সর্বনিম্ন গ্রেডে ৮০ শতাংশ সরাসরি নিয়োগ দেয়া হবে। বাকি ২০ শতাংশ জুনিয়র স্তরের সর্বোচ্চ গ্রেড থেকে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। জুনিয়র স্তরের সর্বনিম্ন গ্রেডে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হবে। অন্যান্য গ্রেডের পদগুলো নির্ধাতির পদ্ধতিতে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা হবে। নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতার মানদ- ও মেধার ভিত্তিতে জুনিয়র স্তরে ও সিনিয়র স্তরের প্রারম্ভিক পদে সরাসির নিয়োগ হবে। আইনে মাঠপর্যায়ে বদলি ও পদায়নের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, মাঠপর্যায়ের পদে ন্যূনতম ৫ বছরের অভিজ্ঞতা নেই এমন কোন কর্মকর্তাকে সচিবালয়ের কোন পদে বদলি বা পদায়ন করা যাবে না। বেতন ও পদোন্নতির নিশ্চয়তার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কোন সিভিল সার্ভিস সদস্য নির্ধারিত গ্রেডের পদোন্নতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, ফিডার পদের নির্ধারিত চাকরিকাল পূর্ণ হলে এবং কর্মদক্ষতা মূল্যায়ন সন্তোষজনক হলে শৃঙ্খলাজনিত কারণ ব্যতীত উক্ত গ্রেডের বেতন প্রাপ্য হবেন। সকল সদস্যকে সিনিয়র স্তর ও জুনিয়র স্তরের প্রতি গ্রেডে পদোন্নতির জন্য নির্ধারিত পদোন্নতি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। এই পদে কোন সদস্য পর পর তিনবার অকৃতকার্য হলে তিনি স্বেচ্ছা অবসরে যেতে পারবেন। চতুর্থবার অকৃতকার্য হলে কোন কারণ দর্শানো ব্যতীরেকে সরকার তাকে চাকরি থেকে অবসর প্রদান করতে পারবে। মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা সাংবাদিকদের বলেন, এই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ সরকারের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অনেক বছর ধরে এই আইন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারী কর্মচারীদের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা বিধান প্রভৃতির জন্য এই আইন করা জরুরী ছিল। তিনি বলেন, আইনের খসড়ায় ১০টি ক্ষেত্রে এই আইন প্রয়োগের জন্য বিধিমালা প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। এই বিধিমালার মাধ্যমে সরকারি কর্মচারীদের চাকরি নিয়ন্ত্রিত হবে। এতদিন সরকারী কর্মচারীরা কিভাবে পরিচালিত হবেÑ প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সংবিধানে বলা আছে আইন না হওয়া পর্যন্ত অন্যান্য বিধিমালার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মদ মোশাররাফ হোসাইন ভূইঞা বলেন, ফৌজদারি মামলা হলেই সরকারী কর্মচারীদের গ্রেফতার করা যাবে না। আদালত মামলার অভিযোগপত্র অনুমোদন করলে গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সরকারের অনুমতি লাগবে না। এর আগে গ্রেফতার করতে চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে। অন্যদিকে সরকারী কর্মচারীরা যদি চাকরিবিধি লঙ্ঘন বা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেন তাঁদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। এটি আইনের স্বাভাবিক কার্যক্রম।
×