ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুরাইয়াকে ঢামেকে মায়ের কেবিনে স্থানান্তর

নাজমার খুশির শেষ নেই দীর্ঘ অপেক্ষার পর কাছে পেলেন মেয়েকে

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১৭ আগস্ট ২০১৫

নাজমার খুশির শেষ নেই  দীর্ঘ অপেক্ষার পর কাছে  পেলেন মেয়েকে

শর্মী চক্রবর্তী ॥ বেলা ১১টা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুরাতন ভবনের ৪৮ নাম্বার কেবিন। সেখানে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলের নাজমা বেগম। এক অজানা আনন্দে অস্থির হয়ে ছিলেন তিনি। বেডে বসতে পারছেন না। কেবিনের এপাশ থেকে ওপাশ হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারছেন না। আর কিভাবেই বা স্থির থাকবেন; ২৪ দিন ধরে যে অপেক্ষায় ছিলেন সেই ক্ষণ অনেক নিকটে। তার কলিজার টুকরা আজ তার কাছে আসবে। আগে থেকেই তিনি জানতেন রবিবার সকালে তার কাছে দেয়া হবে তার সন্তান সুরাইয়াকে। এটা শোনার পর থেকেই মায়ের মনে আর তর সইছিল না। তাই সকাল থেকে অপেক্ষায় ছিলেন সন্তানের। সেই অপেক্ষার অবসান ঘটে রবিবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে। দীর্ঘ ২৪ দিন অপেক্ষার পর অবশেষে মায়ের কেবিনে হস্তান্তর করা হলো গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়াকে। সেখানে এখন মায়ের কোলের পরশ পাবে শিশু সুরাইয়া। তবে এখন তা কয়েক ঘণ্টার জন্য নয়। দীর্ঘ সময়ের জন্য। রবিবার দুপুর পৌনে ১টায় ২৫ দিন বয়সী সুরাইয়াকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (এনআইসিইউ) থেকে নিয়ে পুরাতন ভবনের কেবিনে চিকিৎসাধীন তার মা নাজমা বেগমের কোলে তুলে দেয়া হয়। সুরাইয়াকে হস্তান্তর করেন শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান, শিশুটির উন্নত চিকিৎসায় গঠিত ১০ সদস্যবিশিষ্ট মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ও এনআইসিইউ-নবজাতক ওয়ার্ড নিউনেটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা ও তার মায়ের চিকিৎসকরা। এতদিন এনআইসিইউতে গিয়ে সন্তানকে দেখে আসতেন এবং দুধ পান করাতেন নাজমা বেগম। ইচ্ছে থাকলেও বেশি সময় থাকতে পারতেন না। কিন্তু এখন আর এমনটা হবে না। সারাক্ষণ মেয়েকে কাছে নিয়ে থাকতে পারবেন। এজন্য তার আনন্দের যেন শেষ নেই। কেবিনে সুরাইয়াকে পৃথক একটি ছোট শয্যায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। বাবা বাচ্চু ভূঁইয়াও মেয়েকে কাছে পেয়ে খুবই আনন্দিত। সকাল থেকেই ব্যস্ত ছিলেন তিনি নিজেও। কেবিনের ভেতর ঠিকঠাক করছিলেন। কোথাও যেন কোন ময়লা না থাকে। কারণ এতে সুরাইয়ার ইনফেকশন হতে পারে। তিনি বলেন, এতদিন আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে। এত ছোট শরীরে এত ওষুধ পড়েছে। বড়রাই সহ্য করতে পারে না। আর ও তো শিশু। তাই আমি চাই না আমার সোনামণি আর কোন কষ্ট পাক। এতদিন পর আমরা তাকে কাছে পাচ্ছি। এখন তাকে আমাদের কাছেই রাখতে চাই। তিনি বলেন, কোনদিন ভাবিনি গর্ভাবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে আমার স্ত্রী ও সন্তান বেঁচে থাকবে। আল্লাহর কাছে কোটি কোটি শোকরিয়া, ডাক্তার থেকে শুরু করে সাংবাদিক ভাইদের কাছেও আমি ঋণী। চিকিৎসকদের ধন্যবাদ দিয়ে বাচ্চু ভুইয়া বলেন, ঢাকা মেডিক্যালের ডাক্তারদের চিকিৎসায় আজ আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তাদের ঋণ আমি কখনও শোধ করতে পারব না। নাড়ি ছেঁড়া ধনকে কাছে পেয়ে আনন্দের শেষ নেই মা নাজমা বেগমের। মেয়ের জন্য নতুন জামা, খেলনা নিয়ে অপেক্ষায় বসে ছিলেন মা। এতদিনের অপেক্ষার পর মেয়েকে কাছে পেয়ে তার মুখে খুশির হাসি। আদরের সন্তানকে কোলে তুলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরেন। মেয়েকে বুকে ধরে পরান জুড়ায় মা নাজমা বেগম। এ প্রশান্তির অনুভূতি যেন ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। এখন মেয়েকে যখন তখন কোলে নিতে পারবেন, আদর করতে পারবেন, ঘুম পাড়াতে পারবেন। এতদিন এ অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। সুরাইয়াকে তার মায়ের কাছে দিতে পেরে চিকিৎসকরাও আনন্দিত। সুরাইয়ার তত্ত্বাবধায়ক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলী বলেন, জীবনে প্রথম মায়ের পেটে গুলিবিদ্ধ শিশুকে চিকিৎসা দিতে হয়েছে। শিশুটিকে পাওয়ার পর আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি, আল্লাহ যেন আমার শক্তি-সামর্থ্য বাড়িয়ে দেন। আমি যেন শিশুটিকে তার মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারি। সৃষ্টিকর্তা আমাদের কথা শুনেছেন। সবার প্রচেষ্টায় সুরাইয়াকে তার মায়ের কোলে তুলে দিলাম। শিশুটি সুস্থ হওয়ায় আমি এতটা খুশি হয়েছি যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আল্লার কাছে শিশুটির জন্য আমি অনেক দোয়া করেছি। সুরাইয়ার স্বাস্থ্য ক্রমশ উন্নতির দিকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্রমে ওর ওজন বাড়ছে, রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা স্বাভাবিক। আল্লাহর রহমতে শিশুটি এখন আশঙ্কামুক্ত বলা চলে। হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে ডা. কানিজ হাসিনা শিউলী বলেন, ওকে মায়ের কোলে তুলে দিয়েছি। এখন আমরা দুই দিন পর্যবেক্ষণ করব। এরপর ওর চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড বৈঠক করবে। বৈঠকে পর্যবেক্ষণ নিয়ে আলাপের পর ছাড়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সুরাইয়াকে তার মায়ের কোলে তুলে দেয়ার পর ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান বলেন, ২৬ জুলাই ঢামেকে ভর্তি করা হয় শিশু সুরাইয়াকে। এখানে আনার পরই মেডিক্যাল বোর্ড বসিয়ে তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। যা যা প্রয়োজন ছিল তার সবই নিরলসভাবে করেছেন চিকিৎসকরা। ফলে নবজাতকটি এখন সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন তাকে চিকিৎসকরা মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন। তিনি বলেন, আমরা আশাবাদী তার মা তাকে সুস্থ করে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন। তিনি চিকিৎসার স্বার্থে ওই রুমে কাউকে না যেতে বলেন। এখন ভিজিটর (পরিদর্শক) কমাতে হবে। ভিজিটর বেশি হলে শিশুটির ইনফেকশনের শঙ্কা বাড়বে। শিশুটির সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সর্ম্পকে শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক আশরাফ উল হক কাজল জানান, শিশুটি এখন ভাল আছে এবং তার মায়ের অবস্থাও ভাল। উল্লেখ্য, এর আগে গত ৫ আগস্ট আধা ঘণ্টার জন্য মায়ের কোলে দেয়া হয়েছিল সুরাইয়াকে। এরপর প্রতিদিনই মা নাজমা বেগম এনআইসিইউতে গিয়ে মেয়েকে দুধ খাওয়াতেন। গত ২৩ জুলাই আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়ায় সাবেক ছাত্রলীগকর্মী কামরুল ভূঁইয়ার সঙ্গে সাবেক যুবলীগকর্মী মহম্মদ আলী ও আজিবরের সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় কামরুলের বড় ভাই বাচ্চু ভূঁইয়ার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী নাজমা বেগম (৩০) ও প্রতিবেশী মিরাজ হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। কামরুলের চাচা আব্দুল মোমিন ভূঁইয়া গুলিতে নিহত হন। ওই রাতেই মাগুরায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নাজমার গুলিবিদ্ধ শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়। অবস্থার অবনতি হলে দুই দিন পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা মেডিক্যালে শিশুটির চিকিৎসায় মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে কর্তৃপক্ষ। শিশুটির সুস্থতার জন্য ৩০ জুলাই মা’কে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। তখন মা নাজমা বেগমের শারীরিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। মা-মেয়ে পাশাপাশি ওয়ার্ডে থাকলেও একে অপরের পাশে থাকতে পারেনি। অবশেষে এই অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে মা-মেয়ে এখন একই সঙ্গে একই কেবিনে আছে।
×