ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা জিপিএ-৫ পাওয়া এসব মেধাবী শিক্ষার্থীর অভিভাবকরাও চিন্তিত তাদের;###;সন্তানদের স্বপ্ন পূরণ হবে তো!

দারিদ্র্যের কশাঘাতেও লেখাপড়া ছেড়ে দেয়নি ওরা

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ১৫ আগস্ট ২০১৫

দারিদ্র্যের কশাঘাতেও লেখাপড়া ছেড়ে দেয়নি ওরা

শর্মী চক্রবর্তী ॥ পড়ালেখা করার মতো ক্ষমতা নেই। তবে ইচ্ছা আছে তাদের মনে। শত কষ্টেও মেধাবীরা তাদের পড়ালেখা বাদ দিতে চায়নি। অনেক বাধা বিপত্তির মধ্যেও নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য তারা এগিয়ে গিয়েছে। অনেকের খাবার জুটেনি, বই জুটেনি, পোশাক জুটেনি তারপরও পিছনে ফিরে যায়নি তারা। স্বপ্ন তাদের শিখর ছোঁয়ায়, সেই শিখরের সন্ধানেই এগিয়ে গিয়েছে সবাই। দারিদ্র্যতার মধ্যেও পড়ালেখার বিষয়টি ছেড়ে দেয়নি। তারা কেউ ইটভাটায় কাজ করেছে, কারও বাবা তার ভিটা বাড়ি বি্িক্র করেছে সন্তানের পড়ালেখার জন্য, কেউ দিনমজুর বাবার সন্তান। এদের পক্ষে সংসার চালানোই কষ্টের হয়ে দাঁড়ায়। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় এসব পরিবারের সন্তানদের উচ্চশিক্ষিত করার ক্ষমতা নেই। তাই পরিবারের সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছিল এসব সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে। কিন্তু দরিদ্র মেধাবী শিক্ষার্থীরা আশা ছাড়েনি। নিজেদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করে গেছে। তাদের এই প্রচেষ্টা নিয়ে এসেছে সাফল্য। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় এই মেধাবীরা জিপিএ-৫। তাদের কেউ হতে চায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা, কেউ প্রকৌশলী কেউ আবার ব্যারিস্টার। তবে স্বপ্ন দেখলেও তার বাস্তব রূপ আদৌ দিতে পারবে কিনা এ নিয়ে চিন্তিত শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবার। যদি কোন হৃদয়বান মানুষ এই মেধাবীদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে তাহলে তারা আগামীর পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারবে। এমন আশা শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের। এমন কয়েকজন অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের গল্প পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা। এই প্রতিবেদন লিখতে সহযোগিতা করেছেন কুড়িগ্রামের রাজু মোস্তাফিজ ও নাটোরের কালিদাস রায়। ইটের ভাটায় কাজ করে জিপিএ-৫ পেয়েছে কাজিউল ॥ কুড়িগ্রামের বেলগাছা ইউনিয়নের পলাশবাড়ী পশ্চিমপাড়া গ্রামের দরিদ্র রিকশাচালক হজরত আলীর পুত্র কাজিউল ইসলাম। চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় সে খলিলগঞ্জ স্কুল এ্যান্ড কলেজ থেকে মানবিক বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে কাজিউল বড়। তাই দায়িত্বটাও একটু বেশি। মা কোহিনুর বেগম আলসারে আক্রান্ত। পেটে তিন বেলা ভাত জোটে না তার ওপর চিকিৎসা ও দু’ভাই বোনের লেখাপড়ার খরচ যোগানো অসম্ভব ব্যাপার। সংসারের ঘানি টানতে কাজিউল পড়ালেখার পাশাপাশি নিয়মিত ইট ভাটায় ও মানুষের কৃষি জমিতে দিনমজুরির কাজ করত। অর্থকষ্ট ও খাদ্য কষ্টে এভাবে বেরে ওঠা কাজিউল স্বপ্ন দেখে উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবে। কিন্তু কাজিউলের দুশ্চিন্তা স্বপ্ন পূরণের প্রধান অন্তরায় অর্থের যোগান। বাবা হজরত আলী বলেন, কাজিউল দিনে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটে দিনমজুরের কাজ করত। আর রাত জেগে পড়ালেখা করত। উপোস করতে হতো দিনের পর দিন। বাবা হিসেবে আমার বড় কষ্ট ছেলের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারা। খলিলগঞ্জ স্কুল এ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ রিতা রাণী দেব জানান, এ প্রতিষ্ঠানের একমাত্র জিপিএ-৫ অর্জনকারী শিক্ষার্থী কাজিউল। তার ফরম ফিলাপ, বই কেনা, ফ্রি টিউশনী পড়ানো সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকরা সহযোগিতা করেছে। আগামীতে কাজিউলের উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য প্রয়োজন হৃদয়বান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতা। তাহলে কাজিউল একদিন অনেক ভাল স্থানে পৌঁছাতে পারবে। ভিটা বিক্রি করে ছেলেকে পড়িয়েছেন বাবা ॥ শ্রী হৃদয় কুমার সাহা। তার অদম্য ইচ্ছার কারণে পড়াশোনার খরচ যোগাতে একমাত্র সম্বল বাড়িসহ ৪শতক জমি বিক্রি করে দেয় তার বাবা গোবিন্দ্র চন্দ্র। কুড়িগ্রাম জেলার ভুরুঙ্গামারী উপজেলার কামাতআঙ্গারীয়া গ্রামে ছিল তাদের বাড়ি। এখন আশ্রয় নিয়েছে ভুরুঙ্গামারী হাসপাতাল রোডের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। হৃদয় কুমারের মা শ্রীমতী স্বরস্বতী রানী শ্রবণ প্রতিবন্ধী। বাবা গোবিন্দ চন্দ্র ফুটপাথের চটি দোকানি। গড়ে দিনে ১০০ টাকা আয়। এ টাকায় ৩ জনের সংসারে নুন আনতে পান্থা ফুরানোর অবস্থা। তার ওপর লেখাপড়ার খরচ যোগানো তো অসম্ভব ব্যাপার। তারপরও গোবিন্দ্র ছেলের স্বপ্ন পূরণে ভিটে বিক্রি করে। পড়ালেখায় ভাল ছিল হৃদয়। অক্লান্ত পরিশ্রমে সে চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষায় ভুরুঙ্গামারী ডিগ্রী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে। তার স্বপ্ন প্রকৌশলী হওয়ার। এর আগে এসএসসিতেও সে জিপিএ-৫ পেয়েছিল। বাবা শ্রী গোবিন্দ্র চন্দ্র জানান, হৃদয় কুমার সাহা তাদের একমাত্র সন্তান। পিতা হয়ে ছেলের কোন সখ আল্লাদ পূরণ করতে পারছেন না। আয় রোজগার নেই বললেই চলে। তার ওপর স্ত্রীর অসুস্থতা। তাই বাধ্য হয়ে ২০১২ সালের শেষ দিকে ৪শতক জমিসহ বাড়ি বিক্রি করে দেন। ছেলের লেখাপড়ার ব্যয় নির্বাহের জন্য। এখন তিনি ভূমিহীন। আশ্রিত অন্যের বাড়িতে। তার এখন একটি চিন্তা আগামীতে ছেলের লেখাপড়া চালাবেন কিভাবে। তিনি ছেলের প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন পূরণে দেশের হৃদয়বান দানশীল ব্যক্তিদের সহযোগিতা কামনা করেন। পাশাপাশি তিনি হৃদয়ের পড়ালেখার ভার সরকারকে নেয়ার দাবি জানান। শ্রী হৃদয় কুমার সাহা জানান, অন্যের অনুগ্রহে চলছে জীবন। ফলাফলে সবাইকে চমকে দিতে পারলেও উচ্চ শিক্ষার পথ অন্ধকারাচ্ছন্ন। এসব ভাবলেই কান্না আসে। কেন যে গরিব ঘরে জন্ম হলো? তাই হয়ত গরিবদের ইচ্ছার কোন মূল্য নেই। আক্ষেপ থাকলেও কৃতজ্ঞতা আছে অনেকের প্রতি। জানান, শিক্ষক এবং বন্ধুদের সহযোগিতায় এতদূর পথ আসতে পেরেছেন। এছাড়া এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ায় ‘সবার জন্য শিক্ষা’ নামে একটি স্থানীয় বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। তিনি তার স্বপ্ন পূরণে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন। কারণ এখন পরিবারের নেই অন্য কোন সম্পদ। বাবারও নেই সামর্থ্য। কাজেই উচ্চ শিক্ষার পথে আর্থিক বাঁধাই এখন তার দুশ্চিন্তার মূল। দিনমজুর বাবার মেয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ॥ মনে অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর সাধনা থাকলে অনেক অসম্ভবকে জয় করা যায়। কোন বাধায় তখন বাধা মনে হয় না। শত বাধা-বিপত্তি, প্রতিকূলতা জয় করে অনেকেই সফলতা অর্জন করেছেন। হেসেছেন বিজয়ের হাসি। জীবন এদেরকে স্বাগত জানায়। এদেরই একজন সালমা খাতুন। সে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছে। দারিদ্র্যতার নিষ্ঠুর কশাঘাত তার অদম্য ইচ্ছাশাক্তিকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। তাই নিজে প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ যোগায় সে। নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে সবার মুখ উজ্জ্বল করেছে দরিদ্র মেধাবী এ শিক্ষার্থী। সালমা নাটোর সদর উপজেলার আগদীঘা খাঁ পাড়া গ্রামের ছলেমান আলীর মেয়ে। তিন ভাইবোনের মধ্যে সে সবার ছোট। দিনমজুর ছলেমান আলীর শুধু ভিটে বাড়ি ছাড়া আর কোন জমিজমা নেই। তার স্বল্প আয় দিয়ে পরিবারের নিত্যপ্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতেই তাকে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয়। সালমা বলেন, সদর উপজেলার আগদীঘা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ ৪.৮৮ পেয়ে সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। মাঝেমধ্যেই না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে। হাইস্কুলে পড়াকালীন সময়ে অর্থাভাবে প্রাইভেট পড়তে পারেনি। সালমার অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর মেধার পরিচয় পেয়ে পার্শ্ববর্তী স্কুলশিক্ষক আজিজুল ইসলাম তাকে বিনা খরচায় প্রাইভেট পড়াতে শুরু করেন। এইচএসসিতে বিজ্ঞান নিয়ে লেখাপড়ার ইচ্ছা থাকলেও শুধুমাত্র পারিবারে আর্থিকভাবে অসচ্ছলতার কারণে সে সদর উপজেলার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি হতে বাধ্য হয়। এখান থেকেই কোন প্রাইভেট না পড়েও সে এবার এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে সফলতার সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়। সালমা ভবিষ্যতে ব্যারিস্টার হতে চায়। তবে অর্থাভাবে তার সে স্বপ্ন আদৌ পূরণ হবে কিনা এ নিয়ে সালমা অনেকটাই শঙ্কিত।
×