ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারী ব্যাংক : ‘সর্বাগ্রে ধরা হবে প্রধান নির্বাহীকে’

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১৪ আগস্ট ২০১৫

সরকারী ব্যাংক : ‘সর্বাগ্রে ধরা হবে প্রধান নির্বাহীকে’

গত সপ্তাহের শেষের দিকে সকল সরকারী বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডাক পড়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ড. আতিউর রহমান। সরকারী চারটি বাণিজ্যিক ব্যাংক যথা- সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে হাজির ছিলেন স্ব স্ব ব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ প্রধান নির্বাহীগণ। খবরের কাগজের রিপোর্টানুযায়ী ওই সভায় ব্যাংকগুলোর ‘পারফরম্যান্স’ তুলে ধরা হয়। ভাল-মন্দ মিশিয়ে গবর্নর সাহেব তার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য তুলে ধরেন। দেখা যাচ্ছে, আলোচনায় এসেছে প্রায় সবদিক। যেমন- ব্যাংকগুলোর লাভপ্রদতা, লোকসানী শাখা, শ্রেণী বিন্যাসিত ঋণ, শীর্ষ খেলাপীদের কাছ থেকে নগদ আদায়, পুঁজিস্বল্পতা, দক্ষতার মান, ক্যামেলস রেটিং ইত্যাদি। ‘অডিট কমিটি’ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কমিটির দায়-দায়িত্ব কী তাও সভায় উল্লেখ করা হয়। অডিট কমিটি যাতে নির্ভয়ে কাজ করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে পরামর্শ দেয়া হয়। পুুুুুুঁজিস্বল্পতা সম্বন্ধে গবর্নর বলেছেন, পুঁজির টাকা যদি সরকারকে পুনর্ভরণ করে দিতে হয়, তাহলে এর চাপ পড়ে জনগণের ওপরÑ যা কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গেই তিনি ব্যাংকগুলোকে মুনাফার দিকে নজর দিতে বলেন; বলেন দক্ষতার দিকে নজর দিতে। লোকসানী শাখা সরকারী ব্যাংকের বাড়ছে বলে সভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। অনিয়ম, ঘোরতর অনিয়ম সম্পর্কে তিনি বলেছেন, যা দেখলাম কাগজে, শাখায় কোন ক্ষেত্রের অনিয়ম ঘটলে সর্বাগ্রে ধরা হবে ‘ম্যানিজিং ডিরেক্টর’কে অর্থাৎ প্রধান নির্বাহীকে। গবর্নরের কথার সুর যদি আমি কাগজের রিপোর্ট পড়ে বুঝে থাকি, তাহলে তিনি বোর্ডের দায়-দায়িত্ব কী, এর উল্লেখও করেছেন। সর্বোপরি দেখলাম তিনি বলেছেন, দরকারবোধে ব্যাংকের বোর্ড ভেঙ্গে দেয়া হবে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বসিয়ে দেয়া হবে। বলাবাহুল্য সভাটি ছিল নিয়মিত একটা সভা, যাতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে স্বাক্ষরিত ‘সমঝোতা চুক্তি’ভিত্তিক অগ্রগতির পর্যালোচনা করা হয়। আজকের নিবন্ধে মাননীয় গবর্নর কর্তৃক উত্থাপিত সকল বিষয়ের ওপর আলোচনা করা সম্ভব নয় বিধায় আমি নির্বাচিত দুটো বিষয়ের ওপর আমার আলোচনা সীমিত রাখব। বিষয় দুটো হচ্ছেÑ প্রধান নির্বাহী ও চেয়ারম্যান। প্রথমেই গবর্নরকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই তার একটি কথার জন্য। ব্যাংকগুলোর শাখায়-শাখায় নানা ধরনের অনিয়ম হয়। এর মধ্যে আছে সাধারণ অনিয়ম এবং আছে ঘোরতর অনিয়ম। কাগজে দেখলাম তিনি বলেছেনও, অনিয়মের জন্য সর্বাগ্রে ধরা হবে ম্যানেজিং ডিরেক্টর অর্থাৎ প্রধান নির্বাহীকে। এ ব্যবস্থার জন্য তাকে ধন্যবাদ। বহুদিন ধরে আমি লিখছিÑ ‘ফিক্স আপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর’। প্রধান নির্বাহী অর্থাৎ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ব্যাংকের সর্বক্ষণিক কর্মকর্তা। তিনি বোর্ড ও ব্যাংকের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী কর্মকর্তা। তার সইয়ে ব্যাংকের সকল কাজ হয়। চাকরি প্রদান, পদায়ন, পদোন্নতি, ব্যয় সংঘটন, ঋণ অনুমোদন থেকে শুরু করে সকল কাজ তার সইয়ে হয়। চেয়ারম্যান বা পরিচালকদের নীতি প্রণয়ন ছাড়া কোন কাজ নেই। মাসে দু-একবার ব্যাংকের সভায় যাওয়া ছাড়া তাদের কোন কাজ নেই। যে ‘মেমো’ প্রধান নির্বাহী বোর্ডে নিয়ে আসলে তার ওপর সিদ্ধান্ত দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই তাদের। এরকম একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রধান নির্বাহীকে তার কাজ সুষ্ঠুভাবে এবং ভয়ভীতির উর্ধে উঠে করার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক চমৎকার একটা ব্যবস্থা করে রেখেছে। যে কেউ ‘এমডি’ হতে পারেন না। তার ‘ফিট এ্যান্ড প্রপার টেস্ট’ আছে। তা পরিপূরণ সাপেক্ষে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নিয়োগ অনুমোদন করে। বোর্ড তার নিয়োগ দিলেও তিনি ‘এমডি’ হতে পারেন না যদি না কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুমোদন দেয়। অধিকন্তু একবার তার নিয়োগ ‘কনফার্মড’ হয়ে গেলে তাকে বোর্ড সরাতে পারে না। তার জন্যও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন লাগে। এই ‘সুরক্ষা’ তাকে দেয়া হয়েছে, যাতে তিনি নির্ভয়ে ও দক্ষতার সঙ্গে পেশাজীবীর মতো কাজ করতে পারেন। ব্যাংকে নিয়ম মেনে কাজ হলে তিনি প্রশংসার দাবিদার হবেন, অনিয়ম হলে তিনিই হবেন প্রধানতম ‘আসামি’। আমরা এতদিন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করেছি। ‘এমডিরা’ ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছোটাছুটি কর্মচারী-কর্মকর্তাদের পেছনে ছোটা হয়েছে। সেটা করা হবে কিন্তু ‘এমডি’ থাকবেন ধরাছোঁয়ার বাইরে তা হয় না। একটা ঋণ প্রস্তাবে এমডির সই না হলে তা পাস হয় না। কর্মকর্তাগণ, এমডি, ডিএমডি, জিএম এবং অন্যান্য কর্মকর্তা যার যার ওপর প্রত্যর্পিত ক্ষমতাবলে ঋণদান করেন, পদায়ন করেন, খরচ নির্বাহ করেন যা তাদের ক্ষমতায় নেই তাই নিয়ে আসা হয় বোর্ডে। যেখানে এমডিসহ কমপক্ষে মেমোতে সই থাকে পাঁচ-সাতজনের। কোন অনিয়ম কেউ যদি করতে চায়, অনিয়ম যদি চেয়ারম্যান অথবা ডিরেক্টররা করতে চান তাহলে ‘এমডি’ ছাড়া তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কারণ চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের নির্বাহী কোন ক্ষমতা নেই। অতএব যে কোন অনিয়মের জন্য প্রথম ধরা উচিত ‘এমডিকে’। আমি গবর্নরকে আবার ধন্যবাদ দিই এ সিদ্ধান্তের জন্য। দুই-একজন এমডির ‘গর্দান’ নেয়া হোকÑ অনিয়মের জন্য। দেখা যাবে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। বোর্ড কোন কিছুর জন্য দায়ী থাকবে নাÑ এটা কিন্তু আমি বলছি না। তারা থাকবে তবে প্রথমেই ধরতে হবে ‘এমডি’দের। ‘এমডি’ যদি কোন অনিয়মিত কাজ করতে বাধ্য হন, তাহলে গোপনে তিনি তা গবর্নরকে জানাতে পারেন। এ ব্যবস্থা আছে। তা বাস্তবায়িত করা হোক। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে চেয়ারম্যান। দেখা যাচ্ছে ইদানীং চেয়ারম্যানদের সভায় ডাকা হচ্ছে। ‘অডিট কমিটির’ চেয়ারম্যান এবং ‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির’ চেয়ারম্যানদের দিয়ে কাগজপত্র সই করিয়ে নেয়া হচ্ছে। এ সবের আদর্শিক বা ব্যবস্থাপনার মৌলগত ভিত্তি কী আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। কোন্্ মৌলনীতির অধীনে পরিচালক এবং চেয়ারম্যানদের দৈনন্দিন বিষয়ে জড়িত করা হচ্ছে তা পরিষ্কার করা দরকার। একদিকে বলা হচ্ছে, বোর্ড সসদ্যরা নীতিমালা প্রণয়ন ছাড়া কোন দৈনন্দিন বিষয়ে জড়িত হতে পারবে না। অন্যদিকে তাদের দৈনন্দিন বিষয়ে ধীরে ধীরে জড়িত করা হচ্ছে ঋণ ও আমানতের রুটিন টার্গেট পরিপূরণের জন্য। চেয়ারম্যান এবং এমডি দুজনই যদি দায়ী হয় তাহলে নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব নিতে হয় সরকার অথবা কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। শীর্ষ খেলাপীদের কাছ থেকে নগদ আদায়ের দায়িত্ব যদি চেয়ারম্যান এবং পরিচালকদের হয়, তাহলে তাদের ঋণগ্রহীতার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হবে, তাদের অফিস লাগবে, সঙ্গে লাগবে আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। এটা তাহলে হয় সর্বক্ষণিক কাজ। তাহলে বেতনের বা সম্মানীর কথা উঠবে। এসব দিক বিবেচনা করে আমার মনেই হচ্ছে পরিচালক পর্ষদকে ধীরে ধীরে দৈনন্দিন কাজে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্ভবত তা করছে এক ধরনের উদ্বেগ থেকে। এটাই যদি হয় তাহলে চলুন আমরা বঙ্গবন্ধুর আমলে চলে যাই। তিনি তো সবচেয়ে ভাল ব্যবস্থা করে গিয়েছিলেন। সরকারী ব্যাংকের আলাদা কোন চেয়ারম্যান ছিল না। ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা ছিলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। সুন্দর ব্যবস্থা। পেশাজীবীরা ছিলেন ব্যাংকের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। যে রাজনীতিকরণের কথা উঠেছে তার শুরু বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের পর। ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে চেয়ারম্যান এবং এমডির পদ দুটোকে আলাদা করা হয়। সামরিক শাসন আমলে এর ফল ভোগ করেছি আমরা। আমাদের অজান্তেই অথবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় সরকারী ব্যাংকগুলোর বোর্ড নির্বাচনে ‘রাজনীতি’ ঢুকে গেছে। শুধু সরকারী ব্যাংকে নয়, বেসরকারী ব্যাংকগুলোতেও ‘রাজনীতি’ ঢুকেছে। ব্যাংকের লাইসেন্সই দেয়া হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। মুখে আমরা বলি ব্যাংকের লাইসেন্স দেয়ার ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। কিন্তু কে না জানে যে, এতে সরকারের ‘অদৃশ্য’ একটা হাত আছে। ব্যাংকের মালিকরা যদি রাজনৈতিক দলের লোক হন তাহলে ‘রাজনীতির’ দোষে দুষ্ট সকল ব্যাংকÑ সরকারী ও বেসরকারী। এটি কাম্য কী কাম্য নয়, তা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক হতে পারে। বিতর্ক হওয়া উচিত। কারণ ব্যাংকগুলো নিজের টাকায় ব্যবসা করে না। টাকা সব আমানতকারীদের। অথচ তা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক নেতারা, রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত লোকেরা। এই অবস্থা আমরা আজ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে বড় হয়েছি। সমস্যাও বাড়ছে। গবর্নর যে সমস্ত সমস্যার কথা বলেছেন সে সমস্ত সমস্যা যেখানেই সরকারী ব্যাংক আছে সেখানেই আছে। বেশি কথা না বলে চীন ও ভারতের উদাহরণ দেয়া যায়। ব্যাংকের মূল সমস্যা শ্রেণীবিন্যাসিত বা খারাপ ঋণ। এর থেকেই জন্ম নেয় বিভিন্ন সমস্যা; ওই সমস্যার মধ্যে পুঁজি স্বল্পতাও আছে। চীন ও ভারতের সরকারী ব্যাংকের সমস্যা আমাদের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। তাই বলে কী আমরা তা সমাধানের চেষ্টা করব না? অবশ্যই তা করতে হবে। এর শুরুটা প্রধান নির্বাহীদের দিয়েই শুরু করতে হতো। প্রধান নির্বাহীদের বিচার একবার হয়েছে, তাও ভুলভাবে। সেটা একজন জেনারেলের আমল ছিল। কিছুসংখ্যক স্বনামধন্য ব্যাংকারদের জেলে পাঠানো হয়, যারা ছিলেন ব্যাংকিং খাতের সবচেয়ে সৎলোক। তার মধ্যে আছেন মুশফেক-উস-সালেহীন, সৈয়দ আলী কবীর, সুলেমান চৌধুরী প্রমুখ। তারা সবাই ছিলেন সততা ও দক্ষতার প্রতীক। তারপর কী কোন প্রধান নির্বাহীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে? আমার জানা নেই। অথচ চোখের সামনেই ভাসে বহু অসৎ প্রধান নির্বাহীর ছবি। যদি প্রধান নির্বাহীদের অনিয়মের জন্য আইনের আওতায় আনা যেত, তাহলে আমার বিশ্বাস লেজে লেজে অনেক পরিচালক ও ব্যাংক কর্মকর্তাও আইনের আওতায় আসত। বিলম্ব হয়ে গেছে। গবর্নর যে কঠোর পদক্ষেপের কথা, এমডিদের শায়েস্তা করার কথা বলেছেন তা বাস্তবায়িত হোক। প্রচুর অনিয়ম তাতে দূর হবে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটিকে, কর্মকর্তাদের নিয়মিত ছুটি, বাধ্যতামূলক ছুটি, অডিটকালীন ছুটিকেও অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। বাকি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা তো আছেই। সেগুলোও চলবে একই সঙ্গে। সাঁড়াশি আক্রমণ দরকার অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতির বিরুদ্ধে। জনগণের টাকার সুরক্ষা দিতেই হবে। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×