ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সুভাষ সিংহ রায়

বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ১৪ আগস্ট ২০১৫

বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র

অধ্যাপক আবুল ফজলকে বঙ্গবন্ধু খুবই সম্মান করতেন। সেই অধ্যাপক ফজলও বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জিয়ার মন্ত্রিসভায় শিক্ষা উপদেষ্টা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। যাহোক, জিয়াউর রহমান সাহেবের শিক্ষা উপদেষ্টা থাকা অবস্থায় আবুল ফজলের লেখা একটা ছোটগল্প ১৯৭৭ সালের ৩ নবেম্বর সাহিত্য সাময়িকী ‘সমকালে’ ছাপা হয়। গল্পের নাম ‘মৃতের আত্মহত্যা’। মূলত এই গল্পের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকা-ের প্রকাশ্য প্রতিবাদের সূচনা ঘটে। ‘মৃতের আত্মহত্যা’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র সোহেলি। সোহেলি বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ে অংশ নেয়া এক মেজরের স্ত্রী। মেজরের নাম ইউনুস। খুনী মেজরের স্ত্রী সোহেলির মধ্যে এক ধরনের অনুশোচনা কাজ করে। পঁচাত্তর পরবর্তী খুনীদের বিদেশী দূতাবাসসমূহে চাকরিতে নিযুক্ত করা হয়েছিল, দূর মরুভূমিতে দেশ ও নিকটাত্মীয়দের ছেড়ে নির্বাসিত জীবনের গ্লানি বহন করে সোহেলি। শুধু তাই-ই নয়, খুনীর ছেলে বলে তার সন্তানের মধ্যেও তীব্র অনুশোচনা কাজ করে। এক ধরনের অপরাধবোধও কাজ করে। মানসিক যন্ত্রণায় তাড়িত হয়ে সোহেলি তার স্বামীর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেÑ সংসারের স্বতঃস্ফূর্ততা নষ্ট হয়ে যায়। ইউনুসের প্রতি তার ঘৃণা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। এক পর্যায়ে সোহেলি নিজেকে মৃত ভাবতে শুরু করে। নিজের সন্তানকে মরুভূমি থেকে দেশে পাঠিয়ে দিয়ে সোহেলি বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ। সোহেলির এই আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের প্রতি তার ঘৃণা, ক্ষোভ আর তিরস্কার পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। এছাড়াও আবুল ফজল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নিহত মুখ, ইতিহাসের কণ্ঠস্বর নামে অসাধারণ গল্প লিখেছেন। উল্লেখ্য, আবুল ফজল যে সময় ‘মৃতের আত্মহত্যা’ গল্পটি লিখেছেন, তখন তিনি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এ গল্প লেখার অপরাধে পরবর্তীতে আবুল ফজলকে বেশ ঝামেলার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশে কোন স্বাভাবিক অবস্থার লেশমাত্র ছিল না। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশে প্রতিদিন রাতে কার্ফু দিয়ে দেশ শাসন করা হয়েছে। মূলত ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দেশে প্রতিদিন রাতে কার্ফু থাকত। লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকা’ মন্তব্য করেছিল, ‘হাল-চাল দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশের জনসাধারণ আইয়ুবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় প্রচারণা ও সামরিক শাসনের যুগে ফিরে গিয়েছে।’ সবচেয়ে মজার ব্যাপার, এসবকেই বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একাংশ বলে থাকেন ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’। তাইতো প্রয়াত হুমায়ুন আজাদ অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলতেন, ‘বাঙলার বিবেক খুবই সন্দেহজনক। বাঙলার চুয়াত্তরের বিবেক সাতাত্তরে পরিণত হয় সামরিক একনায়কের সেবাদাসে।’ কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন বাংলা একাডেমিতে ১৯৭৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতার লাইনগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তখন সমবেত সকলে প্রতিধ্বনি করেছিল। এই কবিতা আজ অনেকের কাছে হয়তো অতি পরিচিত; কিন্তু ওই সময়ে কবির কণ্ঠের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল সে সময়ের প্রেক্ষাপটে এক একটি শব্দব্রহ্মসম। