ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভা

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন যে কোন মূল্যে সফল করতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ১৭ আগস্ট ২০১৫

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন যে কোন মূল্যে সফল করতে হবে ॥ প্রধানমন্ত্রী

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সুখী-সমৃদ্ধ, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণে নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে আমি প্রস্তুত। যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, আমি তাতে পরোয়া করি না। জীবন দেয়ার ও কেড়ে নেয়ার মালিক আল্লাহ। আল্লাহ ছাড়া আমি কাউকে ভয় পাই না। আল্লাহ ছাড়া কারও কাছে কোনদিন মাথানত করিনি, করবও না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রক্ত দিয়ে বাংলার মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর সেই আরাধ্য কাজ ও স্বপ্ন যে কোন মূল্যে সফল করতেই হবে। বাঙালী জাতির ভাগ্য আমাদের পরিবর্তন করতেই হবে। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবেই। রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে অনেক ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। মা-বাবা, ভাইসহ সবাইকে হারিয়েছি। আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমার একটাই লক্ষ্য দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে যে বাঙালী জাতির মাথা হেঁট করে দেয়া হয়েছিল, সেই বাঙালী জাতিকে বিশ্বের দরবারে আবারও মাথা উঁচু করে দাঁড় করানো। দেশের মানুষ উন্নত জীবন পাবে, ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে উঠবেÑ এ লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সভায় আরও বক্তব্য রাখেনÑ সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, এমএ আজিজ, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, মাহবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, আহমদ হোসেন ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। ড. হাছান মাহমুদ ও অসীম কুমার উকিলের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বঙ্গবন্ধুর স্মরণে কবিতা আবৃত্তি করেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার শিমুল মোস্তফা। প্রধানমন্ত্রী ১৫ আগস্টের ভয়াল হত্যাযজ্ঞ এবং পরবর্র্তী হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির মাধ্যমে দেশকে পিছিয়ে দেয়ার ঘটনা তুলে ধরে বলেন, ’৭৫-এর পর দেশকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল? পৃথিবীর কোন সভ্য দেশের ইতিহাসে নেই যে, খুনীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও পুরস্কৃত করা হয়। কিন্তু এ দেশে তাই হয়েছে। ’৭৫ পরবর্তী জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার তাই করেছে। কিন্তু আমরা বঙ্গবন্ধুর খুনী, নারী-শিশু ও অন্তঃসত্ত্বা নারীকে হত্যাকারীদের বিচার করেছি, বিচারের রায় কার্যকরের মাধ্যমে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেছি। আবেগজড়িত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র ১৫ দিন আগে সবাইকে রেখে স্বামীর কর্মস্থলে গিয়েছিলাম। কিন্তু ১৫ দিন পর সব শেষ হয়ে গেল। মানুষ একটি শোক সইতে পারে না। আর আমরা দুই বোন বাবা-মা ও তিন ভাইসহ পরিবারের ১৮ সদস্যকে হারিয়েছি। আমাদের তখন কেউ ছিল না। নিঃস্ব-রিক্ত এমনকি বাড়ি হারা। যে বাঙালী জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, অনেক কষ্ট ভোগ করেছেন, যে বাঙালী জাতিকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন, যে বাঙালী জাতিকে বঙ্গবন্ধু নিজের সন্তানের চেয়েও বেশি ভালবাসতেন, দুর্ভাগ্য সেই বাঙালী জাতির হাতেই বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিতে হয়েছে। সারাবিশ্বের কাছে বিজয়ী জাতির উঁচু মাথা হেঁট করে দেয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ৬টি বছর আমাদের দেশে আসতে দেয়া হয়নি। জনগণের শক্তিতে দেশে ফিরলেও জেনারেল জিয়া আমাকে আমার বাড়িতে যেতে দেননি। বাড়ির সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমাকে নিহত বাবা-মাসহ স্বজনদের জন্য দোয়া-মোনাজাত করতে হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে এখন একটি হত্যা হলেই অনেকে অনেক কথা বলেন, আমার কাছে বিচার চান। কিন্তু ১৫ আগস্ট পিতা, মাতা, ভাই, অন্তঃসত্ত্বা ভাইবৌ, এমনকি রাসেলসহ বেশ কয়েকজন শিশুকেও হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু আমরা বিচার পাইনি। তখন অনেকেই কথা বলেননি। বরং ওই সময় অনেককেই খুনীদের সমর্থন দিয়ে তাদের নামের পাশে নানা বিশেষণ লাগিয়ে দিতেও দেখেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচার না করে উল্টো নানাভাবে পুরস্কৃত ও পুনর্বাসন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ সময় দেশে হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলেছে। ১৮-১৯টি ক্যুর মাধ্যমে হাজার হাজার সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিককে হত্যা করা হয়েছে। ’৮৬ সাল পর্যন্ত কার্ফু দিয়ে দেশ চালানো হয়েছে। মানুষের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার পর্যন্ত কেড়ে নেয়া হয়েছিল। তিনি বলেন, শুধু খুনীদের পুরস্কৃত করাই নয়, যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দিয়ে মন্ত্রী-এমপি, উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান। নাগরিকত্ব হারানো স্বাধীনতাবিরোধীদের দেশে ফিরিয়ে আনা, তাদের রাজনীতি করার ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, শুধু জিয়াই