ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টানা ৩ মাসের নাশকতায় জড়িত কয়েক শ’ শিক্ষক আসামি হয়েও এমপিও পেয়েছেন ;###;এক মাসে এমপিও সাড়ে ৩ হাজার;###;ঘটনা তদন্তের নির্দেশ মাউশির

মাদ্রাসায় তুঘলকি কাণ্ড ॥ রাতারাতি এমপিও

প্রকাশিত: ০৫:৩৭, ১৩ আগস্ট ২০১৫

মাদ্রাসায় তুঘলকি কাণ্ড ॥ রাতারাতি এমপিও

বিভাষ বাড়ৈ ॥ এক মাসেই সাড়ে তিন হাজার শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করে রীতিমতো তুঘলকি কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মাদ্রাসা শাখা। প্রতিমাসে গড়ে যেখানে নতুন এমপিও হয় ৭০০-৮০০, সেখানে সর্বশেষ এক মাসেই অবিশ্বাস্যভাবে মাদ্রাসায় সাড়ে তিন হাজার এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। নতুন সৃষ্ট মাদ্রাসা অধিদফতর ও আঞ্চলিক কেন্দ্রে চলে যাবে এমপিওর কাজ- তাই দ্রুত অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে অযোগ্যদেরও রাতারাতি এমপিওভুক্ত করে ফেলেছেন এ শাখার কর্তাব্যক্তিরা। ভুয়া এমপিওভুক্ত করে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা দেয়ার এ ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে র্শিক্ষা প্রশাসনে। ‘অবিশ্বাস্য’ এমপিওভুক্তির আশঙ্কায় ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন। অব্যাহতি দেয়া হয়েছে কম্পিউটার শাখার প্রধানকে। মহাপরিচালক হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, অনিয়ম হলে কেউ রেহাই পাবে না। জানা গেছে, মাউশির মাদ্রাসা শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়ম দুর্নীতির খবর এটাই প্রথম নয়। এমপিওভুক্তিতে নানা অপকর্ম করে এখানকার কর্মকর্তা কর্মচারীদের শাস্তিও হয়েছে বহুবার। দুদকের তদন্তেও বিভিন্ন সময় ধরা খেয়েছেন দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। কিছুটা স্পর্শকাতর জায়গা হওয়ায় গণমাধ্যমের নজরও এখানে অন্য শাখার তুলনায় কম থাকে। এমপিওর ফাইল যেহেতু মাউশির পরিচালকই (মাধ্যমিক) চূড়ান্ত করেন সেহেতু এখানে মহাপরিচালকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জালিয়াতির সুযোগও বেশি এই শাখায়। পরিচালককে বুঝিয়ে ম্যানেজ করতে পারলেই হয়। এই শাখাকে ‘টাকার খনি’ও বলে থাকেন অন্যান্য শাখার কর্মকর্তা কর্মচারীসহ সারাদেশ থেকে আসা শিক্ষক-কর্মচারীরা। মাদ্রাসায় অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়ে যোগ্যতা না থাকলেও যেমন এখানে এমপিও হয় আবার কিছুৃ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করতে না পারলেও বৈধ নিয়োগ পেলেও এমপিও বঞ্চিত হতে হয়। এমন ঘটনা নিয়ে গত কয়েক বছরে এখানে অসংখ্যবার অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে। এই শাখায় পরিচালক থেকে শুরু করে কর্মচারী পর্যন্ত সরকারবিরোধী এমনকি জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরাও কাজ করেছেন বিভিন্ন সময়। এই মুহূর্তেও প্রশ্ন উঠেছে কয়েকজনকে নিয়ে। এই চক্রটি মাদ্রাসায় এমপিওভুক্ত করার ক্ষেত্রে সরকার বিরোধীদের পক্ষে কাজ করেন বলে কয়েক মাস ধরেই অভিযোগ কর আসছিলেন শিক্ষক কর্মচারী নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা সরকার সমর্থক শিক্ষকরা হয়রানিরও অভিযোগ করেছেন। জামায়াতীদের প্রভাব সম্পর্কে পরিচালক অধ্যাপক এলিয়াস হোসাইনের কাছে অভিযোগ করলে তিনি তা আমলে নেননা বলে অভিযোগ করেছেন মাউশির সরকার সমর্থক কর্মকর্তারা। সাবেক ছাত্র লীগের কয়েক নেতা যারা এখন শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত তারা বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, সরকারবিরোধীরা