ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

যুগল হাশমী

মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ও আমরা

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ১৮ আগস্ট ২০১৫

মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল ও আমরা

শেখ কামাল সেদিন মেরুন রঙের টিশার্ট পরে এসেছিল এবং তাকে হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। শেখ কামাল বরের স্টেজে বসে অনেক রকম মজার মজার জোক বলে উপস্থিত সবাইকে খুব হাসিয়েছিল। কামাল ভাই সব সময় পরিবেশকে সুন্দর রাখার জন্য মজার মজার জোক বলত। সে দিন নাসিম ওসমানের বিয়ের আসরটা শেখ কামাল একাই অনেকক্ষণ আনন্দঘন করে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই হৈচৈ করে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলাম এবং শেখ কামালকে সঙ্গে নিয়ে নাসিমের সঙ্গে অনেক গ্রুপছবি উঠালাম। ট্র্যাজেডি হলো, এই গ্রুপছবিই শেখ কামালের জীবনের শেষ ছবি। গতকালের পর আজ পড়ুন শেষ কিস্তি ... ১৯৭৪-৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতরা ইভটিজিং ও যৌন নিপীড়ন জাতীয় ঘটনা ঘটাতে শুরু করলে শেখ কামাল একদিন আমাকে, মঈন সিনহা, নাসিম ওসমান, আলতাফ মল্লিক, মীর মোকসেদ আলী আওরঙ্গসহ ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় কর্মীদের জানাল, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের যাতে হয়রানি না করতে পারে সে জন্য সজাগ থাকতে হবে। এরপর থেকে এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে তৎপর ছিলাম যাতে বহিরাগত কোন ব্যক্তি বা ছাত্র কোন রকম অঘটন না ঘটাতে পারে। এরকম সময়েই একদিন দর্শন বিভাগের অনার্সের আমাদের বন্ধু ছাত্রী আমাদের কাছে এসে অভিযোগ দেয়, কলাভবনে তৃতীয় তলায় সিভিল ড্রেসে এক আর্মি অফিসার তাকে বাজে কথা বলেছে। আমরা কয়েকজন তৃতীয় তলায় গিয়ে সেই সিভিল ড্রেসের আর্মি অফিসারকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সে বলে, ‘এই মেয়েকে আমার পছন্দ হয়েছে, সে জন্য প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছি।’ সেই সিভিল ড্রেসের আর্মি অফিসারকে আমরা নিচতলায় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের কমন রুমের সামনে এনে শেখ কামালের কাছে বিচার দাবি করলে শেখ কামাল আর্মি অফিসারের পরিচয় নিয়ে ভবিষ্যতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এরকম করবে না অঙ্গীকার নিয়ে ছেড়ে দেয়। তখন আমরা জানতে পারি, সেই মেজরের নাম মেজর হুদা এবং ১৫ আগস্ট মেজর হুদা শেখ কামালকে হত্যার পর ১৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার নাসিম ওসমানদের হীরা মঞ্জিলের বাড়িতে গিয়েছিল আমাদের বন্ধু নাসিম ওসমানকে খোঁজার জন্য এবং দ্বম্ভ করে বলে, ‘আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ কামাল, নাসিম ওসমানসহ যারা অপমান করেছে, শেখ কামালকে হত্যা করেছি, নাসিমসহ অন্যদেরও হত্যা করব’। অর্থাৎ মেজর হুদারা পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ইচ্ছাকৃতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ইঙ্গিত দিয়ে গ-গোল করতে চেয়েছে, যাতে শেখ কামাল জড়িত হয় একটা ঝগড়াতে। মেজর ডালিমের স্ত্রী নিন্মী সম্বন্ধে যে স্ক্যান্ডাল করা হয়েছে, তাও মিথ্যা এবং বিকৃতভাবে প্রচার করা হয়। প্রকৃত ঘটনা হলো, মেজর ডালিম ও তার স্ত্রী নিন্মী বেগম মুজিবকে মা বলে ডাকতেন এবং বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তাদের ও মেজর ডালিমের শাশুড়ির অবাধ যাতায়াত ছিল। মেজর ডালিমের স্ত্রী-সংক্রান্ত কিছু ঘটনার কথা অনেকেই নির্দ্বিধায় বলে বেড়ায়, যা প্রকৃতপক্ষে সত্য নয়। প্রকৃত ঘটনা হলো, লেডিস ক্লাবের এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ডালিম তার স্ত্রী নিন্মী এবং ডালিমের শালা সম্ভবত লন্ডন থেকে আগত ববিকে নিয়ে গিয়েছিল। