ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্যান্সারের নয়া চিকিৎসা কেমোর কষ্ট কমবে

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১০ আগস্ট ২০১৫

ক্যান্সারের নয়া চিকিৎসা  কেমোর কষ্ট কমবে

ক্যান্সারের ওষুধের একটা সমস্যা হলো এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। মিউনিখের দুই রসায়নবিদ একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছেন, যার বদৌলতে এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দূর হতে পারে এবং ক্যান্সার রোগীর কষ্ট ও দুর্ভোগ লাঘব হতে পারে। কৌশলটা হলো আলোকে কাজে লাগিয়ে ক্যান্সারের ওষুধের কাজ চালু ও বন্ধ করা। দেহকোষ যখন বিভক্ত হতে উদ্যত হয় তখন মাইক্রোটিউবিউল নামে পরিচিত তার অভ্যন্তরীণ কাঠামোর ক্ষুদ্র অংশগুলো নিজেরাই একটি স্পিন্ডল বা টাকুর মতো জিনিসে বিন্যস্ত হয়ে পড়ে। তার ফলে এর ক্রমোজমগুলো দুটো গাইটে বিভক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। গাইটগুলো একপর্যায়ে কন্যা কোষের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়। সুতরাং টাকু গঠন প্রতিরূপ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যেহেতু কোষের প্রতিরূপ সৃষ্টির কাজটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়াও ক্যান্সারের অন্তর্নিহিত কারণ, তাই মাইক্রোটিউবিউলের কাজে বাধা দেয়ার মতো ওষুধ আবিষ্কারের ব্যাপারে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে নিদারুণ আগ্রহী হয়ে থেকেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো এই কাজের জন্য যেসব ওষুধ উদ্ভাবন করা হয়েছে তার বেশিরভাগই ক্যান্সার কোষ ও সুস্থ কোষ উভয়ের টিউবিউলসমূহকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। এতে ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তার অর্থ হলো, ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করাই যদি তাদের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাহলে যে ডোজটা রোগীর জন্য আদর্শ তার চেয়ে কম ডোজে তাদের সেই ওষুধ প্রয়োগ করা উচিত। তবে মিউনিখের লুডভিক ম্যাক্সিমিলান ইন্সটিটিউটের দুই রসায়নবিদ অলিভার থর্ন সেসহোল্ড ও ডার্ক ট্রনার যে কৌশলের কথা ভাবছেন তাতে এই অবস্থাটা পাল্টে দেয়া যাবে বলে তারা আশা করেন। তারা টিউবিউল নিয়ন্ত্রণকারী এমন ওষুধ উদ্ভাবনের চেষ্টা করছেন, যা আলো ব্যবহারের মাধ্যমে চালু করে দেয়া এবং বন্ধ করা সম্ভব হবে। আলো দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কেমোথেরাপির ধারণাটি অভিনব কিছু নয়। কিছু বিজ্ঞানী কেমোর ওষুধ মলিকুল পর্যায়ের এমন খাঁচায় আবদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন, যা আলোর স্পর্শ পেলে খুলে যাবে। সঠিক জায়গায় আলো ফেললে খাঁচা খুলে গিয়ে ওষুধ শুধু সে জায়গাতেই বেরিয়ে আসবে, যেখানে তা কাজে লাগবে। কৌশলটা দারুণ সন্দেহ নেই। তবে সমস্যা হচ্ছে, একবার খাঁচা খুলে বেরিয়ে এলে ওই ওষুধ আর খাঁচায় পোরা যাবে না। কাজেই এতে করে ভাল কোষেরও ক্ষতি হতে পারে; যদিও সেই ক্ষতির পরিমাণ হবে খাঁচাবিহীন ওষুধের তুলনায় কম। তাছাড়া ওষুধ খাঁচামুক্ত করার জন্য যে আলোর প্রয়োজন, সেটা হলো তীব্র অতিবেগুনি রশ্মি। এই রশ্মিও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ড. থর্ন