পরিচালককে নিজেদের লোক বলেই মনে করে। সরকারবিরোধী মাদ্রাসার শিক্ষক, এমনকি বিভিন্ন জেলা উপজেলায় জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্তদের এমপিও দেয়ার অভিযোগ দিলেও কাজ হয় না। মন্ত্রণালয়ের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা তাকে এই পদে বসিয়েছেন বলে পাত্তা দেননা সরকার সমর্থকদেরও। এই শাখার কৌশলের কারণেই চলতি বছর টানা তিন মাস জামায়াতীদের নাশকতায় জড়িত কয়েক শত মাদ্রাসার শিক্ষক আসামি হয়েও এমপিও নিয়েছেন। এই আসামিরা মাদ্রাসায় দিনের পর দিন না এলেও টাকা পেতে সমস্যা হয়না। এই শাখার কিছু ব্যক্তির হাতেই এবার কেবল এক মাসে তিন হাজার ৪৬৭ জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিভুক্ত করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এই শাখা থেকে প্রতি মাসে যে নতুন এমপিওর কাজ হয় তাতে গড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ জন সুযোগ পান। সারাদেশের এমপিওভুক্ত সাড়ে সাত হাজার মাদ্রাসায় কোন কোন মাসে ৩০০ জনও নতুন এমপিওভুক্ত হয়ে থাকে। গেল জানুয়ারি ও মার্চের এমপিও ছিল ৫০০ জন। মে মাসে সর্বোচ্চ এমপিও হয় সর্বোচ্চ এক হাজার ৬৭ জন। কিন্তু হঠাৎ করে জুলাই মাসের এমপিওতে তিন হাজার ৪৬৯ জনকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। বিষয়টিতে ইতোমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে সহকারী পরিচালক (মাদ্রাসা) মোঃ নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে। তিনি অবশ্য বলছেন, ‘আমি ক্লিয়ার’। যদিও তিনিও বলছেন, হ্যা সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য বটে। তাহলে কিভাবে হলো? এ প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি দেশে ছিলাম না দুই মাস। এই সময়ে অনেক কাজ এগোয়নি। এখানেও দায়িত্বে ছিল একজন তাহলে কাজ আগাবে না কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এগিয়েছে তবে সেভাবে না। বিষয়টি কদিন আগে হলেও কিছুটা গোপনই ছিল। কিন্তু অনেক আগের মাসের তুলনায় কয়েক কোটি টাকা বেশি ছাড় করার খবর ছড়িয়ে পড়ায় আর গোপন থাকেনি। ইতোমধ্যেই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন। এমপিওতে যে কোন অনিয়ম বন্ধে বুধবার কম্পিউটার শাখার প্রধান আবুল ফজল বেলালকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। নতুন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে প্রোগ্রামার জামিলুর রহমানকে। এদিকে ঘটনা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েও। কিন্তু সকলের কাছে অবিশ্বাস্য এমপিও মনে হলেও পরিচালক এলিয়াস হুসাইনের কাছে এটি স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। বুধবার তিনি মহাপরিচালকের সামনেই সাংবাদিকদের বলেন, বেশি হলেও এর দুটো কারণ আছে। তার দাবি এমপিও আঞ্চলিক কেন্দ্রে চলে যাবে বলে শিক্ষকরা ভেবেছেন এরপর এমপিও পাবেন না। তাই এক মাসেই বেশি আবেদন করেছেন। আরেকটি কারণ সহকারী পরিচালক নাসির দুই মাস দেশে না থাকায় কম এমপিও হয়েছিল তাই এবার বেশি হয়েছে। পরিচালকের কথা শুনে মহাপরিচালক বলেছেন, আপনি বললেই স্বাভাবিক ধরা যাবে না। তদন্তে বেরিয়ে আসার পর দেখা যাবে আসলে কি হয়েছে ওখানে। অবিশ্বাস্য তো হয়েছেই। তাই তো আমি দু’ একদিনের মধ্যেই দেখতে চাই। অনিয়ম হলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন মহাপরিচালক। তিনি একই সঙ্গে বলেন, আসলে এমপিওর ফাইল পরিচালক পর্যায়েই চূড়ান্ত হয়। যখন কেবল টাকা ছাড় হয় তখন ওই ফাইলে স্বাক্ষর করতে হয় আমার। এখানে কি হয়ে যায় দেখতে হবে। তবে এবার স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা সব এমপিও খতিয়ে দেখতে হবে। আমি দু’একদিন পর সাংবাদিকদের ডেকে ঘটনা জানাব। কর্মকর্তারা-কর্মচারীরা বলছেন, এমপিওর কাজ জেলা-উপজেলায় চলে যাচ্ছে তাই অসাদু চক্র অনিয়ম করে শত শত এমপিও দিয়ে বাণিজ্য করেছে এবার। বিষয়টি মহাপরিচালক শক্ত হাতে সামাল দেবেন বলে আশা করছেন কর্মকর্তারা। মাদ্রাসা শাখা সনদ জালিয়াতির মচ্ছব ॥ গত দেড় বছরে মাদ্রাসা শাখায় অবৈধভাবে অর্থের বিনিময়ে অসংখ্য ভুয়া সনদধারীদেরও এমপিও দেয়া হয়েছে। তদন্তে ধরা পড়ার পর আবার এমপিও বন্ধও করা হয়েছে অনেকের। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসার শত শত শিক্ষক ভুয়া এনটিআরসিএর সনদ দিয়ে এমপিওভুক্ত হয়ে চাকরি করছেন। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার সাতগিরি দাখিল মাদ্রাসার সুপার ভুয়া নিবন্ধনে নিজ পুত্র ও পুত্রবধূকে চাকরি দেয়ায় নিজের চাকরি হারিয়েছেন। পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার হোসেনাবাদ ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার কয়েকজন শিক্ষক ভুয়া নিবন্ধন সনদ নিয়ে চাকরি নেন। পরে তারা জেলা শিক্ষা অফিসের তদন্তে ধরা পড়েন। এ শিক্ষকরা হলেন মো. কামরুল হাসান, মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন, মোছা. সুরাইয়া বেগম ও মো. এহছানুল ইসলাম প্রধান। তাদের মধ্যে প্রথম দু’জন এমপিওভুক্ত হয়ে সরকারী বেতন-ভাতাও ভোগ করছিলেন। পরে এসব শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। পঞ্চগড় সদর উপজেলার প্রধানপাড়া দারুল ফালাহ দাখিল মাদ্রাসার মোছা. ডেজিনা আক্তারের নিবন্ধন সনদও সরকারী তদন্তে ভুয়া প্রমাণিত হয়। কিশোরগঞ্জের তাড়াইল উপজেলার কাজলা আলিম মাদ্রাসার ইংরেজী বিভাগের প্রভাষক ওমর ফারুক এবং আরবী বিভাগের প্রভাষক মো. শিহাব উদ্দিনের বিরুদ্ধেও ভুয়া নিবন্ধন সনদ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের সরকারী বেতন বন্ধ হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নিবন্ধন পরীক্ষায় ফেল করা শিক্ষকদের সঙ্গে এনটিআরসিএর একটি দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেট যোগাযোগ করে অর্থের বিনিময়ে তাদের ভুয়া সনদ সরবরাহ করছে। আর মাউশির মাদ্রাসা শাখার একটি অসাধু চক্র অনৈতিক পন্থায় ভুয়া সনদধারী শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করছেন। এখানেই শেষ নয়, জামায়াত-শিবিরের আস্তানা হিসাবে পরিচিত তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা নিয়েও চলছে দুর্নীতি। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত এ মাদ্রাসার নামে দিনটি প্রতিষ্ঠান খুলে এমপিও নেয়া হচ্ছে। তিনটির নামই তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা। যার দুটি ঢাকায় ও একটি টঙ্গিতে অবস্থিত। একই নামে শাখা খুলে নেয়া হচ্ছে আলাদা আলাদা এমপিও। শাখা দাবি করলে এমপিও সুযোগ থাকে না। তবু নেয়া হচ্ছে এমপিও। জানা গেছে, শাখা বলা হলেও নেয়া হয়েছে আলাতা স্বীকৃতি। আছে আলাদা কোড নম্বরও। অথচ অধ্যক্ষ একজন। যার চাকরির মেয়াদ চলে গেলেও বহাল আছেন। জামায়াতী এ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে এ্যাকশন নেয়ার দাবি জানিয়েছে জমিয়াতুল মোদার্রেসীন বাংলাদেশ। মাদ্রাসা শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় এ সংগঠনিটির মহাসচিব সাব্বির আহমেদ মমতাজী ইতোমধ্যেই মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দাখিল করে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন।
×