বঙ্গবন্ধুর নিষ্প্রাণ জমাট বাঁধা রক্তাক্ত লাশ ৩২ নম্বর সড়কের তাঁর বাড়ির সিঁড়িতে রেখেই ঘাতক দল অত্যন্ত নিপুণ হাতে মাত্র ১৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন গুছিয়ে ফেলেছিল পুরো দেশটাকে কার্ফু দিয়ে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে। সামরিক আইন জারি করে রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র বাহিনীগুলোর সমর্থন ও আনুগত্য এবং বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করে পাকিস্তানপন্থীদের প্রকাশ্যে এনে এবং আওয়ামী লীগকে বজায় রেখে জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত না করে মোশতাক যা করেছিল, তা আগে থেকেই তার গোপন ষড়যন্ত্রের খাতায় লেখা ছিল। স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হলেন মোশতাক। শপথ গ্রহণের আগেই বেতার থেকে খুনীরা তাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারবার ঘোষণা করতে থাকে। সন্ধ্যায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিল। তাদের অধিকাংশই ছিল বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। বঙ্গবন্ধু দুর্নীতির অভিযোগে যেসব এমপিকে বরখাস্ত করেছিলেন, তাদের কেউ কেউ ঠাঁই পায়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যার সময় ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন দলীয় সকল সংসদ সদস্য, বাকশালের গবর্নররা, বাকশালের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। ১৫ আগস্ট সকালে বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে যোগদানের কর্মসূচী ছিল। সে উপলক্ষে ডাকসু ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ১৪ আগস্ট থেকেই সক্রিয় ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়ে তাদের একটা অংশ আত্মগোপনে চলে যায়। অনেকে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। যারা আনুগত্য প্রকাশে রাজি হয়নি, তাদের জেলে পাঠানো হয়। সংবিধান অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলীর দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু তা হয়নি। তবে যেহেতু খুনের পরিকল্পক মোশতাক এবং তার সহযোগী ও অনুসারী রাজনীতিক এবং চক্রান্তে জড়িত সেনাবাহিনীর মাঝারি সারির কর্মকর্তারা ক্ষমতা হাতে নেয়। হত্যার পরপর সৌদি আরব এবং চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তান মোশতাককে অভিনন্দন জানায়। মোহাম্মদপুর ও মীরপুরে অবাঙালী অধ্যুষিত এলাকায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি শোনা যায়। বাংলাদেশ বেতারকে রেডিও বাংলাদেশ ঘোষণার পরপরই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাকারী গান বানিয়ে তা প্রচার করা হতে থাকে। দলীয় নেতা ও সাংসদ অনেকেই লাশ দেখতে যাওয়া দূরে থাক, আত্মগোপনের পথ কেউ খুঁজছিলেন, কেউ খুনী শাসকদের অনুসারী হলেন। সেদিন দলের ভেতরে ডানপন্থী অংশ এবং পাকিস্তান প্রত্যাগত মুক্তিযুুদ্ধে অংশ নেয়া মোশতাকের ঘনিষ্ঠ বিপথগামী সেনারা এই হত্যাকা-ে জড়িত ছিল। এ কাজে তারা সহায়তা পেয়েছে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট ভুট্টো ও সেদেশের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর কাছ থেকে। সেই সঙ্গে একাত্তরের পরাজিত শক্তিরাও পাশে দাঁড়ায়। মোশতাকের ৮১ দিনের শাসনকাল পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এ হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা ছিল জোরালো। যে রাজনীতি ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্র তৈরি করেছে বিদেশী সহায়তায় অর্থাৎ একাত্তরের পরাজিত পাকিস্তান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়েছে। আর একাত্তরেই এই দুই দেশের সঙ্গে মোশতাকের দহরম-মহরম তথা যোগসূত্র ঘটে যার পরিণতি ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্রের তথা রাজনৈতিক চক্রান্তের তথ্য আজও অনুদঘাটিত। সরকার তা অনুসন্ধানে কমিশন গঠন করতে অবশেষে উদ্যোগ নিয়েছে। বিলম্বে হলেও তা অভিনন্দনযোগ্য। চল্লিশ বছর পরের এ উদ্যোগ বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশ আরেক ধাপ কলঙ্কমুক্ত হবে।
দেশবাসী খুনীদের ঘৃণা করে। তাই দেখা গেছে খুনী মোশতাকের বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচী। ঘেরাওকারীরা মোশতাকসহ খুনীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়েছে। এ দাবি দেশবাসীরও। এ দাবি বিবেচনার দায় এখন পড়বে প্রস্তাবিত কমিশনের ওপর। এবং তা বাঞ্ছনীয়।