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার এক ছেলে ববির চুল লম্বা দেখে চুলে হাত দিয়ে বলেছিলÑ ছেলে না মেয়ে? এতে ববি খুব মাইন্ড করে এবং মেজর ডালিমের কাছে গিয়ে নালিশ করে। মেজর ডালিম তখন গাজী গোলাম মোস্তফার ছেলেকে ডেকে শাসালে গাজীর ছেলেও উল্টাপাল্টা বললে এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং ডালিমের সঙ্গে গাজীর ছেলের কথা কাটাকাটি হয়। ঘটনার উত্তেজনায় ডালিমের স্ত্রী মেজর ডালিমকে শান্ত করার জন্য শার্ট ধরে টানলে ডালিমের শার্ট ছিঁড়ে যায় এবং উপস্থিত অনেকে উভয়পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করলে হাল্কা ধাক্কাধাক্কির ঘটনাকে পরে বিকৃত করে বলা হয়, ডালিমের স্ত্রীর গায়ে হাত দেয়া হয়েছে। লেডিস ক্লাবের কাছেই শেখ জামাল এবং শেখ মারুফ ছিল। তারা ডালিম ও তার স্ত্রীকে ৩২নং রোডে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ঘটনার কথা বললে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফা ও তার ছেলেকে ডেকে এনে ব্যাপারটা মীমাংসা করে দেন। ঘটনা মীমাংসা হওয়ার পরও পরবর্র্তীতে মেজর ডালিমের পক্ষ নিয়ে মেজর নূর সেনাবাহিনীর সদস্যদের দিয়ে হৈ চৈ করে, যা সেনা আইনে অপরাধ। যার জন্য আর্মির শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে মেজর নূর ও মেজর নূরুকে সেনাবাহিনী থেকে সাসপেন্ড করা হয়। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেনাবাহিনীর পাহারারত সদস্যরা ছিলেন মেজর নূর, মেজর হুদা ও মেজর ডালিমের কোম্পানির সদস্যরা। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হত্যাকারী গ্রুপের আক্রমণের পূর্বমুহূর্তে ডিউটি চেঞ্জের সময় ডিউটিরত সিপাহীদের ভুল কথা বলে কোন গুলি দেয় নাই। অর্থাৎ মেজর নূর, মেজর হুদা, মেজর ডালিম ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কিছু ঘটনা আগেই তৈরি করেছিল, যাতে তাদের হত্যাকা-ে অংশগ্রহণ জনগণ সহজভাবে নেয়। এভাবেই ১৫ আগস্ট বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসের বর্বরোচিত, নিষ্ঠুর ও মর্মন্তুদ হত্যাকা- ঘটনার আগে দেশী-বিদেশী কুশীলবরা গভীর ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করেছিল। এ ব্যাপারে হত্যাকারী গ্রুপের অন্যতম কর্নেল (অব) ফারুক তার এক সাক্ষাতকারে বলে, ‘জানুয়ারি মাসে একবার চেষ্টা করেছিলাম। তবে সেটাই প্রথম নয়। শেখ মুজিব সরকারের পতন ঘটানোর জন্য আমি চারবার এটেম্পট নেই। ইয়েস একটা দুটো, তিনটে চারটে, জি চারবার চেষ্টা করেছিলাম... ১৯৭৪ সালে প্রথমবার চেষ্টা করি।’ ১৪ আগস্ট ১৯৭৫ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। পরদিন ১৫ আগস্ট সকালে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন একটি বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। এ নিয়েই সেদিন রাজধানী ঢাকা ছিল সরগরম। বাঙালীর সব আন্দোলন সংগ্রামের সূতিকাগার ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাজে সেজেছিল বাঙালীর হাজার বছরের কাক্সিক্ষত ব্যক্তিত্ব জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে বরণ করার জন্য। ছাত্রলীগের ১২০০ স্বেচ্ছাসেবকের এক বিশাল বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল শেখ কামালের নেতৃত্বে। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শুনলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রেনেড বার্স্ট করা হয়েছে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় খুব উত্তেজনা বিরাজ করছে। সমাজবিজ্ঞান বিভাগের কমনরুমের বারান্দায় শেখ কামাল আমাদের ডেকে বললেন, ‘আজকে সারারাত ইউনিভার্সিটিতে থাকতে হবে। এখানকার অবস্থা বেশি ভাল মনে হচ্ছে না। আজ রাতে এবং আগামীকাল তুই আমার পাশে পাশে থাকবি।’ আমি শেখ কামালের কথা শুনে বললাম, ১৮ আগস্ট আমার নেতৃত্বাধীন নাট্য সংগঠনের নাটক ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে মঞ্চস্থ হবে। সে অনুষ্ঠানে আপনি বিশেষ অতিথি। সেই অনুষ্ঠানের সুভিনির আপনাকেসহ অনেকের কাছে পৌঁছাতে হবে। আজ সেই নাটকের ফাইনাল স্টেজ রিহার্সেল এবং আজ রাতে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাসিম ওসমানের বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়াসহ আরও কিছু কাজ আছে। সেজন্য নাসিমের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ না করে ইউনিভার্সিটিতে আসতে পারব না। আমার কথা শুনে শেখ কামাল বলল, ‘আমিও নাসিম ওসমানের বিয়ের অনুষ্ঠানে লেডিস ক্লাবে যাব। তুই সেখান থেকেই আমার সঙ্গে ইউনিভার্সিটিতে চলে আসিস।’ রাতে নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার নাসিম ওসমানদের হীরা মঞ্জিলের বাড়ি থেকে নাসিমকে বর হিসেবে সাজিয়ে ঢাকার লেডিস ক্লাবে এসে বরের জন্য নির্দিষ্ট স্টেজে বরের সঙ্গে আমরা বসলাম। আনুমানিক রাত ১০টার সময় শেখ কামাল বন্ধু-বান্ধবসহ লেডিস ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিল। শেখ কামাল সেদিন মেরুন রঙের টিশার্ট পরে এসেছিল এবং তাকে হাসিখুশি দেখাচ্ছিল। শেখ কামাল বরের স্টেজে বসে অনেক রকম মজার মজার জোক বলে উপস্থিত সবাইকে খুব হাসিয়েছিল। কামাল ভাই সব সময় পরিবেশকে সুন্দর রাখার জন্য মজার মজার জোক বলত। সে দিন নাসিম ওসমানের বিয়ের আসরটা শেখ কামাল একাই অনেকক্ষণ আনন্দঘন করে রেখেছিল। কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই হৈচৈ করে এক সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করলাম এবং শেখ কামালকে সঙ্গে নিয়ে নাসিমের সঙ্গে অনেক গ্রুপছবি উঠালাম। ট্র্যাজেডি হলো, এই গ্রুপছবিই শেখ কামালের জীবনের শেষ ছবি। বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে শেখ কামাল চলে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেল, ‘ইউনিভার্সিটিতে তোদের সঙ্গে দেখা হবে। আমরা ইউনিভার্সিটিতে এক সঙ্গে থাকব।’ এই কথাই শেখ কামালের সঙ্গে আমাদের শেষ কথা এবং শেষ দেখা। মেরুন রঙের টিশার্ট পরা সেদিনের হাসিখুশি শেখ কামালের শেষ ছবিটা এখনও আমার চোখে ভাসে। ১৫ আগস্টের বেদনাদায়ক ভয়ঙ্কর সময়কে এখনও আমার দুঃস্বপ্ন মনে হয়। এখনও যখন নাসিম ওসমানের বিয়ের অনুষ্ঠানের শেখ কামালের সঙ্গে আমাদের গ্রুপছবিগুলো দেখি তখনই মনে হয় হাসি হাসি মুখে শেখ কামাল যেন আমাদের সামনে জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছে এবং বলছেÑ ‘তোরা ইউনিভার্সিটিতে চলে আসবি, আমরা আজ এক সঙ্গে থাকব।’ ১৫ আগস্টের মর্মান্তিক হত্যাকা-, বিশেষ করে প্রিয় মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের হত্যাকে মেনে নিতে পারিনি বলে ১৯৭৫ সালে নবেম্বর মাসে আমার ও নাসিম ওসমানের নেতৃত্বে বন্ধু ও শেখ কামালের বহু অনুসারীকে সঙ্গে নিয়ে সশস্ত্রভাবে প্রতিবাদ করার জন্য সীমান্ত অঞ্চলে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের মতো সশস্ত্র প্রতিবাদ করি। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর ১৯৭৭ সালে সশস্ত্র অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে ৯ মাস ডিজিএফআইয়ের নির্জন সেলে এবং ১৮ মাস ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে জেল খাটি এবং বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরাধিকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ কামালের জ্যেষ্ঠ ভগ্নি ‘সময়ের সাহসী বীর’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে কাজ করে যাচ্ছি। [email protected]
×