ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মূল্যায়ন

যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আশার আলো

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ১৭ আগস্ট ২০১৫

যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আশার আলো

তৌহিদুর রহমান ॥ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার ৫৪ বছর ধরে চলা বৈরী সম্পর্ক অবসানের ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটাবে। এই দুই দেশের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জোরাল ভূমিকা রাখবে। দুই দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্ক একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবেও অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার বৈদেশিক নীতির কারণেই কিউবার সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়া সম্ভব হয়েছে। পাঁচ দশক পর দুই দেশের নতুন সম্পর্কের বিষয়ে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা এভাবেই বিশ্লেষণ করছেন। শুক্রবার হাভানায় মার্কিন দূতাবাসের উদ্বোধন করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। ১৯৬১ সালের ৩ জানুয়ারি কিউবায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। আর ১৯৪৫ সালের পর এই প্রথম কোন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিউবায় গেলেন। এর আগে গত মাসে ওয়াশিংটনে কিউবার দূতাবাস চালু করা হয়। এ ঘটনাকে ঐতিহাসিক বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। দেশ দুটির পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার এই নতুন সম্পর্ক বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় জোরাল ভূমিকা রাখবে। এটি একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আগ্রহেই এই নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। ওয়ালিউর রহমান বলেন, কিউবার বাতিস্তা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। পাঁচ দশক আগে প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তবে সেই সময়টা ছিল স্নায়ুযুদ্ধের সময়। সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। এরপর ধীরে ধীরে দুই দেশ পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আগ্রহী হয়। দুই দেশের এই নতুন সম্পর্ক গড়ার ফলে সারা বিশ্বেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি আরও ইতিবাচক হবে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হবে। দুই দেশের নতুন কূটনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে মূল্যায়ন জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, যে কোন সরকার ক্ষমতায় আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি তেমন নড়চড় হয় না। তবে মনে রাখতে হবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটু ব্যতিক্রম। তিনি বরাবরই উদার মনের পরিচয় দিচ্ছেন। মূলত বারাক ওবামা রাজনৈতিক ঝুঁকি নিয়েই কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ ঘটবে। বিশেষ করে লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে যে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মনোভাব রয়েছে, এখন ধীরে ধীরে তার অবসান হবে। তবে কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার পর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কোন সম্পর্ক তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে জানান ড. দেলোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক গড়া সম্ভব হলেও এখনই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়া সম্ভব হবে না যুক্তরাষ্ট্রের। এখানে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন জটিল বিষয় রয়েছে। তাই এখনই উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে দেশটি নতুন সম্পর্ক গড়তে পারছে না। গত বছর ১৭ ডিসেম্বর দূতাবাস খোলার ঐতিহাসিক ঘোষণা দিয়েছিলেন দুই দেশের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও রাহুল ক্যাস্ত্রো। সে অনুযায়ী গত ২১ জুলাই ওয়াশিংটনে কিউবার দূতাবাস চালু করা হয়। আর শুক্রবার কিউবায় মার্কিন দূতাবাস চালু করা হয়। ১৯৮২ সালে প্রথম কিউবাকে সন্ত্রাসবাদে মদদদাতা দেশগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, কিউবা বিভিন্ন সংগঠনকে সশস্ত্র বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ করতে সন্ত্রাসবাদকে ব্যবহার করছে। কিউবা অনেকদিন ধরে কলম্বিয়ার ফার্ক বিদ্রোহী ও লাতিন আমেরিকায় সক্রিয় বিচ্ছিন্নতাবাদী দল ইটিএর সদস্যদের শূন্য নিরাপদ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি সন্ত্রাসবাদে মদদদাতা দেশগুলোর তালিকায় সিরিয়া, ইরান, সুদানের মতো দেশের নামও রয়েছে। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নেতৃত্বে কিউবায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কের অবনতি হতে শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের সময় দুদেশের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে। সেই দীর্ঘ বৈরিতার ইতি টেনে যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবা গত জানুয়ারি থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করে। কিউবা-যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সম্পর্ক নিয়ে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্য কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন একটি বড় ঘটনা। