ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শরতের রূপ

আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ে লুকোচুরি খেলা রে ভাই...

প্রকাশিত: ০৬:২৪, ১৮ আগস্ট ২০১৫

আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ে লুকোচুরি খেলা রে ভাই...

সমুদ্র হক --------- ‘আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ে লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা আজি নীল আকাশে কে ভাসাল সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই লুকোচুরির খেলা’...এমনই সুরে অমল ধবল পালে হাওয়া লেগে শরত এসেই গিয়েছে। ময়ূরকণ্ঠী মেঘনীল রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে কখন যে ছাই রঙা মেঘ জড়ো হয়ে এক পশলা বৃষ্টি দিয়েই লুকিয়ে পড়ে টেরই পাওয়া যায় না। সকালে দেখা শুকনো পথঘাট বিকেলে ভিজেই গাছগাছালির কাঁপুনি। বাঙালীর ঋতুচক্রে নির্মল প্রশান্ত কোমল শরতের স্বভাবই এমন। একেবারে নিভৃতচারী। তার মধ্যেই হৃদয় কেড়ে নেয়। এই ঋতুকে অনেক আগেই যুগে যুগের কবি সাহিত্যিকরা মধুময় মিষ্টি ঋতু বলেছেন। দাবদাহ নেই। বসন্তের মতো চোখ ধাঁধানো রূপের বাহার নেই। বর্ষার মতো বারিধারা নেই। আকাশে আগুনের রেখা চিড়ে তীব্র ঝলকানি ও গগনবিদারী শব্দ নেই। ঝড়ো হাওয়া নেই। ঘন কুয়াশার আস্তরণ নেই। মাঝে মাঝে যা বৃষ্টি ঝরে তারও একটা ছন্দ আছে। শান্ত আকাশে বৃষ্টি ঝরিয়ে নববধূর মতো অবগুণ্ঠনের আঁচল ঠোঁট কামড়ে ধরে যেন লাজুক হয়ে যায়। বসন্তকে বলা হয় ফুলের পাপড়ি ছড়ানো রোমান্টিকতায় ভরা প্রণয় মধুর ঋতু। তবে শরতের ধ্রুপদী রোমন্টিকতার কাছে কিছুই না। এত ক্লাসিক রোমান্টিকতা অন্য কোন ঋতুর সঙ্গে মেলেই না। শরতই একমাত্র ঋতু যে তার আঙ্গিনায় বর্ষার ‘গ্র্যান্ড ফিনালে’র (ফের পরবর্তী সিজনে শুরু হওয়ার আগে শেষ) পরও ঢুকতে দিয়ে কিছুটা সময় থাকতে দেয়। আর বর্ষা অনধিকার প্রবেশ ধুরন্ধর পটু এক ঋতু। যে করেই অন্যের অধিকারে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রিমঝিম বৃষ্টির তাল লয় ভুলে গিয়ে বিরতিহীন ঝরে পথঘাট ডুবিয়েও দেয়। তখনই শরত ক্ষেপে গিয়ে বাঙালীর প্রবাদের মতো বলে ওঠে ‘বসতে দিলে শুতে চায়’ দেখাচ্ছি মজা। বর্ষাকে ঝেটিয়ে বিদায় করার পালায় আকাশে খেয়ালি রূপালী মেঘ ভাসিয়ে দেয়। ঝলমলে রোদেলা আকাশে উচ্ছ্বাস ফিরে পায় শরত। সজীব হয়ে ওঠে ধরণী। শরতের নিসর্গতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কত কবিতা কত গান বাংলা সাহিত্যকে সুবাসিত করে রেখেছে। ‘শরত প্রাতের প্রথম শিশির প্রথম শিউলি ফুলে, ‘ওগো শেফালি বনের মনের কামনা’, ‘হৃদয় কুঞ্জবনে মঞ্জুরিল মধুর শেফালিকা’, ‘সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা’, ‘আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ/আমরা বেঁধেছি শেফালি মালা’, ‘শিউলি সুরভিত রাতে বিকশিত জ্যোৎ¯œাতে ‘...