ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়;###;শামস ইসলাম

অভিমত ॥ বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ১৯ আগস্ট ২০১৫

অভিমত ॥ বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখুন

শিক্ষা ও শিক্ষক পরিবার এ সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিক্ষকদের সাংবিধানিক অধিকার, ন্যায়বিচার, সমতা, বদলি, পদোন্নতি ও বেতন স্কেলও এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। শিক্ষার সাফল্য ও ব্যর্থতার ক্ষেত্রে এর প্রভাব রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কোন কোন ক্ষেত্রে সমতা ও সমঅধিকারের কথা বলা হলেও নারী শিক্ষকদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘটনা ঘটছে, যা অনাকাক্সিক্ষত। স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে বসবাস করতে না দিয়ে বদলি বন্ধ রাখা, বেতন বৈষম্য জিইয়ে রাখা, পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নারী শিক্ষকদের একটি অংশ। অধিকার আদায় বলতে ভোটাধিকার, ব্যবসা, শিক্ষা, সমান কাজে সমবেতন, সম্পত্তির অধিকার, বিবাহে সমানাধিকার, মাতৃত্বÑ সর্বোপরি স্বামী-স্ত্রীর সহাবস্থানের স্বীকৃতি দেয়াকে বোঝায়। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৫ জুলাই, ২০১৫ তারিখে ৪৩৪ নম্বর স্মারকে জারিকৃতÑ ‘সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বদলি নীতিমালা প্রজ্ঞাপনটি বর্তমান সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। উল্লিখিত বদলি নীতিমালায় ৮টি ধারাসহ ৪৮টি উপধারায় বিভক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছেÑ বদলির সময়কাল, বদলির কর্তৃপক্ষ, বদলির সাধারণ শর্তাবলী, বৈবাহিক কারণে বদলি, প্রশাসনিক প্রয়োজনে বদলি, সমন্বয় বদলি, সংযুক্তি ও অন্যান্য। এখানে যৎসামান্য উপস্থাপন করা হলো। বদলির সময়কাল ধরা হয়েছে জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস। একই ধারায় বলা হয়েছেÑ যে কোন সময় বদলি করা যাবে। এক্ষেত্রে বদলির এক বছর পূর্ণ না হলে পুনঃবদলির জন্য বিবেচনায় আনা হবে না। ৩.৭ উপধারায় বলা হয়েছেÑ নদীভাঙ্গন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বসতভিটা বিলীনের কারণে স্থায়ী ঠিকানায় বদলি করা যাবে। তবে শর্তারোপ করা হয়েছে যে, উপজেলা ভূমি সহকারী কমিশনার, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান/ওয়ার্ড কাউন্সিলরের প্রত্যয়নপত্র, স্থায়ী ঠিকানার জমির দলিল ও খতিয়ান, বাড়ির হোল্ডিং নম্বর, ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রসিদ, পৌর/ইউনিয়ন পরিষদের কর পরিশোধের রসিদসহ বদলির আবেদন করতে হবে। এখানে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়া যুক্তিসঙ্গত যে, যার কোন সম্পদ নেই, বাড়িঘর, জমিজমা নেই তিনি কোথায় পাবেন জমির দলিল-খতিয়ান, বাড়ির হোল্ডিং নম্বর, পরিশোধিত বিভিন্ন করের রসিদ। এসব শর্ত কি স্ববিরোধী ও সাংঘর্ষিক নয়? এছাড়া ৪.১ উপধারার বৈবাহিক বদলির ক্ষেত্রেও অনুরূপ কথার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। বিয়ের ক্ষেত্রে কাবিননামার শর্তারোপ যুক্তিযুক্ত। কিন্তু স্বামীর স্থায়ী ঠিকানার জমির দলিল ও খতিয়ান, বাড়ির হোল্ডিং নম্বর এবং বিভিন্ন করের রসিদ প্রদর্শনের শর্ত জুড়ে দেয়া কতটুকু বিধিসম্মত? ঢাকা শহরে যারা থাকেন তাদের ক’জন বাড়ির মালিক? চাকরি সূত্রে বা ব্যবসায়িক সূত্রে কেউ ভাড়া বাসায় আবার কেউ সরকারী কোয়ার্টারে থাকেন। চাকরি-বাকরিসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান/ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের প্রত্যয়নপত্র যেখানে অগ্রাধিকার দেয়া হয়ে থাকে, সেখানে এরকম শর্তারোপ মনগড়া। এসব মনগড়া শর্ত অচিরেই বাতিল জরুরী। বিবাহিত নারী শিক্ষকদের মানবিক বদলির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মার্চ মাসে বিভিন্ন স্মারকের