ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রুহুল আমিনের ছেলে শওকত মানসিক প্রতিবন্ধী‍- ভিখারী বা দিনমজুর নন

বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারকে নিয়ে অপপ্রচারে মেতে উঠেছে স্বার্থান্বেষীরা

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১০ আগস্ট ২০১৫

বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারকে নিয়ে অপপ্রচারে মেতে  উঠেছে স্বার্থান্বেষীরা

এমদাদুল হক তুহিন ॥ ‘সুখে নেই বীরশ্রেষ্ঠের পরিবার’ বাক্যটি শোনামাত্রই আঁতকে উঠবে যে কোন হৃদয়। আর ঠিক সে আবেগটিকেই কাজে লাগিয়ে অপপ্রচারেও মেতে ওঠে একদল। যেন সরকারকে হেয় করার এও এক ঘৃণ্য কূটকৌশল। বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ছেলে শওকত আলীর মানসিক সমস্যাকে পুঁজি করে অপপ্রচার চলে ফেসবুক ও নামসর্বস্ব কিছু অনলাইন পোর্টালে। জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান রুহুল আমিনের ছেলেকে ভিখারী ও দিনমজুর বলে দাবি করে চালানো হয়েছে সে অপপ্রচার। আবার কখনও প্রচার করা হয়েছে রুহুল আমিনের ছেলের দিন কাটছে চায়ের স্টলে! বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের যেখানে সর্বাত্মক সুবিধা প্রদান করছে সেখানে একজন বীরশ্রেষ্ঠের সন্তান কিভাবে ভিখারী হয়Ñ প্রশ্ন ওঠে সাধারণের মনে। পরিবার ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোটেও ভিখারী নন শওকত। এমনকি নন দিনমজুরও। তবে তিনি একজন মানসিক বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। বাবার মৃত্যুর পর মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন শওকত। পবিত্র কোরান শরীফের ১৭ থেকে ১৮ পারা মুখস্থ করেছেন। তবে দুর্ভাগ্যবশত পড়ালেখার মাঝপথেই তার মধ্যে মানসিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। জানা গেছে, মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত থাকায় সামাজিক প্রতিপত্তির কথা তার কাছে নিছক খেলনা। আপন তিন বোনের সবাই সামাজিকভাবে বিত্তবান, অর্থের সমস্যা নেই বললেই চলে। তবু তিনি কাজ করতে ভালবাসেন। কখনও নিজের বাড়িতে আবার বাজারেও! সবকিছু উল্টে গেলেও মানুষের কাছে হাত পাতেন না তিনি। বীরশ্রেষ্ঠের বড় কন্যা নুরজাহান নার্গিস জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পাঁচ টাকা দিয়ে বাজার আনবে এ ধরনের মানসিকতাও নেই শওকতের। সে অনেকটা ছোট বাচ্চাদের মতো। বর্ষাকালে নদী থেকে শাপলা তুলে আনে, সবার মধ্যে বিলি করে। কিছু দুষ্ট লোক প্রায়ই আমাদের এ অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অপপ্রচারে মেতে ওঠে।’ নোয়াখালীর নিজস্ব সংবাদদাতা গিয়াসউদ্দিন ফরহাদ জানান, শওকতের জন্ম হওয়ার পর থেকে তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন। পবিত্র কোরান শরীফের ১৭ থেকে ১৮ পারা মুখস্থ তার। এর কিছুদিন পর থেকে তার মানসিক অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পরিবারের পক্ষ থেকে বড় বোন চিকিৎসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন থেকে শওকতের মন যা চায় তাই করেন। ঠেলাগাড়ি ঠেলেন, কচুর লতি কুড়িয়ে বিক্রি করেন। আবার কখনও খালি বোতলও বিক্রি করেন। পণ্যের বিক্রয় মূল্য হিসাবে যে যা দেয় তাই হাত পেতে নেন। শুধু কর্মের বিনিময়ে নেন, কোন দান গ্রহণ করেন না। জানা গেছে, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের দু’ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে ক্যাপ্টেন বাহার ১৯৯৮ সালে মারা যান। সরকার ও পরিবারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করেও শওকতের মানসিক রোগ সারানো সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে তার বড় বোন নার্গিস বলেন, চট্টগ্রাম সিএমএইচ ও ঢাকা সিএমইচে নৌবাহিনীর সহায়তায় তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা নিতে গিয়ে সে একবার হাসপাতাল থেকে পালিয়েও যায়। ১৯৯৩ সালে শেষবার চিকিৎসা করানো হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, হাসপাতাল থেকে শওকত পালিয়ে গেলে বন্দর পুলিশ তাকে আটক করে। তখনও তার পরনে ছিল হাসপাতালের পোশাক। পরে তাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হয়। আর চিকিৎসা দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি। শওকত নিজেকে পুরো সুস্থ দাবি করে। অন্যদিকে এর সত্যতা জানতে শওকত আলীর সঙ্গে ফোনালাপে কয়েক মিনিটের কথোপকথনে বোঝা যায়, শওকত একজন মানসিক প্রতিবন্ধী। এই সংবাদ কর্মীর কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন। সরকারের কাছ থেকে কত টাকা পাচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাকা দিয়ে কি করবেন। বীরশ্রেষ্ঠ পরিবারের অন্যান্য সদস্য ও কয়েক এলাকাবাসীর কথার সত্যতা পাওয়া যায় শওকতের সুরেই। সরকার থেকে প্রাপ্ত সহায়তা প্রাপ্তির ব্যাপারে তার বোন নার্গিস আরও বলেন, ‘কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে টাকা দেয়া হচ্ছে। শওকত আলীর নামেই এ্যাকাউন্ট। তার টাকা সেই ওঠায়। বর্তমানে সে ৮৯০০ টাকা পাচ্ছে। আমাদের পুরো পরিবারকে ৩৬ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে। আমাদের টাকাও ছোট ভাইকে দিয়ে দিতে চাইলেও সন্তান হিসেবে সমান দাবিদার হওয়ায় আইনের কারণে তা সম্ভব হয়নি। পারিবারিকভাবে সর্বাত্মক সাহায্য করছি।’ কেমন আছেন শওকত আলী?- জনকণ্ঠের করা এমন প্রশ্নের জবাবে শওকতের স্ত্রী রাবেয়া আক্তার বলেন, ‘এখন কিছুটা ভাল। ভাল আর কি! শুনেছি বিয়ের আগে তাঁকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছিল। কখনও কখনও তিনি খেয়ালে থাকেন আবার কখনও বেখেয়ালি হয়ে ওঠেন, কথাও কম বলেন।’ সরকারী সাহায্যের ব্যাপারে জানতে চাইলে তার স্ত্রী বলেন, বর্তমানে ৬৬৯০ টাকা পাচ্ছি। তিনিই ওই টাকা ওঠান। তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে। সরকারের এ সাহায্য দিয়েতো মোটামুটি চলতে পারছি। সাহায্য পাওয়া না গেলে পথে বসতে হতো বলেও জানান শওকতের স্ত্রী। তবে দাবি রয়েছে পুনরায় তাকে মানসিক চিকিৎসা দেয়ার। তবু এ ব্যাপারে তাদের পরিবারের কেউ ইতিবাচক কোন উদ্যোগের কথা জানাতে ব্যর্থ হন! বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ভাই আবুল খায়ের এখন এ পরিবারের প্রধান কর্তা। সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করেন তিনিই। আবুল খায়ের আবেগতাড়িত কণ্ঠে জনকণ্ঠকে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন আমাদের গর্ব, এ এলাকার গর্ব, নোয়াখালীবাসীর গর্ব। অথচ আমরা যে এলাকায় বাস করি, এটি একটি জামায়াত অধ্যুষিত এলাকা। এখানে সত্য কথার প্রতিকার নেই! উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আমাদের পরিবারকে হেয়প্রতিপন্ন করতে প্রায়ই এ ধরনের মিথ্যে খবর রটায় স্বার্থান্বেষীরা। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আরেক বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদের ছেলে মোস্তফা কামাল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ছেলে শওকত আলী অনেকটা মানসিক প্রতিবন্ধী। বর্তমান সরকারকে বিব্রত করতে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারকে নিয়ে কুৎসা রটানো হচ্ছে। প্রকান্তরে বীরদের পরিবারকেও হেয় করা হচ্ছে। প্রতিটি পরিবার সরকারের পক্ষ থেকে যে ভাতা পায় তা দিয়ে অনায়াসেই মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো জীবনধারণ করা যায়।’ প্রসঙ্গত, বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমি নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগচাপড়া গ্রামে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তিনি শহীদ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তাঁর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে ক্যাপ্টেন বাহার ১৯৯৮ সালে মারা যান। বীরশ্রেষ্ঠের মৃত্যুর সময় শওকতের বয়স ছিল মাত্র দুই। বড় বোন নার্গিস মায়ের মমতায় শিশু সন্তান শওকতকে পরম যতেœ বড় করে তোলেন। প্রকৃতির নির্মম পরিহাসে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার এক সময়ে তার মানসিক বিকৃতি ঘটে। বর্তমানে ৪০ বছর বয়সী শওকত তাঁর বাবার ভিটেতেই আছেন। স্ত্রী রাবেয়া আক্তার ও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া বৃষ্টিকে নিয়ে শওকতের সুখের হলেও বিপত্তি কেবল মানসিক প্রতিবন্ধিতা! জানা যায়, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানকে যৎসামান্য সম্মান দিতে গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আমিননগর। বাড়ির সম্মুখে বীরশ্রেষ্ঠের পরিবারের দেয়া ২০ শতাংশ জমিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নোয়াখালী জেলা পরিষদ ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করে রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার। একই গ্রামে বীরশ্রেষ্ঠের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন হাই স্কুল, যা শহীদ রুহুল আমিন একাডেমি নামেও পরিচিত। তবে অভিযোগ রয়েছে, বীরশ্রেষ্ঠের এ গ্রামটি জামায়াতের অঘোষিত আখড়ায় পরিণত হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠের নামে প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিতেও বীর পরিবারের কোন আধিপত্য নেই। এলাকায় অনেকটাই কোনঠাসা তারা। স্বার্থান্বেষী একটি চক্র বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের ভাইকে চেনেন না বলে দাবি করেন। এ প্রসঙ্গে বীরশ্রেষ্ঠের নাতি জামাই নিজাম জনকণ্ঠকে বলেন, গর্বিত এ পরিবারের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পরিবারটিকে সব সময় হেয় করা হয়। ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা রয়েছে কারও কারও। ‘বীরশ্রেষ্ঠের গ্রামটি যেন এখন জামায়াতের গ্রাম’। ১৬ কোটি বাঙালীর আবেগের সঙ্গে জড়িত বাঙালী জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানেরা, আর তাদেরই একজন বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন। এমন পরিবারের কেউ বিন্দুমাত্র কষ্টে আছেন জানলে অজান্তেই কেঁদে ওঠে ১৬ কোটি হৃদয়। ধিক্কার দেয় ত্রিশ লাখ শহীদ। আর খবরটি যদি ভুয়া, তখন হৃদয়ের কম্পনও যেন থেমে যায়। বিক্ষোভে ফেটে ওঠে বিপ্লবী মন। যদি খবরটি ছড়ানোর সঙ্গে জড়িত থাকে আঞ্চলিক বখাটে তরুণ, তথাকথিত সুশীল ও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য জামায়াত-শিবিরের হাত; ওই খবর ছড়িয়ে দেয়া ব্যক্তিগুলোর বিচারের দাবি ওঠে সর্বত্র। অনুরূপ তেমনি দাবি রয়েছে পারিবারিক কিংবা সরকারীভাবে শওকতকে পুনরায় মানসিক চিকিৎসা দেয়ার।
×