ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানী সৈনিক ক্যাম্পে নারী নির্যাতন;###;প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর জাপান এ দায় বহন করবে না- শিনজো আবে

ক্ষমা প্রার্থনার পরও চীন ও কোরিয়ার চাপের মুখে জাপান

প্রকাশিত: ০৬:৩২, ১৯ আগস্ট ২০১৫

ক্ষমা প্রার্থনার পরও চীন ও কোরিয়ার চাপের মুখে জাপান

নাজনীন আখতার ॥ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের জন্য জাপান ক্ষমা চাইলেও নারী নিগ্রহ ইস্যুতে চীন ও কোরিয়ার অব্যাহত চাপের মধ্যে রয়েছে। যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে এভাবে ক্ষমা প্রার্থনা ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করলেও ক্ষতিপূরণ না দেয়ার কোন ঘোষণা না থাকায় বিষয়টিকে অকার্যকর বলে মনে করছে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী সৈনিকদের ক্যাম্পে তাদের দেশের নারীদের ধর্ষণের ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবি আবারও তুলে এনেছে। দেশ দুটির মতে, ওই সময়ে নিগৃহীত নারীদের মধ্যে যারা বেঁচে আছেন তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিয়ে জাপান প্রমাণ করতে পারে তারা ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে সত্যিকারভাবেই আন্তরিক। এদিকে জাপানের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ওই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স এবং জার্মানির সৈনিকদের নারী ধর্ষণের অপরাধের বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে বিশ্ব গণমাধ্যমে। গত ১৪ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির ৭০তম বার্ষিকীতে নিহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণ করতে গিয়ে ক্ষমা চান জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। তবে তিনি তার বক্তব্যে জাপানী সৈনিকদের ‘কমফোর্ট ওমেন’ এর নামে নারী ধর্ষণের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধে অনেক নারীর সম্মান ও মর্যাদা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে’। এর আগেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন জাপানের পূর্ববতী সরকারগুলোও। তবে এবার শিনজো আবে স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, জাপানের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বার বারই ক্ষমা প্রার্থনার এ দায় বহন করবে না। জাপানের মতে, তাদের ওপর বার বার ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। কারণ যুদ্ধের সময় জাপানের নিরীহ জনগণও অপূরণীয় ক্ষতি ও ভোগান্তির শিকার হয়েছিল। ১৯৯৫ সালে যুদ্ধে কৃতকর্মের জন্য প্রথমবার ক্ষমা চায় জাপান। দিবসটি আসার আগেই জাপানের ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ আদায়ের বিষয়ে দাবি জানানো শুরু করে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া। সেখানে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো দাবি আদায়ের জন্য সভা ও অবস্থান কর্মসূচীও পালন করে। ওই সব নারীর সবাই মারা যাওয়ার আগে ক্ষতিপূরণ দেয়ার মাধ্যমে প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য জাপানের এটাই শেষ সুযোগ হতে পারে মন্তব্য করেন তারা। গত ২২ জুলাই দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে সৈনিকদের ধর্ষণের শিকার নারীদের স্মরণে তৈরি ‘কমফোর্ট ওমেন’ স্ট্যাচুর সামনে তারা সমবেত হন। ১৪ আগস্ট বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, জাপানের প্রধানমন্ত্রী পূর্ববর্তী সরকারগুলোর মতো ক্ষমা প্রার্থনা করলেও বক্তব্য রাখতে গিয়ে অনেক সতর্ক ছিলেন। তিনি স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, বিশ্ব এ ব্যাপারে আজীবনই জাপানের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার দাবি তুলতে পারে না। আর জাপানের ভবিষ্যত প্রজন্মও এভাবে ক্ষমা চাইতেই থাকবে না। তিনি বলেন, জাপানের বর্তমান জনসংখ্যার ৮০ শতাংশই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্ম নিয়েছে। তারা যুদ্ধে কিছু করেনি। অথচ তাদেরও অতীতের ইতিহাসের জন্য দায়ী হতে হয়। বিশ্লেষকদের মতে, জাপানের প্রধানমন্ত্রীর এ ক্ষমা প্রার্থনা শুধু চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর অব্যাহত চাপ নয়, বরং জাপানের জাতীয়তাবাদী চেতনায় বেড়ে ওঠা প্রজন্মকেও সন্তুষ্ট করার জন্য করা হয়েছে। ওই প্রজন্ম বার বার ক্ষমা