মাধ্যমে নারী শিক্ষককে তাদের স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকার নিমিত্তে ঢাকার চাহিত স্কুলসমূহে সংযুক্তি (প্রেষণ) প্রদান করেন। এই সংযুক্তিকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। এতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দূরত্ব ও বিরহের কিছুটা সাময়িক লাঘব হলেও পুরোপুরি দুশ্চিন্তামুক্ত হননি তারা। তাদের সবসময়ই আশঙ্কাÑ কখন না আবার এই সংযুক্তি বাতিল হয়ে যায়। প্রধান শিক্ষক হতে প্রত্যয়নপত্র (উপস্থিত হাজিরা) সংগ্রহ করে স্ব স্ব উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসারের ফরওয়ার্ডিং সংগ্রহ করে আবার তা পূর্বের কর্মস্থলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা/থানা শিক্ষা অফিসে প্রেরণ করতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। ডাকযোগে বা অন্য কোন মাধ্যমে প্রত্যয়নপত্র প্রেরণ করা হলেও অনেক সময় সংশ্লিষ্ট শিক্ষা কর্মকর্তার অফিস পেয়েও না পাওয়ার ভান করে। আর এতে সমস্যা আরও প্রকট হয়। ভুক্তভোগীদের দাবি, সংযুক্তিরত নারী শিক্ষককে স্ব স্ব সংযুক্তরত স্কুলে স্থায়ী পদায়ন করা উচিত পরিবারের বৃহত্তর স্বার্থে। নারী শিক্ষকদের চাকরি ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকার অবমাননা ও বৈষম্যের বিষয়টি সাধারণ চোখে পড়ে না। নারী শিক্ষকদের কর্মস্থল হওয়া উচিত স্বামী-সন্তান ও শ্বশুর-শাশুড়ি যেখানে বসবাস করেন সেখানে। বদলি ও পদোন্নতি এবং বেতন বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করা যেমন অপরাধ, ঠিক তেমনি অপরাধ স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে সুখ ও শান্তির বলয় গড়তে বাধা প্রদান করা। এতে কর্মরত শিক্ষক সমাজে স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবনে ব্যাপক কলহের সৃষ্টি হয়ে ঘটবে বিবাহবিচ্ছেদ। আবার কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিতেও বাধ্য হবেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এরকম বাস্তবতাবিবর্জিত কালো বিধি-বিধান বাতিল করা আবশ্যক। কর্মজীবী শিক্ষকদের মধ্যে শতকরা প্রায় সত্তর ভাগ শিক্ষক হলেন নারী। কর্মরত নারী শিক্ষকদের চাকরিতে মনোনিবেশ ও সুরক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি আরও সক্রিয় হয়ে নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে নারী শিক্ষকরা উপকৃত হবেন। এগুলো হলোÑ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর নির্দেশে ১১ মার্চ ২০১৫ তারিখে ১৩৬ নম্বর স্মারকের মাধ্যমে জারিকৃত ঢাকা শহরে অবস্থিত বিভিন্ন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে সমস্ত নারী সহকারী শিক্ষককে সংযুক্তি প্রদান করা হয়েছে মানবিক কারণে তাদের সংযুক্তিরস্থলে স্থায়ীভাবে বদলি/পদায়নের আদেশ জারি করুন। বিবাহিত শিক্ষকগণকে তাদের স্বামীর কর্মস্থলের এলাকায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শর্তহীনভাবে বদলি করার আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকদের মধ্যে বেতন স্কেলের বৈষম্যমূলক পার্থক্য কমিয়ে এনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের বেতন স্কেল প্রধান শিক্ষকের স্কেলের এক গ্রেড নিচে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দুটি ইনক্রিমেন্ট প্রদানের ব্যবস্থা করুন। মাস্টার্স ডিগ্রীধারী শিক্ষকদের বিশেষ বিবেচনায় এনে পদোন্নতি প্রদানের ব্যবস্থা করুন। ঢাকা শহরে বর্তমানে যে সমস্ত সরকারী কোয়ার্টার রয়েছে তা কর্মচারীর সংখ্যার তুলনায় অপ্রতুল বিধায় শিক্ষকদের জন্য আলাদা সরকারী কোয়ার্টার তৈরি করুন। শিক্ষকদের স্কুলে আনা-নেয়ার জন্য যানবাহনের ব্যবস্থা করুন। পদমর্যাদা ভিন্ন ভিন্ন হলেও একই ধরনের শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন বেতন স্কেলের ক্রমধাপ বৈষম্য না রেখে একই স্কেলভুক্ত করুন। বিষয়গুলো মানবিক কারণে বিবেচনা করা সঙ্গত।
×