এমন কথামালায় সৃষ্টি শরতের রূপের বর্ণনা চিরন্তন হয়ে আছে। বাঙালীর ঋতুচক্রে প্রকৃতির এমন রূপ নগরে মহানগরে চোখে পড়ে না। কংক্রিটের বনে যেখানে শেষ বিকেলের সোনারোদের লাজুক আলো ছড়িয়ে পড়তে পারে না সেখানে ক্লাসিক শরত কী করে ধরা দেবে! শরতকে হৃদয়ের গভীর কোনের সুপ্ত ভাল লাগা দিয়ে অনুভব করা যায় গ্রামের পথে পা বাড়ালে। যদিও দিনে দিনে সেই ছায়ায় ঢাকা ঘুঘু ডাকা মায়া ভরা মেঠো পথ ধরে হাঁটা সেই সুশীতল গ্রামের চিরচেনা দৃশ্যের পরিবর্তন হচ্ছে। গ্রামও বদলে যাওয়ার ধারায় আধুনিক হয়ে উঠছে তারপরও আজও ঋতু বৈচিত্র অনুভব করা যায়। প্রকৃতি তার রূপ মেলে ধরে প্রাণ জুড়িয়ে দেয়। নদী তীরে বা কোন চরগ্রামে বালুচরে কাশবনে শুভ্র ফুলের গুচ্ছে অনুপম হিল্লোল তুলে এনে দেয় নিসর্গ। যে কাশবনে খুঁজে পাওয়া যায় সত্যজিৎ রায়ের অমর সৃষ্টি পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রের দুর্গা আর অপুকে। বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের এই গল্পে দুর্গা অপুর কিশোর প্রণয়ের যে চিরন্তন ও মধুময় রূপ তুলে ধরা হয়েছে শরতের অম্লান রূপই তা ধরে রেখেছে অনন্তকালের হয়ে। শরত শশীরও গর্ব আছে পূর্ণিমার তিথিতে। এমন মায়াবী ¯িœগ্ধ আলোয় শিশির সিক্ত হয়ে ওঠে গভীর রাতে। এমন রাতে নদীর শান্ত ঢেউয়ে চাঁদ ও তারাকে দেখে মনে হবে আকাশ থেকে নেমে নাচছে। প্রবীণরা এমন দৃশ্যে নস্টালজিক হয়ে ফিরে যেতে পারেন যৌবনে। হয়ত মনে পড়বে সায়গলের কণ্ঠের গান ‘ঝুমুর ঝুমুর নূপুর বাজে চাঁদ নাচে তারা নাচে পাহাড়িয়া ওই নূপুরে বুঝি বন্দী আছে। এমন রূপেই জলাশয়ে চোখে পড়বে শাপলা ও পদ্ম ফুল। গ্রামের কিশোর কিশোরীরা শাপলা শালুক ভ্যাট ফুল তুলে খেলায় মেতে ওঠে। শরতের মাধুর্যে বনফুলও নীরব থাকে না। পথের ধারে ঝাউবনে নাম না জানা কত বনফুল। শরত শিউলিকে আগলে রাখে। শিউলিকে ঘিরে আছে পৌরণিক উপাখ্যান। সূর্যের প্রভায় মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ল এক রাজকন্যা। সূর্য প্রত্যাখ্যান করল। অভিমানে রাজকন্যার আত্মহনন। সেই চিতার ছাই থেকে গজে উঠলো একটি গাছ। পরিণত হলো উঁচু হয়ে। ওই গাছের শাখায় নির্জন রাতে ফুটল মিষ্টি সৌরভের ফুল। ঝরে পড়ল সূর্য ওঠার আগেই। উপাখ্যানে নিশুতি রাতের এই ফুলই শিউলি যার আরেক নাম শেফালি। নিশি রাতের শিশির ভেজা ফুলগুলো ঝরে ভরে যায় গাছতলা। কিশোর বেলায় শিউলি তলায় ফুল কুড়োতে যাওয়া আর মালা গাঁথার আনন্দ অন্যরকম। একটা সময় গ্রামে ও শহরের অনেক বাড়িতেই শিউলি গাছের দেখা মিলত। এখন কালে ভদ্রে দেখা মেলে। শিউলি টগর মালতি না ফুটলে যে শরত বেমানান। শরতেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সম্প্রীতির বন্ধনের শারদীয় উৎসবের বাদ্যি বেজে ওঠে। সুর সাগর জগন্ময় মিত্রের কণ্ঠের সেই অমর গান “এমনি শারদ রাতে তোমায় আমায় দেখা হলো সেই আঙ্গিনায় জ্যোৎস্নাতে/তখন বাতাসে আঙ্গিনার পাশে শেফালি রহিছে পড়ে...” শরতের হৃদয় জুড়ে বাজে কত সুর...।
×