নন, পরবর্তীতে এরশাদও খুনীদের দল করার সুযোগ করে দেন, খুনী ফারুককে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী পর্যন্ত হওয়ার সুযোগ দেন। ইত্তেফাকের ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সঙ্গে খুনী ফারুক-হুদারা দল গঠন করে। পরবর্তীতে খালেদা জিয়া খুনী রশিদ-হুদাকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে এমপি বানিয়ে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসান। এ অপরাধে দেশের জনগণ ৩০ দিনেও খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় থাকতে দেননি, আন্দোলনের মাধ্যমে পদত্যাগে বাধ্য করেছে। যেমনটি এরশাদকেও করেছিল দেশের জনগণ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১টি বছর দেশে অবৈধ ক্ষমতাকে বৈধ করতে এলিট শ্রেণী তৈরি করা হয়েছে। যুবকদের হাতে অস্ত্র ও মাদক তুলে দিয়ে বিপথে চালানো হয়েছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতা একদিনে আসেনি। এ জন্য বঙ্গবন্ধুকে ২৪টি বছর লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের স্বাধীনতা, স্বাধীন ভূখ-, স্বাধীন পতাকা দিয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর কোন চাওয়া-পাওয়া ছিল না। তাঁর একটাই চাওয়া ছিল যে, দেশের মানুষ পেট ভরে ভাত খাবেন, শান্তিতে থাকবেন, কেউ গৃহহীন থাকবে না, সবাই চিকিৎসা পাবেন। তিনি বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ করতেই দেশের জনগণের জন্য কাজ করে যাচ্ছি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা শান্তিময়, উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবই। ইতোমধ্যে আমরা নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দেশ কখনও নিম্নে থাকবে না, আমরা উন্নত আয়ের দেশে পরিণত হবই। সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ একটি দেশ। সেই দেশের এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন কর্ণধার জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। যে কোন মূল্যে প্রত্যেক নেতাকর্মীকে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে। জাতির জনকের সঙ্গে রাজনীতি করেছি, হয়ত আজকেই আমার শেষ কথা বলা হতে পারে। তাই মহিলাদের বলছি, বঙ্গমাতা যেভাবে জাতির জনককে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, দুর্দিনে দলকে সংগঠিত করেছেনÑ আপনাদেরও তাই করতে হবে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধুর রক্ত কথা বলে। তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে এসে আওয়ামী লীগের হাল না ধরলে জাতির জনকের হত্যাকারীদের বিচার করা সম্ভব হতো না। তার নেতৃত্বে আমরা এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, খালেদা জিয়ার মিথ্যা জন্মদিন পালনের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়েছে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ছিলেন। জিয়াই ছিলেন জাতির জনকের আসল খুনী। সেই খুনীদের খুশি করতেই জাঁকজমকপূর্ণভাবে খালেদা জিয়া মিথ্যা জন্মদিন পালন করেছেন। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, খালেদা জিয়া বলেছেন সরকার পতন হবে। তিনি কিভাবে জানলেন? সংবিধানে লেখা আছে, যদি কেউ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে বা নির্বাচিত সরকাকে হটিয়ে ক্ষমতায় বসে তাহলে মৃত্যুদ-ই একমাত্র শাস্তি। গণঅভ্যুত্থান হলে সরকার পতন হবে। দেশে একটি নির্বাচিত সরকার আছে। সংবিধান আছে, সংসদ আছে। সুপ্রীমকোর্ট আছে। তারপরও খালেদা জিয়া কিভাবে বলে দুই মাসের মধ্যে সরকার পতন হবে। খালেদা জিয়াকে আজকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হোক, কোথায় থেকে তিনি এসব কথা পেলেন, কিভাবে জানলেন। এভাবে দেশ চলতে পারে না। তারা ষড়যন্ত্র করবে আর আমরা উদার হব, তা হয় না। কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বলেন, জিয়া হত্যার বিচার এখনও হয়নি, শুধু সেনা বিদ্রোহের বিচার হয়েছে। খালেদা জিয়া ও তার পুত্র তারেক জিয়ারা এখন পর্যন্ত জিয়া হত্যার বিচার চায়নি। এ কারণে চট্টগ্রামের আদালতে জিয়া হত্যা মামলাটি এখনও বহাল রয়েছে। তারেক জিয়া এখন পর্যন্ত তার বাবার হত্যারস্থল দেখতে যায়নি। বিএনপিরই এক সময়ের নেতা কর্নেল অলি বলেছেন, মা ভাল হলে ছেলে কিভাবে খারাপ হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আজকে দেশের গণতন্ত্র নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাবা-মাসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা পিতা হত্যার বিচার চাইতে গিয়েও যখন পায়নি, তখন সেই সব উদ্বিগ্নব্যক্তিরা কোথায় ছিলেন? আসলে তারা গণতন্ত্র চায় না। গণতন্ত্র পরিবেশ ভাল লাগে না। এদের ভাল লাগে অবৈধ ও অসাংবিধানিক সরকার। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, আজকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের শপথ নিতে হবে, আওয়ামী লীগ থেকে যেন আর কোনদিন খন্দকার মোশতাক বের না হয়। দলের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীকে তাজউদ্দীন, নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের মতো ত্যাগী ও পরীক্ষিত হতে হবে। প্রয়োজনে জীবন দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক বলেন, জাতির জনকের ব্যক্তিগত কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না। তার চাওয়া-পাওয়া ছিল বাঙালীর মুক্তি। সেই মুক্তি তিনি দিয়ে গেছেন। কিন্তু বাংলার কুলাঙ্গাররা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যে লক্ষ্য নিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন, সেই লক্ষ্য নিয়েই তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
×