ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দ্রুত ধনী হতে গিয়ে সর্বস্বান্ত

সোনার হরিণের নামে প্রতারণা

প্রকাশিত: ০৬:১০, ১৫ আগস্ট ২০১৫

সোনার হরিণের নামে প্রতারণা

সমুদ্র হক ॥ বগুড়ার পশ্চিমাংশের কয়েকটি এলাকায় ‘সোনার হরিণের’ মায়াজালে পড়ছে এক শ্রেণীর লোভাতুর মানুষ। দেশের বিভিন্ন স্থানের এইসব মানুষ দুপচাাঁচিয়া, কাহালু উপজেলার কিছু গ্রাম এবং জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলার দিকে যাওয়া সড়কের কয়েকটি পয়েন্টর ফাঁদে সহজেই পা ফেলে। মাকড়সার জালের মতো বিছানো এই ফাঁদ এতটাই মায়ায় ভরানো যে লোভ ছিটকে পড়ে। দ্রুত ধনী হওয়ার রিপুতারিত মানুষ ফাঁদে আটকা পড়ে বড় অঙ্কের টাকা খুইয়ে হয়ে পড়ে পাগলপ্রায়। শেষ পর্যন্ত কারও জায়গা হয় মানসিক হাসপাতালে, কেউ স্থানীয়ভাবে পাগল আখ্যায়িত হয়ে সাধারণের কৌতুক ও করুণার পাত্র হয়। কেউ সর্বস্বান্ত হয়ে পথে বসে টাকার শোকে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে চিরবিদায় নেয়। বগুড়ার ওই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে কথিত সোনার পুতুল বেচাকেনার এমনই কারবার চলছে। দুপচাঁচিয়া উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ১৮ গ্রাম কাহালু উপজেলার ৬টি গ্রাম, দুচাঁচিয়া থেকে আক্কেলপুর যাওয়ার পথে অন্তত ৬টি পয়েন্টকে চিহ্নিত করা হয়েছে। দুপচাঁচিয়ার জিয়ানগর ইউনিয়নের সোনারপাড়া লক্ষ্মীম-প, গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চৌমুহনী, পাচোষা, খিহালী, আতুঞ্জা, জিয়ানগর, গুনাহার ইউনিয়নের গুনাহার, তালুচ, বেড়াগ্রাম, ভা-রিয়া, ঝাজিরা, কারু, ছাতামি, হাপুনিয়া, চামরুল ইউনিয়নের চামরুল কাহালুর ৬টি গ্রাম জয়পুরহাট সড়কের ৬ টি পয়েন্টে হর হামেশই প্রতারণার ঘটনা ঘটছে। সচেতনতার অভাব এবং মানুষের লোভকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর প্রতারক চক্র সোনার পুতুলের নামে তামা ও কুমোরদের বাড়ি থেকে বানানো মাটির পুতুলকে বিশেষ কায়দায় সোনালী রং করে ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছে। সোনার হরিণের এই পুতুলের খবর দেয়া থেকে শুরু করে বিক্রি করা পর্যন্ত বিশেষ নেটওয়ার্কে নিয়োজিত থাকে একটি পুরো টিম। এ ধরনের বহু টিম গজিয়ে উঠেছে। এই টিমওয়ার্ক এক চেনে বাঁধা। যার নেতৃত্বে রয়েছে প্রভাবশালী গডফাদার। নানা ছদ্মাবরণের এই টিমের সদস্যরা দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ায়। তারপর শিকার ধরে অভিনয় শৈলীতে পটিয়ে ফেলে। তবে এরা জ্বীনের বাদশার মতো নয়, ছুচকো প্রতারক নয়। এদের বাস গ্রামে এবং একাডেমিক শিক্ষা কম হলেও ‘ভিলেজ পরিটিক্স’ রপ্ত করে এরা এতটাই পাকা হয়েছে যে মস্তিষ্কে সব সময় ‘ইল মোটিভ’ কাজ করে। এক মিথ্যাকে ফলো দিয়ে দশ মিথ্যা বলে এবং অভিনয় শৈলী প্রয়োগ করে শিকারকে বিশ্বাসের মধ্যে এনে মাকড়সার মতো জালের সামান্য কোণায় আটকাতে পারলেই আর রক্ষে নেই। মাকড়সা যেমন দূর থেকে রক্ত চুষে খায় এরাও তেমনই ভাবে কলকাঠি নেড়ে মায়ার হরিণ (নকল পুতুল) বিক্রি করে। এই পুতুল কারবারীদের ফাঁদে পড়ে কত লোক জায়গা জমি, বসত ভিটা, সোনার গহনা, মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রি করেছে, ধার দেনা করে পথে বসেছে সেই হিসাব নেই। সব হারিয়ে সহজে কেউ মামলা করতে চায় না। কালেভদ্রে কিছু মামলা হলেও অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে বের হয়ে ফের মাঠে নামে। কখনও মামলার বাদীকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয়। দূরদূরান্তের প্রতারিত হওয়া মানুষ কখনও ভয়ে মামলা চালাতে রাজি না হওয়ায় এবং খরচ জোটাতে না পাড়ায় ফিরে যায়। এই সুযোগটিও কাজে লাগায় ওই চক্র। প্রতারিত হওয়া এমনই একজন নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আলীপুর গ্রামের খালেদ বিন আলী। তিনি খবর পান বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় সস্তায় সোনার পুতুল বিক্রি হয় গোপনে। খালেদ বিন আলী তার ছোট ভাই জাহিদ বিন আকন্দ ও বন্ধু বিপ্লব শিকদারকে নিয়ে দুপচাঁচিয়া যান। বাসস্ট্যান্ডে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে পূর্বের পরিচয়ের সূত্রে গুনাহার ইউনিয়নের তালুচ গ্রামের নুরুল ইসলামের বাড়িতে যান। গোপন ব্যবসায়িক কথাবার্তার পালায় ৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়। পুতুল দেখার পর কিছুটা সন্দেহ হয়। পরে আর উপায় থাকে না। কৌশলে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনায় মামলা হয়। মূল হোতারা গ্রেফতার হয় না। আরেকটি ঘটনা- সিরাজগঞ্জের একটি পরিবার ঘটকের মাধ্যমে বিয়ে ঠিক করে দুপচাঁচিয়ার এক পরিবারের মেয়ের সঙ্গে। বিয়ের পাকা কথা হওয়ার পর মেয়ের বাবা জানায় তার তেমন অর্থ নেই তবে একটি সোনার পুতুল আছে। পুতুলের দাম ৪ লাখ টাকা ধার্য হয়ে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ ও এক লাখ টাকা হবু জামাইকে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। বিশ্বাসের ওপর ভর করে হবু বরের মা পুতুল কিনে মনিকারের কাছে পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেলে বুঝতে পারে সর্বনাশ যা হওয়ার তা হয়েছে। তামার পুতুলকে সোনার পুতুল বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। বিয়ে ভ-ুলের পর এই ঘটনায় মামলা হয়। বর পক্ষ নানাভাবে চেষ্টা করেও কিনারা করতে পারে নি। ভয়ভীতি প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার পর পিছু হটে যায়। এ ধরনের বহু ঘটনা আছে।
×