সেসহোল্ড ও ড. ট্রনার এ অবস্থায় ভিন্ন পথে এগোনোর চেষ্টা করেছেন। তাঁরা এমন এক মলিকুল খুঁজে বের করার প্রমাণ পেয়েছেন, যা টিউবিউলের কাজে ব্যাঘাত ঘটাবে; তবে নিজে আলোর ব্যাপারে এমনভাবে স্পর্শকাতর থাকবে যে, আলো পেলে চালু হবে আবার বন্ধ হবে। তারা দাবি করছেন, এমন এক মলিকুলের সন্ধান পেয়েছেন, যেটি রয়েছে কমব্রিস্টাটিন নামে একটি পদার্থের ছদ্মবেশে, যা দক্ষিণ আমেরিকার বুশউইলোর বাকলে পাওয়া যায়। বুশউইলো গাছে বেশ কয়েক ধরনের কমব্রিস্টাটিন রয়েছে। মাইক্রোটিউবিউলের ক্রিয়াকলাপ নস্যাত করে দিতে এগুলো অসাধারণ কার্যকর। এই উপাদানের কারণেই সম্ভবত গাছটি কীটপতঙ্গ ও রোগ-বালাইয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। ড. থর্ন সেসহোল্ড ও ড. ট্রনার কমব্রিস্টাটিন এ-৪ নামক উপাদানটির ওপর বিশেষভাবে দৃষ্টি দেন। এটি দুটি রূপে পাওয়া যায়, যেগুলোকে বলা হয় আইসোমার। এদের রাসায়নিক গঠন এক কিন্তু আকার ভিন্ন। একটি আইসোমার টিউবিউলের ক্রিয়াকলাপ খুব একটা ব্যাহত করতে পারে না। কিন্তু অন্যটি এ কাজে অতিমাত্রায় কার্যকর। আলোর রশ্মিকে কাজে লাগিয়ে একটি আইসোমারকে কিভাবে অপরটিতে রূপান্তরিত করা যায় এবং কিভাবেই বা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, গবেষকদের সে প্রশ্নের জবাব খুঁজে বের করতে হয়েছিল। একটু মাথা ঘামিয়ে তারা বুঝতে পারেন, মলিকুলে সংলগ্ন দুটি কার্বন এটম সরিয়ে সে জায়গায় সাইট্রোজেন এটম যোগ করে তারা দুটো কাজই করে ফেলতে পারেন। সেটা করতে গিয়ে যে রাসায়নিক বন্ধন তৈরি হয়, তার ফলে ননটক্সিক আইসোমারের ওপর নীল আলো ফেলা হলে সেটি অতিমাত্রায় টক্সিক আইসোমারে রূপান্তরিত হয়ে যায় এবং আলো সরিয়ে নিলে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। অর্থাৎ নন টক্সিক হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, নীল আলো অতিবেগুনি রশ্মির মতো ক্ষতিকর নয়। গবেষণাগারে পরীক্ষা কাজ চালানোর সময় তারা সংশোধিত কম্বিটাস্টিনকে, যার নাম তারা দিয়েছেন ফটোটাস্টাটিন স্তন ক্যান্সারের কোষের সঙ্গে মিশ্রিত করেন। এরপর তারা কিছু নমুনা অন্ধকারে রাখেন এবং অন্যগুলোকে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর নীল আলোর সুন্দরের সংস্পর্শে রাখেন। দেখা যায়, অন্ধকারে রাখা নমুনার ক্ষেত্রে ওষুধ যতটা কার্যকর হয়েছে, আলোর স্পর্শে রাখা নমুনার ক্ষেত্রে ওষুধটি ২শ’ গুণ বেশি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। দেখা গেছে, অতিবেগুনি রশ্মির সংস্পর্শে এলে ফটোটাস্টাটিন আরও বেশি টক্সিক হয়ে ওঠে। এর শক্তি আড়াই শ’ গুণ বেড়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে, সিয়াপের সংস্পর্শে এলে এটা মাত্র ৭৫ গুণ টক্সিক হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী ফটোটাস্টাটিনের কার্যকারিতা বাড়ানো ও কমানো যেতে পারে। অনেকের কাছে ক্যান্সার চিকিৎসায় ফটোটাস্টাটিনের ব্যবহারকে গুরুত্বহীন বা মূল্যহীন মনে হতে পারে। কিন্তু ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে যেসব বাধাবিপত্তি আছে, তা কাটিয়ে উঠতে পারলে ক্যান্সার চিকিৎসায় ফটোটাস্টাটিন এক লক্ষ্যণীয় অগ্রগতি বলে প্রমাণিত হবে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×