ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দারিদ্র্য ওদের দমাতে পারেনি- কৃতিত্বের স্বাক্ষর ফলে

প্রকাশিত: ০৬:০০, ১২ আগস্ট ২০১৫

দারিদ্র্য ওদের দমাতে পারেনি- কৃতিত্বের স্বাক্ষর ফলে

শর্মী চক্রবর্তী ॥ দিনমজুর পিতার সন্তান ওরা। কারও মা ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালান। তাই অভাব ওদের নিত্যসঙ্গী। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। তিন বেলা ঠিকমতো খাবার জোটেনি। ছিল না ভাল পোশাক। প্রয়োজনীয় বই খাতাও অন্যের কাছ থেকে ধার করে চালাতে হয়েছে। জীবনের প্রতিটি বাঁকে তারা দরিদ্রতার কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এসব বাধা সত্ত্বেও দমে যায়নি ওরা। যে কারণে মনোবলে ওরা অদম্য। অক্লান্ত পরিশ্রম করে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় এসব মেধাবীরা সর্বোচ্চ সাফল্য জিপিত্র-৫ পেয়েছে। ফলে ওদের জীর্ণ কুটিরে এখন খুশির বন্যা। তবে এমন সফলতার পরও অর্থাভাবে উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন পূরণ কিভাবে হবে তা নিয়ে ওদের পরিবারে দেখা দিয়েছে দুশ্চিন্তা। তাদের অনেকে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার হতে চায়। কিন্তু দারিদ্র্যের কষাঘাতে এই স্বপ্নগুলো পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে ভাবছে তাদের পরিবার। এ অবস্থায় সমাজের হৃদয়বান মানুষের সামান্য সহযোগিতা ওদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। শিক্ষার্থীদের এমনি স্বপ্ন জয়ের গল্প পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধি। এই প্রতিবেদনে সহযোগিতা করেছেন কুড়িগ্রামের স্টাফ রিপোর্টার রাজু মোস্তাফিজ। টিউশনি করে ও মানুষের বাড়িতে কাজ করে পড়ালেখা করেছে সাঈদ ॥ কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর চর গারুহাড়া। যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুর্গম এ চরের ভূমিহীন দিনমজুর শহিদুল ইসলামের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে আবু সাঈদ ইসলাম দ্বিতীয়। লেখাপড়া শিখে ভাগ্য বদলের ব্রত নিয়েছে সাঈদ। তাই ১০ মাইল পথ হেঁটে কখনও বাই-সাইকেলে চড়ে শহরে কলেজে যেতে হতো। দরিদ্র পিতার পক্ষে লেখাপড়ার খরচ যোগানো ছিল অসম্ভব। তাই সাঈদ সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বের হতো। শহরে এসে টিউশনি করত। তারপর কলেজ করে বাড়িতে ফিরত সন্ধ্যায়। এমনকি মানুষের বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের কাজ করত। এতে তারা খুশি হয়ে সাঈদকে টাকা দিত। এ ছিল রুটিন ওয়ার্ক। ৯ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থা থেকে সাঈদ টিউশনি করে পড়ালেখা করত। অধিকাংশ দিন উপোস করে কেটেছে তার। সপ্তাহেও জোটেনি ভাল পুষ্টিকর খাবার। ছিল না ভাল পোশাক, প্রয়োজনীয় বইপত্র কিংবা খাতা কলম। নানা কষ্টের মধ্যেই দিন কেটেছে তার। এমন প্রতিকূলতার মধ্যেও মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয় থেকে এবারে এইচএসসি পরীক্ষায় বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সাঈদ। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর দীর্ঘ সাধনায় প্রত্যাশিত এ রেজাল্টে সাঈদের মনে আনন্দ নেই। অন্ধকার ও অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে সাঈদের যত ভাবনা। উচ্চ শিক্ষার পথ বন্ধের উপক্রম জানালেন অসহায় পিতা শহিদুল ইসলাম। সাঈদের কষ্ট এবং দীর্ঘ সংগ্রামের এসব তথ্য জানিয়ে পিতার একটিই আকুতি ‘এমন কাইয়ো নাই বাহে, মোর ছাওয়াটার নেখাপড়া করায়।’ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত অদম্য মেধাবী সাঈদের জীবন। সাঈদ তার কষ্টের কথা বলতে গিয়ে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলে, দিনের পর দিন উপোস করার যে কী কষ্ট তা বলে বুঝানো মুশকিল। তারপরও সান্ত¡না এতদূর আসতে পেরেছি। এখন দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, অর্থাভাবে আমার উচ্চ শিক্ষার পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে রংপুরে ভর্তি কোচিং করি দু’মাস। এখন এই ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। এইচএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকা ছিল না। কুড়িগ্রাম প্রেসক্লাবের কয়েকজন সাংবাদিক চাঁদা তুলে সে টাকা দেন। দুই ভাই, দুই বোন। আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে বড় বোনের বাল্য বিয়ে হয়। ছোট এক ভাই ও এক বোন পড়ছে। তাদের পড়াশুনায় সহায়তা করতে হয় তাকে। কুড়িগ্রাম সরকারী বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ব্যবসা শিক্ষা শাখা থেকে ২০১৩ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এইচএসসিতে ভাল ফল করে। সাঈদের স্বপ্ন বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধান বাধা দারিদ্র্য। বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, ভর্তি ফি, পোশাক পরিচ্ছদ, বই, যাতায়াত এর ব্যয় নির্বাহের মতো অর্থের উৎস নেই। মা সালেহা বেগম গৃহিণী। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালছেন অভাবী সংসারে সহায়তা করতে। তিনি তার প্রিয় সন্তানের স্বপ্ন পূরণে সমাজের বিত্তবান ও হৃদয়বান ব্যক্তিদের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কুড়িগ্রাম মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক জানান, আবু-সাঈদ অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। পড়ালেখার সুযোগ পেলে সে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে। এটা আমার বিশ^াস। দর্জির কাজ করে জিপিএ-৫ পেয়েছে সিরাজুল ॥ দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত অদম্য মেধাবী সিরাজুলের জীবন। একে দিনের পর দিন উপোস তার উপর পড়ালেখার খরচ। দিনমজুর পিতার হাতেও কাজ থাকে না প্রতিদিন। বাধ্য হয়ে মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। এরপরও চার ভাই-বোন মিলে ৬ জনের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। লেখাপড়ার প্রতি অসম্ভব দুর্বলতার কারণে সিরাজুল দর্জির দোকানে কাজ নেয়। অর্ধেক বেলা কাজ করে পায় ৫০-৬০ টাকা। এ টাকা দিয়ে চলে তার লেখাপড়া। ফরম ফিলাপ ও কোচিং করার মতো সামর্থ্য ছিল না। বাধ্য হয়ে ইসলামী ব্যাংক কুড়িগ্রাম শাখা থেকে মা আছমা বেগম ঋণ নেন ১৫ হাজার টাকা। রবিবার জিপিএ-৫ পাওয়ার খবর শুনে তার মা ভীষণ খুশি হন। কিন্তু ছেলের উচ্চ শিক্ষার কথা ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েন। কারণ ঋণের টাকা এখন শোধ হয়নি। এছাড়া আগামীদিনের পড়ালেখাই বা কিভাবে চলবে। মায়ের সঙ্গে সিরাজুলও এখন দু’চোখে অন্ধকার দেখছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ধরলা নদীর বাঁধের পাশে খাস জমিতে ঝুপরি ঘরে তাদের বসবাস। বাবা তৈয়ব আলী পেশায় দিনমজুর। অপুষ্টির কারণে শরীরে নানা রোগের বাসা। মাসের বেশিরভাগ সময় থাকে অসুস্থ। চিকিৎসা-পথ্যও জোটে না সব সময়। মা আছমা বেগম অন্যের বাসায় ঝিয়ের কাজ করেন। চার ভাই বোনের মধ্যে সিরাজুল দ্বিতীয়। সবার বড় বোন মর্জিনা। ছোট বোন তারজিনা ও তামান্না। সবাই লেখাপড়া করছে। এত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে সিরাজুল কুড়িগ্রাম মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয় থেকে বাণিজ্য বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এ কলেজ থেকে ৫ জন জিপিএ-৫ পেয়েছে। এর অন্যতম সিরাজুল। সিরাজুল ধারাবাহিকভাবে ঈর্ষণীয় ফল করে আসছে। এর আগে ২০১৩ সালে করিমের খামার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। ধারাবাহিক সাফল্য থাকলেও পিছু ছাড়ছে না দারিদ্র্য। সিরাজুলের ইচ্ছা ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে পড়ে আগামীতে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। কিন্তু তার এ স্বপ্ন পূরণের প্রধান বাধা দারিদ্র্য। মায়ের কষ্ট দেখলে সিরাজুলের বুক ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ছেলে হিসেবে সে অসহায়। সংসারে সহায়তা করতে এখন দর্জির কাজের পাশাপাশি টিউশনি করিয়ে আয়ের চেষ্টা করছেন। মা আছমা বেগম জানান, ছেলেকে ভাল-মন্দ খাবার দিতে পারিনি। ছিল না ভাল কোন পোশাক। ঈদের নতুন পোশাক দেয়ার সামর্থ্য ছিল না। তারপরও সিরাজুল আমাদের বুক ভরিয়ে দিয়েছে। গোটা গ্রামের মানুষ ওর জন্য গর্ব করছে। অথচ আমি হতভাগা মা- সন্তানের স্বপ্ন পূরণে কিছুই করতে পারছি না। এখন অন্যের সহায়তা ছাড়া সিরাজুলের স্বপ্ন পূরণ প্রায় অসম্ভব। কুড়িগ্রাম মজিদা আদর্শ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ আবু বকর সিদ্দিক জানান, সিরাজুল অত্যন্ত মেধাবী। হৃদয়বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সে তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে বলে সকল শিক্ষকের বিশ^াস।
×