ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

নদীভিত্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা করার উদ্যোগ

বাস্তবায়ন হচ্ছে ড্রেজিং মহাপরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৬:১২, ১১ আগস্ট ২০১৫

বাস্তবায়ন হচ্ছে  ড্রেজিং মহাপরিকল্পনা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ দেশের পানি খাত উন্নয়ন ও নদ-নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনতে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে সরকার। ফলে নদীভিত্তিক অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে । এজন্য গত কয়েক বছরে নদী ড্রেজিং এবং ড্রেজার সংগ্রহ সংক্রান্ত কয়েকটি বড় বড় প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আবার নতুন করে কেনা হচ্ছে বিশটি ড্রেজার। এ খাতের উন্নয়নে ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পানি খাত ও ড্রেজিং সংক্রান্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এছাড়া পানি খাত ও ড্রেজিং বিষয়ে গঠিত হয়েছে আরও একটি উপকমিটি। এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল সম্প্রতি জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একনেক বৈঠকে বলেছেন, নদী ড্রেজিং না করে শুধু বাঁধ দিলে হবে না। প্রতিবছর বাঁধ দেয়া হবে আবার সেগুলো ভেঙ্গে যাবে। তাই তিনি নদী ড্র্রেজিংয়ের ওপর জোর দিয়েছেন। মন্ত্রী বলেন, নদী হচ্ছে আমাদের দেশের প্রাণ। এগুলোর প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমরা যদি নদীর গতিপথ ফিরিয়ে দিয়ে এর দু’ধারে জায়গা বের করতে পারি তাহলে প্রচুর জমি পাওয়া যাবে। এতে শিল্প কারখানা তৈরিসহ বিভিন্ন কাজে লাগানো যাবে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির জন্য জমির অভাব হবে না। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কম খরচে যাতায়াত করা যায় নদীপথ ও রেলপথে। এ দুটি পথ চলমান রাখতে নদী ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই। সূত্র জানায়,বাংলাদেশ গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পললসমৃদ্ধ একটি বৃহৎ বদ্বীপ। দেশে ৩১০ কিংবা তারও বেশি নদ-নদী রয়েছে, যার ৫৭টিই সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই অভিন্ন নদীর ৫৪ ভারত এবং তিনটি মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর ১৭ দশমিক ২ লাখ বর্গ কিমি ক্যাচমেন্ট এরিয়ার ১ হাজার ৩৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার পলি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর বঙ্গোপসাগরে পড়ে। ক্যাচমেন্ট এরিয়ার মাত্র ৭ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। বিপুল পরিমাণ পলিবহন এবং পলি দ্বারা গড়ে ওঠা অববাহিকার মধ্য দিয়ে এসব নদী প্রবাহিত হওয়ায় এগুলোর ভাঙ্গা-গড়ার প্রবণতা বেশি। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, গত তিন দশকে যমুনা নদীর প্রশস্ততা ৪ কিলোমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর নতুন নতুন চ্যানেল সৃষ্টি অথবা পরিত্যক্ত হওয়া এ নদীর স্বাভাবিক প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। ফলে নৌ চলাচলে বিঘœ ঘটছে। একই অবস্থা ব্রহ্মপুত্রের ক্ষেত্রেও। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে ৬০ বছর আগে স্টিমার চলাচল করলেও বর্তমানে এটি একটি পরিত্যক্ত চ্যানেলে পরিণত হয়েছে। গঙ্গার শাখা নদী মধুমতি, ভৈরব, চিত্রা, গড়াই, চন্দনা ও গড়াইসহ প্রতিটি নদীর একই অবস্থা। বাংলাদেশের নদীগুলোর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৪ হাজার কিমি। এর মধ্যে বর্ষা মৌসুমে নৌ চলাচল করতে পারে মাত্র ৬ হাজার কিমিতে। অন্যদিকে মাত্র ৩ হাজার ৮শ’ কিলোমিটার এলাকায় সারা বছর পানি থাকে। এর আগে বিশ্বব্যাংকের ‘রিভাইভাল অব ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট ॥ অপশন এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক (১২.৩) জনসাধারণের পরিবহন ব্যবস্থা এককভাবে নৌ পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল। দেশের দুই লাখ ৭৪ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথের তুলনায় নৌপথ অপেক্ষাকৃত কম দৈর্ঘ্যরে; ২৪ হাজার কিলোমিটার হলেও এর বিস্তৃতি অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশের নদীগুলোর পানি প্রবাহ হ্রাস, ক্রস-বাউন্ডারি প্রবাহ হ্রাস, পলিপ্রবাহ বৃদ্ধি এবং জোয়ারের প্রবাহ কমে যাওয়ায় ধীরে ধীরে নাব্য হারাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড বিদেশী ও দেশী পরামর্শকের যৌথ উদ্যোগের একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি অব ক্যাপিটাল ড্রেজিং এ্যান্ড সাসটেনেবল রিভার ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ বিষয়ে একটি সমীক্ষা সম্পাদন করেছে। এতে দেখা যায়, দেশে মোট ২৩ বড় ও মধ্যম প্রকৃতির নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের মোট ২১৬ কাটার সাকশন ড্রেজারের প্রয়োজন হবে। ২০১৪ সালের জুলাইয়ে পরিচালিত এই সমীক্ষার প্রক্ষেপণ অনুযায়ী আগামী ১১ বছরে শুধু নৌপথের নাব্য রক্ষার জন্য সর্বমোট ৫ হাজার ১৮ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ পরিচালনা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এই হিসেবে গড়ে প্রতিবছর ৮৮২ দশমিক ৫৩ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং কাজ সম্পাদন করা প্রয়োজন। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ বহরে বর্তমানে ১৮ ড্রেজার রয়েছে। ২০১৫ সালের মধ্যে আরও তিনটি ড্রেজার সংগ্রহ করা হবে। তখন মোট ড্রেজারের সংখ্যা দাঁড়াবে ২১। এসব ড্রেজারের বার্ষিক ড্রেজিং সক্ষমতা ১১০ লাখ ঘনমিটার। বেসরকারী কোম্পানির ড্রেজারসমূহের বার্ষিক ড্রেজিং ক্ষমতা প্রায় ১৪০ লাখ ঘনমিটার। ফলে সরকারী ও বেসরকারী মিলে ড্রেজিং ক্ষমতা দাঁড়াবে বার্ষিক ২৫০ লাখ ঘনমিটার। ঘাটতি থাকছে ৬৩২ দশমিক ৫৩ লাখ ঘনমিটার। এ প্রেক্ষাপটে ড্রেজার কেনার বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ২০ নতুন ড্রেজারসহ সহায়ক যন্ত্রপাতি এবং সরঞ্জাম সংগ্রহ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প হাতে নিচ্ছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। এতে ব্যয় ধরা হচ্ছে ২ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির আগামী বৈঠকে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হতে পারে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানিয়েছে। অনুমোদন পেলে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এগুলো সংগ্রহের কাজ শেষ করবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য আরাস্তু খান বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির আওতায় ২০ ড্রেজার সংগ্রহ করা হলে বিআইডব্লিউটিএর ২৩২ দশমিক ৫০ লাখ ঘনমিটার ড্রেজিং সক্ষমতা অর্জিত হবে। ফলে অভ্যন্তরীণ নৌপথের উন্নয়ন এবং জলযানের নির্বিঘœ চলাচল সম্ভব হবে। দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটবে। এসব বিবেচনায় প্রকল্পটি অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রমগুলো ২৬ ইঞ্চি কাটার সাকশন ড্রেজার ৬, ২০ ইঞ্চি কাটার সাকশন ড্রেজার ৯, ১৮ ইঞ্চি কাটার সাকশন ড্রেজার ৫, ক্রেন বোট ২০, টাগবোট ৮, ক্রু হাউস বোট কুড়িটিসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি কেনা হবে। সূত্র জানায়, গত বছরের ড্রেজিং সংক্রান্ত কয়েকটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১ হাজার ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ক্যাপিটাল (পাইলট) ড্রেজিং অব রিভার সিস্টেম ইন বাংলাদেশ শীর্ষক একটি প্রকল্প। এটিরও বাস্তবায়নকারী সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। দেশের গুরুত্বপূর্ণ ও বড় নদীগুলো ড্রেজিং করতে অনুমোদন হয় ১৩ ড্রেজার কেনা প্রকল্প। এ প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৫৯৩ কোটি টাকা। অনুমোদন দেয়া হয় ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ ২২ হাজার টাকা ব্যয়ে দশটি ড্রেজার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি ক্রয়সংক্রান্ত প্রকল্প। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার ক্রয়ের মাধ্যমে নিবিড়ভাবে খনন কাজ পরিচালনার মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ নৌপথের বিদ্যমান চ্যানেলগুলোর উন্নয়ন ও জলযানের নির্বিঘœ চলাচলে নির্দেশনামূলক সহায়তার কথা উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া দেশের নদীভিত্তিক অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে নদী ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই। নদীর চ্যানেল ঠিক রাখা গেলে দু‘পাড় আর ভাঙ্গবে না। মানুষও নিঃস্ব হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। এ জন্য সরকার শুরু থেকেই নদী ড্রেজিংসংক্রান্ত বিশেষ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।
×