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে উন্মুক্ত সভায় বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চাওয়া তো দূরের কথা, বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ ছিল নিষিদ্ধ। সেইরকম একটি সময়ে কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিবাদের, প্রতিরোধের সাহসী মশাল জ্বালিয়েছিলেন। ভাবা যায় না, সে সময় তিনি কি রকম সাহসী উচ্চারণ করেছিলেন। অথচ সেই অর্থে নির্মলেন্দু গুণের সে সময় এত সাহসী হওয়ার কথা নয়। অথচ যে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক-গুণীজন ‘বাকশালে’ যোগ দেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন তারা অনেকেই নীরব ছিলেন। পরবর্তীতে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর গদ্যসমগ্র-২-তে বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। পাঠকের জন্য তা উৎকলন করছি । ‘এতদিনে এ কথা তো সবারই জানা হয়ে গেছে যে, বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছা পূরণের জন্য তাঁর লাশ টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়নি। হত্যাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল তাঁকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রাখা। দূরে সরিয়ে রাখাটা শুধু ইতিহাস থেকে নয়, ভূগোল থেকেও। যে সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুর লাশ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গীপাড়ায় নিয়ে গিয়েছিল, তারা চেয়েছিল কফিনবন্দি লাশটিকে টেলিফোন নির্দেশে পূর্বে খুঁড়ে রাখা কবরে দ্রুত নামিয়ে রেখে ঢাকায় ফিরে আসবে এবং স্থানীয় পুলিশ ঐ কবর পাহারা দেবে। কিন্তু তাদের ঐ পরিকল্পনায় বাদ সাধলেন মৌলবী শেখ আবদুল হালিম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বললেন, এটি যে শেখ মুজিবের লাশ তা আমার নিজে চোখে দেখে নিশ্চিত হতে হবে, তারপর আসবে দাফনের প্রশ্ন। সৈনিক বললেন, আমাকে আপনার বিশ^াস হয় না? শেখ আবদুল হালিম বললেন, এটা বিশ^াস-অবিশ^াসের কথা নয়, এটা ধর্মীয় বিধান। সৈনিক দেখলেন, এ মৌলানাকে ভয় দেখিয়ে কাজ হবে না। মুজিবের লাশের সামনে দাঁড়িয়েও যে তর্ক করার সাহস রাখে তাঁর সঙ্গে আপোষ করাই ভালো। অগত্যা সৈনিকের নির্দেশে কফিনটি খোলা হলো। তখন মৌলবী শেখ আবদুল হালিম দেখলেন ঐ কফিনের ভিতরে শায়িত শেখ মুজিব। তাঁর চোখ জলে ভরে আসতে চাইলো। কিন্তু অনেক কষ্টে তিনি অশ্রু সংবরণ করলেন। সৈনিক বললো, এবার জানাজা পড়ে দ্রুত দাফন করার ব্যবস্থা করুন। দশ মিনিট সময়। শেখ আবদুল হালিম বললেন, ইসলামী মতে লাশকে দাফনের আগে গোসল দিতে হবে। সৈনিক বললো, তার দরকার নেই। তিনি বললেন, আছে। অবশ্য আপনি যদি বলেন যে, মুজিবকে শহীদ করে আনা হয়েছে এবং এ ব্যাপারে আপনি যদি আমাকে লিখিত দেন, তাহলে আমি গোসল ছাড়াই লাশ দাফন করতে পারি। মৌলবীর অকাট্য যুক্তি এবং নির্ভয়চিত্ততার কাছে পরাভব মানলো ঐ সৈনিক। তাঁকে আরও কিছু সময় দেয়া হলো এবং দাফনকর্মে সহায়তা করবার জন্য আরও কিছু লোক আনবার অনুমতি পেলেন তিনি। তখন বরফাবৃত শেখ মুজিবকে কফিন থেকে টুঙ্গীপাড়ার জন্মের মাটিতে নামানো হলো গোসল দেবার জন্য। একটি ৫৭০ সাবান কিনে আনা হলো। রেডক্রসের গুদাম থেকে কাফনের জন্য আনা হলো একটি মোটা সাদা থান কাপড়। গোসল করার সময় দেখা গেলো বঙ্গবন্ধুর ফুলে-যাওয়া গা থেকে তাঁর পাঞ্জাবীটা কিছুতেই খোলা যাচ্ছে না। একটি দা দিয়ে তখন তা কেটে ফেলা হলো। গোসল করানোর সময় তাঁর তলপেট থেকে বেরুলো উঁকি দিয়ে থাকা একটা বুলেট। বেশ বোঝা গেলো যে আরও বুলেট রয়ে গেছে তাঁর দেহের ভিতরে। তাঁর পাঞ্জাবীর বুক পকেট থেকে আবিষ্কৃত হলো তাঁর কালো ফ্রেমের ভাঙ্গা-চশমাটি। নিচের বাম পকেট থেকে বেরুলো এরিনমুর তামাকের একটি ব্যবহৃত কৌটো এবং ডান পকেট থেকে পাওয়া গেল তাঁর সেই বিখ্যাত পাইপ। বৃদ্ধ মৌলবী শেখ আবদুল হালিম বললেন, আমার মনে হয় গুলিতে মুজিবের মৃত্যু হয়নি। কেননা, তাঁর মাথায় বা বুকে কোথাও একটিও গুলি লাগেনি। তাই বোধ হয় মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য তাঁর পায়ের গোড়ালীর রগ কেটে দেয়া হয়েছিল। তিনি জানান, নামাজে জানাজা শেষে, একটু দূরে অপেক্ষমাণ সন্ত্রস্ত জনতার অশ্রুসজল চোখের সামনে বঙ্গবন্ধুর লাশ যখন কবরের উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন ডুকরে কেঁদে ওঠা এক বৃদ্ধা মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে সৈনিকের ব্যূহ ভেদ করে মুজিবের লাশের কাছে ছুটে যান। ইনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর চাচী। বৃদ্ধা তাঁর পুত্রপ্রতিম মুজিবের মুখখানা শেষবারের মতো দেখার অনুমতি প্রার্থনা করেন। তিনি কেঁদে কেঁদে বলেন, ওরে আমি কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি, ওরে শেষবারের মতো আমাকে দেখতে দাও। তখন সৈনিকটি রাজি হয়। বন্ধ করে ফেলা কাফনের বাঁধন আলগা করে আবার বৃদ্ধাকে ডাকা হয় লাশের পাশে। মাতৃসমা ঐ বৃদ্ধা তখন লাশের ওপর উবু হয়ে শেষবারের মতো তাঁর পুত্রবৎ মুজিবকে চোখ ভরে দেখেন। তারপর আর কোন বাধা রইলো না। সৈনিকের নির্দেশে মুহূর্তের মধ্যেই বাংলার মাটি চিরদিনের জন্য গ্রাস করে নেয় তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।’ ২. বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর কি কারণে মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ, মওলানা ভাসানী নিষ্ঠুর আচরণ করেছিলেন! তাঁরা দু’জন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ছিলেন। তাঁরা দু’জনের একজনও বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের কাছে আমাদের নায্য পাওনা নিয়ে একটিও কথা বলেননি। এমএ জি ওসমানী বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেনারেল জিয়ার হাত শক্তিশালী করেছেন। তিনি ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কথা বললেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। বাংলাদেশ সেনাবহিনীর জন্য ইউনিফর্ম বা ইউনিফর্মের কাপড় আমদানির ব্যাপারে আরও একটি মজার ঘটনা ঘটে। স্বাধীনতা-পূর্বকালে সামরিক বাহিনীর পছন্দমতো তাদের পোশাক যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করতে গেলে ভারতের তুলনায় দাম অনেক বেশি পড়ে এবং বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য এবং ঋণচুক্তির আওতায় তুলনীয় একই পোশাক ভারত থেকে সংগ্রহ করা যায়, এই ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বিমত এত তীব্র ছিল যে, জেনারেল ওসমানী প্রতিরক্ষামন্ত্রী না হয়েও (প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তিনি ছিলেন পরিবহনমন্ত্রীর দায়িত্বে এবং নিজেকে সামরিক বাহিনীর স্বার্থের একজন রক্ষাকর্তা বলে মনে করতেন) বিষয়টি মন্ত্রিসভায় তোলেন। তার যুক্তি ছিল যে, পাকিস্তান আমলে সামরিক বাহিনী যে মানের পোশাক ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল, ভারত থেকে আমদানি করা কাপড় তা অপেক্ষা নি¤œমানের হবে। এটি তাদের আত্মবিশ^াস ও সামরিক প্রত্যয়ের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। দেশে তৈরি কাপড়ের পোশাক পরা সত্ত্বেও ভারতীয় সেনাবাহিনী আত্মবিশ^াসহীনতা কিংবা কম যোগ্যতার পরিচয় দেয়নি। পরে এই পেশাক দু’ভাগে ভাগ করে ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে কিনে একটা সমঝোতা করা হয়। বিশেষ বিশেষ দ্রব্যের আপেক্ষিক মূল্য ও মানের ওপর ভিত্তি করে ভারত এবং বাইরের বাজারÑউভয় উৎস থেকেই ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতার আশপাশে পাকিস্তানী ভূত ছিল এবং তারাই বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল। এক হিসাব অনুসারে, যুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি ১২-১৩ মিলিয়ন ডলার বলে ধারণা করা হয়। এর মধ্যে অবকাঠামোগত পুঁজি দাঁড়ায় ২০ মিলিয়ন ডলার এবং মানব পুঁজি ৩ বিলিয়ন ডলার। