ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাগেরহাটে মুক্তিযোদ্ধা জনতার আনন্দ মিছিল, মিষ্টি বিতরণ

প্রকাশিত: ০৬:০৩, ১২ আগস্ট ২০১৫

বাগেরহাটে মুক্তিযোদ্ধা জনতার আনন্দ মিছিল, মিষ্টি  বিতরণ

স্টাফ রিপোর্টার, বাগেরহাট ॥ একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার শেখ সিরাজুল হক ওরফে কসাই সিরাজের ফাঁসি এবং খান আকরাম হোসেনের আমৃত্যু কারাদ-ের রায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ বাগেরহাটের সর্বস্তরের মানুষ সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ রায় ঘোষণার পর বাগেরহাটের গোটাপাড়া, শাঁখারীকাঠী, রঞ্জিতপুর, ডাকরা, বেসরগাতী, কান্দাপাড়া, টেংরাখালী, তেলিগাতী, চুলকাঠি, ঘনশ্যামপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ বিজয় মিছিল করেছেন। মঙ্গলবার সকাল থেকেই কসাই সিরাজ ও আকরাম হোসেনের ফাঁসির রায় শোনার অপেক্ষায় ছিল বাগেরহাটবাসী। মুক্তিযোদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ রায়ের খবর শোনার জন্য টেলিভিশনসহ অন্যান্য গণমাধ্যমে চোখ রাখছিলেন। কুখ্যাত রাজাকার কসাই সিরাজের ফাঁসি এবং খান আকরাম হোসেনের আমৃত্যু কারাদ-ের রায় শোনার পর উল্লাসে ফেটে পড়েন মুক্তিযোদ্ধাসহ সর্বস্তরের মানুষ। তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দ মিছিল বের করেন তারা। তাৎক্ষণিক আনন্দ মিছিল বের হয় তার (কসাই সিরাজের) নিজ এলাকা মুক্ষাইট বাজারে। এ সময় স্থানীয়রা মিষ্টি বিতরণ করেন। এ আনন্দ মিছিলে কসাই সিরাজের নিকট আত্মীয়রাও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কসাই সিরাজ তার একাধিক নিকট আত্মীয়কেও অকারণে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। এদিকে বাগেরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের উদ্যোগে শহরে একটি বিশাল আনন্দ মিছিল বের করা হয়। মিছিলে বাগেরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ৪ আসনের সংসদ সদস্য ডাঃ মোজাম্মেল হোসেন ও জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বাগেরহাট সদর আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করেন। প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে মিছিলটি পুরনো কোর্ট চত্বর সংসদ কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। এ সময় মিষ্টি বিতরণ করা হয়। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত এ রায় কার্যকর করার দাবি জানান। বাদী ও সাক্ষীর প্রতিক্রিয়া ॥ রায় ঘোষণার পর আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় মামলার বাদী শহীদ জিতেন্দ্র নাথ দাসের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা নিমাই চন্দ্র দাস ও বাগেরহাট মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ডের সহকারী কমান্ডার মামলার সাক্ষী মোস্তাফিজুর রহমান বাদশা এই প্রতিবেদককে বলেন, কসাই সিরাজের ফাঁসির আদেশে আমরা খুশি। কিন্তু আকরাম হোসেনেরও ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। বাগেরহাটের কুখ্যাত রাজাকার সিরাজুল হক ওরফে কসাই সিরাজের বাড়ি সদর উপজেলার গোটাপাড়া গ্রামে। সেখানে যুদ্ধের পর থেকে সে আর ফিরে যায়নি। তবে তার চাচি নুরজাহান বেগম বলেন, ‘সে আমাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ওর হাত থেকে বাঁচতে আমিও লুকিয়ে ছিলাম।’ বাগেরহাট জেলা বিএনপির প্রাক্তন সভাপতি এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর আলী বাবু রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার সন্তোষ প্রকাশ করে জনকন্ঠকে বলেন, ওই নরঘাতক সিরাজ আমার চাচাত ভাই ওহাবকেও নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ওহাব বাগেরহাট শহরের হরিণখানার মৃত সুলতান আলীর ছেলে ছিলেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন সকালে মানুষ হত্যা না করে যে নাস্তা করত না’ সেই কুখ্যাত নরঘাতক বাগেরহাটের জল্লাদ খ্যাত সিরাজ মাস্টার ওরফে জল্লাদ সিরাজের অবশেষে ফাঁসির আদেশ হয়েছে, এটা খুবই স্বস্তির খবর। গোটাপাড়া গ্রামের একরাম হোসেন, সামাদ খান, নাহিদ হোসেন, ইয়াকুব আলীসহ অনেকে জানান, একাত্তরে রাজাকার সিরাজের নির্যাতনে তারা কেউ ভাই, কেউ বাবা, চাচা, দাদা হারিয়েছেন। তাদের নির্যাতনের হাত থেকে শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই রক্ষা পায়নি। এলাকার মুক্তিযোদ্ধা নুর মোহাম্মদ জানান, কসাই সিরাজ এই এলাকায় মানুষের ওপর সে নির্মম নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তার ফাঁসির আদেশও কম বলে মনে হয়। আত্মীয়কে হত্যা ॥ সিরাজ মাস্টার তার আপন ফুফাত ভাইকে তার মায়ের কাছ থেকে এনে মান্দ্রার পোলের ওপর জবাই করে হত্যা করে। গোটাপাড়ার রাজ্জাক মেম্বারের পিতা তোরাফ হাওলাদারের বুকে বেয়োনেট ঢুকিয়ে তার কলিজা বের করে প্রকাশ্যে উল্লাস করতে থাকে এ নরপশু। এমন পৈশাচিক ঘটনা তখন তার নিত্যনৈমিত্তিক ছিল। এছাড়া বাগেরহাট সদর ও কচুয়া উপজেলার অসংখ্য মানুষকে এই নরখাদক নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আসলে সে কত মানুষকে হত্যা করেছে তার সঠিক তথ্য এখনও জানা যায়নি। ‘মাস্টার’ থেকে ‘কসাই’, হত্যায় জুড়ি ছিল না ॥ নিজের ছাত্র এমনকি নিকট আত্মীয়কেও জবাই ও গুলি করে বা কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যায় জুড়ি ছিল না নরপিশাচ জল্লাদ সিরাজের। মুক্তিযুদ্ধের আগে তার নাম ছিল সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার। শিক্ষকতার জন্য এ নামে তিনি পরিচিতি পান, কিন্তু একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় তার নতুন নাম হয়, ‘কসাই সিরাজ’। সদর উপজেলার গোটাপাড়া গ্রামের মৃত হারেজউদ্দিন শেখ ও সালেহা বেগমের ছেলে শেখ সিরাজুল হক সিরাজ। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেয়নেট দিয়ে গলা কেটে বহু মানুষকে হত্যার কারণে তার নাম হয় ‘কসাই সিরাজ’। ১৯৪২ সালে জন্ম নেয়া সিরাজ বিএ পাস করার পর বাগেরহাটের সায়েড়া মধুদিয়া স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে তিনি খুলনার মাল্টিলেটারাল হাইস্কুলে যোগ দেন এবং মুক্তিযুদ্ধের আগ পর্যন্ত সেখানেই চাকরি করেন। মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ফেডারেশন বা এনএসএফ-এর মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে আসা সিরাজ পরে মূল দলেও সক্রিয় হন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং বাগেরহাট অঞ্চলের উপ প্রধানের দায়িত্ব পান। জেলার বিভিন্ন স্থানে রাজাকার বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধাপরাধে অংশ নেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় সিরাজ মাস্টার রাজাকার বাহিনীর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির একেএম ইউসুফের ‘বাঁ হাত’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইউসুফ মামলার বিচার চলাকালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
×