ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অবকাঠামো উন্নয়নে ৫শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব

বিমানে তেল সরবরাহে বেসরকারী খাতও এগিয়ে আসছে

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ১৬ আগস্ট ২০১৫

বিমানে তেল সরবরাহে বেসরকারী  খাতও এগিয়ে আসছে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ উড়োজাহাজে তেল সরবরাহ কাজে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতও এগিয়ে আসতে চাইছে। এ ব্যাপারে দেশের আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরগুলোতে ৪শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগে জ্বালানি তেল সরবরাহের আধুনিক অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছে একটি বেসরকারী কোম্পানি। এ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোকে আর প্রতিবেশী দেশে গিয়ে রি-ফুয়েলিং করতে হবে না। এতে দেশের এ্যাভিয়েশন ফুয়েলের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে এবং বেড়ে যাবে সরকারের রাজস্ব আয়ও। বিশ্লেষকরা বলছেন, পৃথিবীর অনেক দেশেই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাত উড়োজাহাজে তেল সরবরাহ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যদি একটি সঠিক নীতিমালার অধীনে বেসরকারী খাতকে অনুমতি দেয়া হয়। তবে এক্ষেত্রে মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকতে হবে। বর্তমানে এ ব্যবস্থা না থাকায় বাংলাদেশ এ খাতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ হারাচ্ছে। জানা যায়, বর্তমানে বাংলাদেশে একটি মাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠান পদ্মা অয়েল কোম্পানি দেশী ও বিদেশী উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে আসছে। উন্নত প্রযুক্তির অভাব ও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে এ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সব ধরনের বিদেশী উড়োজাহাজে তাদের চাহিদা মতো জ্বালানি তেল, লুব্রিকেটিং অয়েল ও গ্রিজ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতে বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় একদিকে যেমন প্রতিযোগিতামূলক সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে, অন্যদিকে দেশের চাহিদা অনুযায়ী ‘ক্যাপাসিটি বিল্ড-আপ’ সম্ভব হয়েছে। কিন্তু উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের প্রস্তাব গুরুত্ব পাচ্ছে না। জানা যায়, বর্তমানে কিছু সংখ্যক এয়ারলাইন্স ছাড়া স্বনামধন্য বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশ থেকে জ্বালানি তেলের সরবরাহ নিচ্ছে না। বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের আধুনিক তেল সরবরাহের অবকাঠামো, মজুদ ও সঠিক মান সম্পন্ন ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। ফলে বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেজর অয়েল কোম্পানিগুলো তাদের গ্লোবাল তেল সরবরাহ নেটওয়ার্কের আওতার বাইরে রয়েছে। সাধারণত বড় বড় এয়ারলাইন্সগুলো তার তেল সরবরাহ চুক্তি আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারণ করে থাকে এবং সে চুক্তিগুলোর মাধ্যমে মেজর অয়েল কোম্পানিগুলো তাদের অনুমোদিত বিমানবন্দর থেকে সঠিক মানের জ্বালানি তেল সরবরাহ নিশ্চিত করে। এ ধরনের অনুমোদনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, মজুদ ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সরবরাহ পদ্ধতি ও ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। এ ব্যবস্থা গড়ে তুললে বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলোও ‘এ্যাভিয়েশন ব্যাঙ্কার সাপ্লাই’ এয়ারপোর্ট হিসেবে স্বীকৃতি পাবে। দেশের বিমান বন্দরগুলোতে বর্তমানে উড়োজাহাজের বিভিন্ন ধরনের ইঞ্জিনে ব্যবহৃত জ্বালানি তেল ও লুব্রিকেন্টসের মজুদ ব্যবস্থা না থাকায় চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হচ্ছে। তা সত্ত্বেও উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহের চাহিদা ২০০৮-০৯ সালে ২,৫৩,৮০১ মেট্রিক টন থেকে ২০১৩-১৪ সালে ৩,২৩,৩২৭ মেট্রিক টনে উন্নীত হয়েছে, যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধি ৫.৪৮ শতাংশ। পক্ষান্তরে লুব্রিকেন্টস ও গ্রিজ সরবরাহ শূন্যের কোঠায় রয়ে গেছে। বর্তমানে বিভিন্ন ডিপো ও বিমানবন্দরসহ সারাদেশে জেট এ-১ এর সর্বমোট মজুদ ধারণক্ষমতা ৫০,৮০২ মেট্রিক টন। কিন্তু দেশে বর্তমানে জেট এ-১ এর বার্ষিক গড় চাহিদা প্রায় ৩,৪৫,০০০ মেট্রিক টন। হজ মৌসুমে জেট এ-১ এর মাসিক চাহিদা ৩৫-৪০ হাজার মেট্রিক টনে বৃদ্ধি পায়। কাজেই দেখা যাচ্ছে, দেশের বর্তমান চাহিদার তুলনায় জেট এ-১ এর মজুদ ধারণ ক্ষমতা নিতান্তই অপ্রতুল। পক্ষান্তরে, চট্টগ্রামে পদ্মার প্রধান স্থাপনায় মজুদ ধারণক্ষমতা কম থাকার কারণে বিপিসির পক্ষে স্বতন্ত্রভাবে জেট ফুয়েল আমদানির করা সম্ভব হচ্ছে না। বিপিসি ডিজেলের সঙ্গে প্রতি পার্সেলে ৯ হাজার মেট্রিক টন করে জেট ফুয়েল আমদানি করছে। যার কারণে বিপিসিকে স্বল্প বিরতিতে জেট ফুয়েল আমদানি করার ঝুঁকি নিতে হচ্ছে এবং অপরদিকে একই জাহাজে ‘কম্বিকার্গো’ হিসেবে জেট ফুয়েল আমদানি করার কারণে জাহাজে সংমিশ্রন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় এবং সঠিক মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। অতীতে এ ধরনের সংমিশ্রনজনিত সমস্যার কারণে আমদানি কার্গো ফেরত দেয়া হয়েছে, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে আমদানিকৃত জেট ফুয়েল ’ডাউন গ্রেড’ করে কেরোসিন হিসেবে বাজারে বিক্রি করা হয়েছে। এ ধরনের সীমাবন্ধতার কারণে পদ্মা অয়েল কোম্পানি চাহিদা অনুযায়ী যথাযথভাবে উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। অবকাঠামোগত অপর্যাপ্ততার কারণে বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপিসি কর্তৃক আমদানিকৃত তেল একই জাহাজে সরবরাহ গ্রহণ করার ফলে সরবরাহ মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কাজেই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাতে উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহের অবকাঠামো ও আন্তর্জাতিক মানের সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতি আনতে পারে। প্রতিবেশী দেশসমূহসহ সকল দেশে সরকারী তেল কোম্পানির পাশাপাশি বেসরকারী তেল কোম্পানি উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করে আসছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৩টি সরকারী তেল কোম্পানির পাশাপাশি রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও এসার লিমিটেড বর্তমানে উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে। বহুজাতিক কোম্পানি এয়ার বিপির অংশগ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। পাকিস্তানে সরকারী তেল কোম্পানি পাকিস্তান স্টেট অয়েলের পাশাপাশি বহুজাতিক কোম্পানি শেল এ্যাভিয়েশন ও সেভরন এ্যাভিয়েশন উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে। একইভাবে, থাইল্যান্ডে সরকারী ও বেসরকারী ৪টি, সিঙ্গাপুরে ৪টি, হংকংয়ে ৪টি ও মালয়েশিয়ায় একাধিক তেল কোম্পানি উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ করছে। পৃথিবীর সকল দেশে তেল কোম্পানিগুলো বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে জ্বালানি তেল সরবরাহ ছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যমান মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সরবরাহ মূল্য সমন্বয় সাধন করে থাকে। এ নীতিমালা অনুসরণ করলে আমাদের দেশেও এ্যাভিয়েশন ফুয়েল সরবরাহ প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাবে। এতে বিদেশী উড়োজাহাজ ছাড়াও বাংলাদেশ বিমান ও বেসরকারী বিমানগুলো প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে জ্বালানি তেল ক্রয় করতে পারবে। এতে ভ্যাট ও ট্যাক্স বাবদ সরকারের রাজস্ব আয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে বড় বড় বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে কার্গোপ্লেন ও হেলিকপ্টার ব্যবহারও ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশকে মধ্য-আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত করার লক্ষ্যে যে সমস্ত অবকাঠামো ও সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন তার মধ্যে বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলোতে অবকাঠামো উন্নয়ন, সেবার মান উন্নয়ন ও সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বর্তমানে বাংলাদেশে উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ ও চাহিদা প্রায় ৫-৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ হারে আগামী ২০২০-২১ সালে এ্যাভিয়েশন ফুয়েলের চাহিদা ৪ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০৩০-৩১ সালে প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হবে। দেশের অন্যান্য খাতের উন্নয়নের সাথে এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ না হলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যহত ও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়বে। শুধু একটি সরকারী সংস্থার পক্ষে এ খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ওমেরা ফুয়েলস নামে একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ৪শ’ থেকে ৫শ’ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে জ্বালানি তেলের আধুনিক সরবরাহ অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। যা বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রণালয়ে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে। এ প্রতিষ্ঠানে সরকারের ২৫ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুত ও জ্বালানির অন্যান্য খাতের ন্যায় উড়োজাহাজে জ্বালানি তেল সরবরাহ কার্যক্রমে বেসরকারী খাতের অংশগ্রহণের যে কোন উদ্যোগকে তিনি ইতিবাচকভাবেই দেখবেন। এ বিষয়ে ওমেরা ফুয়েলস্ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ মালিক জানান, তারা সরকারী সংস্থার পাশাপাশি দেশের সবগুলো বিমানবন্দরে জ্বালানি তেল সরবরাহের সর্বাধুনিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে চান। বিশেষ করে এমন একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে যাতে বিশ্বের যে কোন উন্নতমানের উড়োজাহাজের ইঞ্জিনের চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেলের যথাযথ সরবরাহ পাবে। এর ফলে আর কোন বিদেশী এয়ারলাইন্সকে প্রতিবেশী কোন দেশে গিয়ে রি-ফুয়েলিং করতে হবে না। তিনি বলেন, ‘এ নতুন অবকাঠামো হবে ডিজিটাল নির্ভর যেখানে উড়োজাহাজ অবতরণের আগেই এর চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ প্রস্তুত থাকবে এবং সেবার মান হবে আন্তর্জাতিক মানের। এর ফলে বিশ্বের বড় বড় তেল কোম্পানির কাছে বাংলাদেশের বিমান বন্দরগুলো এ্যাভিয়েশন ফুয়েল বাঙ্কার এয়ারপোর্ট হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাবে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের এ্যাভিয়েশন ফুয়েলের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকাররের রাজস্ব আয়ও বৃদ্ধি পাবে।’ এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিসির সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তাদির আলী বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক দেশেই সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী খাত উড়োজাহাজে তেল সরবরাহ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। যদি একটি সঠিক নীতিমালার অধীনে বেসরকারী খাতকে অনুমতি দেয়া হয়, তাতে কোন অসুবিধা দেখি না।’ তবে এক্ষেত্রে মান ও মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সরকারের হাতেই থাকা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
×