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা আদায়ে কার্যক্রম হাতে নেবে। (ক) পাকিস্তান নীতিগতভাবে সব সম্পদ ও দায় সমানভাবে ভাগ করে নেবে, (খ) একটি যৌথ কমিশন এ বিষয়ে বিস্তারিত পরীক্ষা করে দেখবে এবং (গ) পাকিস্তান দুই মাসের মধ্যে কিছু অর্থ তার সদিচ্ছার প্রতীক হিসেবে বাংলাদেশকে প্রদানের উদ্যোগ নেবে। প্রথম কিস্তিতে সহজে হিসাবযোগ্য সম্পদ দিয়ে পরিশোধ করা হবে, যেমন- স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রা, বেসামরিক বিমান ও জাহাজ। এই প্রতীকী অর্থ প্রদানের পরিমাণ ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ধার্য করা হয়। এটি ছিল সমগ্র পরিশোধ ও বণ্টনযোগ্য সম্পদের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তা ছাড়া অন্যদিকে বাংলাদেশ এরই মধ্যে পাকিস্তানের বৈদেশিক দায় ভাগ করে নিয়েছিল। বাংলাদেশ এটাও প্রস্তাব করে যে, যদি পাকিস্তানের টোকেন দায় মেটাতে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংগ্রহ না থাকে, তেল উৎপাদনকারী বন্ধু দেশ (যারা বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনাকালে দুই দেশের বিবাদ মীমাংসা করে দেয়ার জন্য উৎসাহ দেখিয়েছে) পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে সহযোগিতাদানে প্রস্তুত। ১৯৭২-৭৩ সালে শুধু খাদ্য বা ভোগ্যপণ্য নয়, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার মেরামত ও পুনর্গঠনের জন্য এবং শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহেও ভারত ব্যাপক সহায়তা প্রদান করে। ভারত নিজে তেলের আমদানিকারক হয়েও বাংলাদেশের জ্বালানি তেল শোধনাগারের (রিফাইনারি) জন্য অপরিশোধিত তেল সরবরাহ করে জরুরী সহায়তা করেছিল। ভারত বেসামরিক বিমান ও জাহাজ সরবরাহ করে। নতুন দেশটির জন্য সবচেয়ে জরুরী ছিল খাদ্য। ১৯৭২-এর শুরুতে বাংলাদেশ একদিকে যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের ক্ষতি এবং আরেকদিকে পরপর দু’বার শস্যহানির কবলে পড়ে। ভারত সহায়তা হিসেবে শুধু ৪ লাখ টন খাদ্যশস্যই দেয়নি, খাদ্যশস্য পরিবহনেও সহায়তা করে। প্রথম ৬ মাসে মোট প্রাপ্ত খাদ্য সহায়তার ৭৪ শতাংশই ভারত দিয়েছিল। ১৯৭১-এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২-এর জুনের মধ্যে ২০ কোটি মার্কিন ডলার দান হিসেবে এবং পণ্য আমদানি ও প্রকল্পের জন্য অত্যন্ত সহজশর্তে ৪.২ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ প্রদান করে। ১৯৭১ থেকে ১৯৭৪-৭৫ সময়ে ভারত ৩০.৮ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৭.৭ কোটি মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তার পর দাতাদের মধ্যে এটাই ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সহায়তা। ৩. প্রথম আলোর ঈদ সংখ্যায় মহিউদ্দিন আহমেদের ‘বিএনপির উত্থান-পতন’ শিরোনামে একটা লেখা ছাপা হয়েছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর বহুদলীয় গণতন্ত্রের স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। মৃত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সামরিক সরকারের অস্বস্তি ও ভয় ছিল। মৃত বঙ্গবন্ধুকে মোকাবেলা করার জন্য ৪ আগস্ট ১৯৭৬ সালে ইতিপূর্বে জারি করা রাজনৈতিক দলবিধি সংশোধন করা হয়। প্রথমে জারি হওয়া দলবিধিতে ছিল, ‘ক্ষতিকর কার্যকলাপে লিপ্ত’ কোনো সংগঠনকে নিবন্ধন দেওয়া হবে না। ৪ আগস্টের সংশোধনীতে ক্ষতিকর কার্যকলাপের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ১০টি উপদফার উল্লেখ করা হয়। ১০ নম্বর উপদফায় বলা হয় : ‘কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি বা উৎসাহিত করিবার জন্য পরিকল্পিত হয় বা উৎসাহিত করিতে পারে বলিয়া সম্ভাবনা রহিয়াছে।’ এ কথা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না, দলের শক্তি পুনরুদ্ধারে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি ব্যবহার করা থেকে আওয়ামী লীগকে বিরত রাখার জন্যই রাজনৈতিক দলবিধিতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছিল। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ সরকারী অনুমোদনের জন্য আবেদন করে। ঘোষণাপত্রে আওয়ামী লীগ ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উল্লেখ করেছিল। সরকার আওয়ামী লীগকে অনুমোদন দিতে অস্বীকার করে। পরে আওয়ামী লীগ ঘোষণাপত্র থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি বাদ দিয়ে আবার আবেদন করলে ৪ নবেম্বর ১৯৭৬ দলটিকে অনুমোদন দেয়া হয়। আশ্চর্য হতে হয়, তারপরও এদেশের কিছু মানুষ এখনও বলেন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র এসেছে। হায়, সেলুকাস, বিচিত্র এই দেশ! লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
×