ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ইতিহাসের পরিসর বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব না

প্রকাশিত: ০৪:২৩, ১৯ আগস্ট ২০১৫

ইতিহাসের পরিসর বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব না

মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা মানুষকে খুন করেছে, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে, গ্রাম থেকে গ্রামে পলায়নপর মানুষকে খুন করার প্ররোচনা দিয়েছে, যারা পুরো দেশটাকে এবং গোটা জনসমষ্টিকে : হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রীস্টান নারী পুরুষ নির্বিশেষে হোস্টেজ করে রেখেছে, তাদের বিচারের বেলায় তাদের প্রতি সৌজন্য দেখাতে হবে কি? খুনীদের বিচারের বেলায় সৌজন্য দেখানোর নিয়ম কোথাও নেই। নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার নির্দেশ যারা দিয়েছে তাদের বিচারের বেলায় ভদ্রতা দেখাবার নজির কোথাও নেই। পঞ্চাশ বছর আগের দিনগুলোর কথা আমরা ভুলে যাইনি। যখন আমরা, নিরস্ত্র মানুষরা, গ্রাম থেকে গ্রামে, শহর থেকে শহরে, জান বাঁচাবার জন্য, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ছোটাছুটি করে বেড়িয়েছি, ভেবেছি শেষ দিন, আমাদের তাড়া করে ফিরেছে গোলাম আযম এবং গোলাম আযমের সীমার বাহিনী, আমাদের জবাই করে অট্টহাসি হেসেছে। আমরা পালাতে পালাতে রুখে দাঁড়িয়েছি, আমরা মরতে মরতে প্রতিরোধ করেছি, আমরা খালি হাতে রক্ষা করেছি আমাদের দেশ। গোলাম আযমদের বিরুদ্ধে আমরা এভাবেই বেঁচে থাকার ভিশন তৈরি করেছি, জল্লাদদের হাত থেকে গণতন্ত্র কেড়ে এনেছি, এবং এই বেঁচে থাকার ভিশন গোলাম আযমদের দয়া করার জন্য নয়, গোলাম আযমদের (অথবা ফজলুল কাদের চৌধুরীদের) রক্ষা করার জন্য এই সভ্য জাস্টিস নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অর্থ : নিরস্ত্র মানুষদের হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিশোধের দাবানল জ্বালিয়ে দেয়া। বিচার-বিচার খেলার জন্য এই বিচার নয়, এই বিচারের অন্তঃসার হচ্ছে : নিরস্ত্র মানুষদের শক্তি চরাচরে ঘোষণা করা। নিরস্ত্র মানুষরা, বিচারের মাধ্যমে, প্রতিশোধ তো নেবেই। সশস্ত্র মানুষরা, গোলাম আযম এবং গোলাম আযমের দল এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যুদ্ধের সময় নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করেছে। সভ্য বিচার হচ্ছে সহিংস প্রতিরোধ সশস্ত্র খুনীদের বিরুদ্ধে। সশস্ত্র খুনী কারা? গোলাম আযম এবং গোলাম আযমের রাজনৈতিক দল, জামায়াতে ইসলামী এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তারা হত্যা করেছে কাদের? নিরস্ত্র মানুষদের। আমাদের মনে রাখতে হবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নেহাত রাজনৈতিক থিয়েটার নয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিরস্ত্র মানুষদের জাস্টিস প্রতিষ্ঠার বিচার। সশস্ত্র মানুষদের বিচার এবং নিরস্ত্র মানুষদের জাস্টিস প্রতিষ্ঠার বিচার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার বিচার নয়। এই ক্ষেত্রটি নন-নেগোসিয়েবল বিচার, সেজন্য, আমাদের কাছে সশস্ত্র বদমাশদের বিরুদ্ধে অহিংস জাস্টিস প্রতিষ্ঠার লড়াই। পঞ্চাশ বছর আগেকার সশস্ত্র বদমাশদের বিরুদ্ধে আমরা, নিরস্ত্র মানুষরা, অহিংস জাস্টিস প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেছি। পঞ্চাশ বছর পরেকার বৃদ্ধ বদমাশদের বিরুদ্ধে আমরা জাস্টিস চাচ্ছি না। আমরা জাস্টিস চাচ্ছি, পঞ্চাশ বছর পূর্বেকার জোয়ান, নরপশুদের বিরুদ্ধে। এখানে সৌজন্যের প্রশ্ন ওঠে না। এখানে বিচারের প্রশ্ন ওঠে। নরহত্যার বিচার দ্রুত হবেই হবে, অপরাধীদের শাস্তি পেতেই হবে। আমরা পঞ্চাশ বছর পরেকার বিচার সম্পন্ন করার জন্য এইসব বদমাশকে কাঠগড়ায় তুলিনি। তারা হাঁটতে পারে কি পারে না, তারা বিবিধ রোগে আক্রান্ত কি আক্রান্ত না সে বিচার, সে মেডিক্যাল বিচার করার জন্য তাদের কাঠগড়ায় তুলিনি। যারা বিচারের দায়িত্বে আছেন তারা ডাক্তার নন। তারা বিচারক। তারা নরহত্যা বিচারের