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার দেখছে যে গত পঞ্চাশ বছরে কিউবা বিষয়ে যেসব নীতি গ্রহণ করা হয়েছে, তা ঠিক কার্যকর হয়নি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিষয়ে তার পররাষ্ট্রনীতির অবস্থান পরিবর্তন করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের পরিকল্পনা ঘোষণা করে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকানরা সাধারণভাবে মনে করে, প্রেসিডেন্ট ওবামার সম্পর্কোন্নয়নের এই সিদ্ধান্ত ভুল। ফলে রিপাবলিকানদের একটি বড় অংশ এই নীতির বিরোধিতা করেছে। বিশেষ করে ফ্লোরিডার কংগ্রেসম্যান মার্কো রুবিয়ো বিরোধিতা করেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে ফ্লোরিডাতে বড় অংশের কিউবান জনগোষ্ঠী বাস করে। এরা কিউবার কমিউনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধ লড়াই করেছে। এসব কিউবান মনে করেন দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের পদক্ষেপ নেবার প্রয়োজন আছে। ভয়েস অব আমেরিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যে সম্পর্ক পুরোপুরি স্বাভাবিকীকরণের বিষয়ে আগামী মাসে আলোচনা শুরু করবে নতুন করে গঠিত ইউএস-কিউবান কমিটি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শুক্রবার হাভানায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসে ৫৪ বছর পর আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলনের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ মন্তব্য করেন। যৌথ এ সংবাদ সম্মেলনে কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রড্রিগেজ বলেন দুদেশের সম্পর্ক পুরো মাত্রায় স্বাভাবিক করার জন্য দুপক্ষেরই অনেক কাজ বাকি। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে কিউবার ওপর চাপানো বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়াটা একটা বড় বিষয় বলে মন্তব্য করেন রড্রিগেজ। জন কেরি বলেন মানবাধিকারসহ নানা বিষয় নিষ্পত্তি করতে ইউএস-কিউবান কমিটি ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে। আগামী ১০-১১ সেপ্টেম্বর হাভানায় ওই কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। দুই দেশের নতুন সম্পর্ককে ঐতিহাসিক বলে বিবেচনা করে নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার নতুন কূটনৈতিক সম্পর্ক একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক গড়ার মধ্যে দিয়ে দুই দেশের মধ্যে অতীতের দূরত্ব কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। তবে নতুন সম্পর্ক গড়তে উভয় দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। কিউবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রুনো রড্রিগেজ ইতোমধ্যেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়টি উল্লেখও করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক ॥ স্পেনের উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা লাভের জন্য কিউবা ১৮৬৮ সাল থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করে। তবে ১৮৬৮ সালে কিউবার পক্ষে যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ১৯০২ সালে কিউবা প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। ১৯০৩ সালে এক চুক্তি অনুযায়ী কিউবার গুয়ান্তনামো দ্বীপে একটি নৌ ঘাঁটি চালু করে যুক্তরাষ্ট্র। আর ১৯৫৯ সালে বাতিস্তা সরকারের পতন ঘটিতে কিউবায় বিপ্লব হয়। এই বিপ্লবের নেতা ছিলেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো। এরপর থেকে কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। কেননা কিউবা সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ১৯৬২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর বাণিজ্যিক অবরোধ শুরু করে। এরপর ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে কিউবার ওপর অবরোধ দেয়। তবে ২০০১ সালে কিউবায় হারিকেন মিশেল আঘাত হানলে যুক্তরাষ্ট্র কিউবায় খাদ্য রফতানি করে। ২০০২ সালে মার্কিন সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার কিউবা সফর করেন। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর আমলে এটিই প্রথম কোন মার্কিন নেতার কিউবা সফর। ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট রাহুল ক্যাস্ত্রো ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস প্রতিনিধি দল কিউবা সফর করেন। ২০০৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পরে কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ওই বছরই ওবামা কিউবায় পারিবারিক ভ্রমণ ও রেমিটেন্সের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। ২০১৩ সালে ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরে নতুন করে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ শুরু করেন। তারই ধারাবাহিকতায় এখন দুই দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্কের সূচনা হয়েছে।
×