প্রার্থনার চাপের ইতিহাস দেখতে অস্বস্তি বোধ করে। জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর প্রতিক্রিয়ায় চীনের উপ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঝ্যাং ইয়েসুই হতাশা প্রকাশ করে বলেন, যুদ্ধের ভুক্তভোগীদের জন্য জাপানের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়টির ব্যাখ্যা আরও স্পষ্ট এবং আন্তরিক হওয়া উচিত ছিল। তিনি বলেন, এশিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিশ্বাস অর্জনের জন্য এই ঘোষণা আরও সুস্পষ্ট ও কার্যকর হওয়া উচিত ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়ান বাইয়ুঙ্গ-সেও জাপানকে এ বিষয়ে কার্যকর ও আন্তরিক হওয়ার দাবি জানান। উল্লেখ্য, ১৯৯৫ সালে যুদ্ধে কৃতকর্মের জন্য প্রথমবার ক্ষমা চায় জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তমিচি মুরায়ামা। যুদ্ধাপরাধের এভাবে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি ওই সময়ে মাইলফলক হয়ে দাঁড়ায়। এরপর ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রী জুনিচিরো কইজুমি সেই ধারাবাহিকতায় ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। ১৪ আগস্ট হাওয়াইসহ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য অঞ্চলে যুদ্ধ শেষ হয়। নিউ অর্লিন্সে অবস্থিত জাতীয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ জাদুঘরের তথ্য অনুসারে ওই যুদ্ধে ১৫ মিলিয়ন বা দেড় কোটি সৈনিক এবং ৪৫ মিলিয়ন বা সাড়ে ৪ কোটি সাধারণ মানুষ নিহত হন। জাপান সরকারের তথ্য অনুসারে যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ২৩ লাখ সৈনিক ও ৮ লাখ সাধারণ নাগরিক নিহত হয়েছেন। দিনটিকে জাপান নিহতদের স্মরণে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ক্ষমা প্রার্থনার আগে তার বক্তব্য সংসদের নিম্ন কক্ষে বিল আকারে অনুমোদন পায়। তার বক্তব্য প্রচারের পর চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা মাইক্রোব্লগিং সার্ভিস উইবোতে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। ৩০ হাজার ব্যক্তি এতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানান। কেউ কেউ জাপানের এই ক্ষমা প্রার্থনাকে ‘ভুয়া’, ‘যুদ্ধে ধর্ষণের শিকার নারীরা তা মেনে নেবে না’ বলে জানায়। আবার কেউ কেউ সাধুবাদও জানিয়েছে জাপানকে। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া দক্ষিণ কোরিয়াতেও। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমা প্রার্থনার এক সপ্তাহ আগে দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে জাপানী দূতাবাসের সামনে একজন বিক্ষোভকারী দাবি আদায়ে গায়ে আগুন লাগিয়ে দেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ সে ধরনের বিক্ষোভকে উপেক্ষা করেছে বলে মনে করছেন অনেক কোরীয়। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানী সৈনিকদের ক্যাম্পে ধর্ষণের শিকার নারীদের নিয়ে ১৬ আগস্ট সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক ভিত্তিক প্রকাশনা কোয়ার্টজ। প্রতিবেদনে বলা হয়, কমফোর্ট ওমেনের নামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিকদের মনোরঞ্জনে জোরপূর্বক বাধ্য করা হতো নারীদের। জাপানের সৈনিকদের ধর্ষণের শিকার এমন এক চীনা নারী ঝ্যাং জিয়ানতুর কথা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। তিনি বর্তমানে বসবাস করছেন চীনের সাংজি প্রদেশে। যুদ্ধের সময় জাপানী সৈনিকরা যখন তাকে অপহরণ করে তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। ক্যাম্পে ২০ দিন তাকে যৌনদাসত্বের ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে কাটাতে হয়। একই প্রদেশের আরেক নারী রেন লানে যৌনদাসত্ব বরণ করতে বাধ্য হন ওই সময়ে। সৈনিকদের ক্যাম্প থেকে তার মা পরে তাকে উদ্ধার করেন। বিনিময়ে তাকে দিতে হয় বিপুল পরিমাণ চাল ও আটা। বয়োবৃদ্ধ রেন ও তার পরিবার চান অন্তত চীন সরকার যেন তাদের ক্ষতিপূরণ দেন। তারা দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। কোন ধরনের আর্থিক সহায়তা তারা এখন পর্যন্ত পাননি। দক্ষিণ কোরীয় কমফোর্ট ওমেন লী ওক-সানকে যখন জাপানী সৈনিকরা অপহরণ করে তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৭ বছর। বর্তমানে তার বয়স ৮৮ বছর। তাকে দেখাশোনারও কেউ নেই। তিনি এখন একটি বেসরকারী সংস্থার আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাস করছেন।
×