দায়িত্বে নিয়োজিত। সেজন্য আমরা, নিরস্ত্র মানুষরা এবং তারা সশস্ত্র বদমাশরা, সমান জাস্টিস এবং সমান অধিকার পেতে পারে না ও যুদ্ধাপরাধীর যারা বিচারক, তাদের এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত না। আমরা সাধারণ মানুষ, পাকিস্তান নামক একটি ভায়োলেন্ট রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের সেবক জামায়াতে ইসলামী নামক একটি নাৎসি রাজনৈতিক দলের হত্যার শিকার হয়েছি এবং গোলাম আযম ও বিভিন্ন বদমাশের মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের আতঙ্ক প্রত্যক্ষ করেছি। পঞ্চাশ বছর আগে এসব বদমাশ নাৎসি রাজনীতির ফলশ্রুতি হিসেবে মানুষ খুন করেছে এবং পঞ্চাশ বছর এসব বদমাশ নাৎসি রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেনি (দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব নাৎসির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নব্য নাৎসি বিএনপি)। মাফ করার জন্য তাদের বিচার নয়, শাস্তি দেয়ার জন্য তাদের বিচার। যুদ্ধাপরাধের মতো নিষ্ঠুর অপরাধের মাফ হয় না, শাস্তি দেয়ার জন্য তাদের বিচার। যুদ্ধাপরাধের মতো নিষ্ঠুর অপরাধের মাফ হয় না, তাদের বিচার হয় এবং বিচারে শাস্তি হয়। মানুষ খুন করার শাস্তি কী? লাখ লাখ মানুষ খুন করলে প্রতিশোধের রাজনীতির নিরিখে বিচার হয়। এই বিচার সভ্যতা রক্ষার বিচার, গোলাম আযম ও ফজলুল কাদের চৌধুরীর মতো নাৎসিদের বিচার, জামায়াতে ইসলামী নামক একটি নাৎসি রাজনৈতিক দলের বিচার। একজন নাৎসি বদমাশের বিচারের সঙ্গে একটি কদর্য নাৎসি রাজনৈতিক দলের বিচারও করতে হবে যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের। সেজন্য গোলাম আযম ও ফজলুল কাদের চৌধুরী নেহাত কোন ব্যক্তি নয়, একটি কদর্য রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং একটি খুনী রাজনৈতিক দলের প্রতীক। ইতিহাসের এই পরিসর বাদ দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কখনও সম্ভব না। এই বিচারই আমরা চাচ্ছি। এই বিচারের জন্য যে মানুষটি একলা কবরে শুয়ে আছেন, এই বিচারের জন্যই যে মানুষগুলো গণকবরে শুয়ে আছেন, তারা ইতিহাসের দিকে আমাদের এবং বিচারকদের পথনির্দেশনা দেখাচ্ছেন। আর একটা কথা বলতেই হয় : যারা ইতিহাসের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তাদের নিয়তি গোলাম আযম কিংবা ফজলুল কাদের চৌধুরী হওয়া। এদের ন্যায় নিয়তি নিয়ে কোন মানুষের বেঁচে থাকার মতো লানৎ আর কিছুতে নেই। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি সমর্থন করার অন্য অর্থ হচ্ছে খালেদা জিয়ার দিক থেকে সমাজে রাজনীতিতে সীমাহীন ভায়োলেন্স সমর্থন করা। এই ভায়োলেন্স বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতিতে প্রধান স্ট্র্যাটেজি হিসেবে স্বীকৃত এবং এই রাজনীতি মানুষের ফ্রিডমের বিরোধী। মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামের হত্যাকা- একদিকে খালেদা জিয়া সমর্থন করেছেন, অন্যদিকে হত্যাকা- উদ্ভূত ভায়োলেন্সকে রাজনীতির স্ট্র্যাটেজি হিসেবে মেনেছেন। তার অর্থ তিনি জেনোসাইডাল টিরেনির পৃষ্ঠপোষক। খালেদা জিয়া এসবের সমর্থক। এসবের বিচার জরুরী। আমরা যদি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ তৈরি করতে চাই, তাহলে খালেদা জিয়ার মতো ব্যক্তিদের যারা অন্যায় ও অপরাধ করেছেন, তাদের বিচার আবশ্যক। ইতিহাসের দিক থেকে যদি খালেদা জিয়ার অবস্থান পর্যালোচনা করি তাহলে বলতে হয়, খালেদা জিয়া ইতিহাসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। পৃথিবীর বিবেক নিরস্ত্র মানুষের গণহত্যার বিরোধী এবং নিরস্ত্র মানুষদের যারা হত্যা করেছে এবং নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা যারা সমর্থন করেছে, তাদের বিচারের জন্য আকাশ থেকে বজ্রের আওয়াজ কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে চলেছে : বিচার চাই। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলাম ও খালেদা জিয়া নিরস্ত্র মানুষ হত্যার দায় থেকে কখনও মুক্তি পাবে না।
×