ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রবীর বিকাশ সরকার

গ্রামীণ বর্ষার জলস্মৃতি

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২০ আগস্ট ২০১৫

গ্রামীণ বর্ষার জলস্মৃতি

নাগরিক জলবায়ুতে বেড়ে ওঠা সেই কৈশোরে গ্রামীণ বর্ষার অনন্য রূপমাধুরী, জলস্নিগ্ধ সৌন্দর্যকে আবিষ্কার করার সুযোগ হয়েছিল। জন্মভূমি সিলেটের পল্লীগ্রামের বর্ষাকালীন জলস্মৃতি এখনও কত টাটকা সতেজ এবং রোমাঞ্চকর! মানসচক্ষে দেখতে পাই মাঠ-ঘাট-প্রান্তর-পুকুর-দীঘি-খাল কুশিয়ারা নদীর সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। চারদিকে ঘোলা থৈ থৈ ঢেউতোলা জলরাশি। জলের ওপর ভেসে আছে ছবির মতো গ্রামকে গ্রাম। অধিকাংশ খড়ের চালাঘর, মাঝেমাঝে ঢেউটিনের বাড়ি আর গাছগাছালি দিগন্তহীন জলরাশির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে জড়াজড়ি করে। এবাড়ি-ওবাড়ি, হাট-ঘাট-বাজার আর স্কুলে যাওয়ার বাহন শুধু নৌকা। সিলেট নিচুভূমি তাই আষাঢ় মাসেই অতিবৃষ্টির ফলে, বৃষ্টি না হলেও আসাম থেকে নেমে আসা জলের বন্যায় তলিয়ে যায় এই জেলাটি। বড় জেঠু এসে আমাকে নিয়ে যেত গ্রামের বাড়িতে বর্ষাযাপনের জন্য। বৃষ্টিবাদলপ্রিয় আমার কাছে বর্ষা যে অত্যন্ত প্রিয়ঋতু সেটা বাবা-মা জানত। তাই বাবাই জেঠুকে অনুরোধ করেছিল প্রতি বর্ষায় গ্রামে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তাছাড়া গ্রামের সন্তান বাবার প্রভাবই আমার ওপর পড়েছিল। ফলে বাবা ও জেঠুর কল্যাণে রাতের রেলে চড়ে সকালে নামতে হতো ফেঞ্চুগঞ্জ স্টেশনে। সেখান থেকে আফতাব কোম্পানির লঞ্চে সাগরের মতো অস্থির কুশিয়ারা নদীর ঘনঘোলা জল চিরে চিরে যেতে হতো বালাগঞ্জ থানা হয়ে কালিগঞ্জঘাটে। তীর ছুঁই ছুঁই জলওঠা ঘাটে আমাকে স্বাগত জানাত কয়েকটি কদমগাছ। আহা কী উজ্জ্বল সোনালি মাধুর্য নিয়েই না গুচ্ছ-গুচ্ছ কদমফুলগুলো বাদলা বাতাসে দুলে দুলে আমাকে বরণ করে নিত! কালিগঞ্জঘাট থেকে আবার নৌকায় করে সিন্দ্রাকোনা গ্রামে, ঠাকুরদার বাড়িতে। কয়েকটি বুনোছন আর টিনের চালাঘর নিয়ে একটি বড় পরিবার। আমাকে পেয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ কা-, কোথায় বসাবে, কী করবে অস্থির সবাই! আশপাশের বাড়ি থেকে লোকজন, ছেলেমেয়েদের উড়ে আসা আমাকে দেখার জন্য। এত কৌতূহলের কারণ শহুরে মানুষ বলে। তখন গ্রামে লোকসংখ্যাও ছিল কম তাই আদরযতœ, পারস্পরিক আদানপ্রদান, ভাববিনিময় ছিল প্রগাঢ়। মানুষের বিশ্বাস ছিল। শিক্ষার আলো না থাকলেও গ্রামীণ মানুষের নীতিজ্ঞান ছিল অত্যন্ত প্রখর। আতিথেয়তার তো কোন তুলনা ছিল না গ্রামবাংলায়। পূর্ববাংলার আতিথেয়তা তো এখনো উপমহাদেশ কেন বিশ্বব্যাপী বহুশ্রুত প্রশংসিত ব্যাপার। কত বাড়িতে যে গিয়েছি বেড়াতে তার হিসেব নেই! প্রতিটি বাড়ি উঁচু ভূমিতে অবস্থিত বন্যা থেকে রক্ষা পাবার জন্য। প্রতিটি বাড়িরই পরিবেশ নানা জাতের বড় বড় আম, জাম, ডুমুর, কাঁঠাল, চাঁপা, হিজল, কদম, বেতস, অশ্বত্থ, নিম আর বাঁশের ঝোপ-ঝাড়কে জড়িয়ে থাকা নিবিড় বুনো গাছগাছালি-লতাপাতার নিঃশব্দ মায়াজালে জড়ানো। প্রায় প্রতিটি বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে একটি শান্ত শাপলা-কলমিফোটা পুকুর তার চারপাশে ঘনসবুজ রঙা বেতের জঙ্গল। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে মূত্রাগাছ। নির্গন্ধ সাদাফুল ফোটা এই গাছ কেটে চিকন-চিকন ফালি করে চিরে রোদে শুকিয়ে তারপর শীতলপাটি তৈরি করা হয়। এটা সিলেটের ঐতিহ্য। আবার পাটকাঠি, বুনোছন, ডাঁটাশাক, হাল্কা পণ্যসামগ্রী বাঁধা; হাট থেকে কেনা মাছ বেঁধে ঝুলিয়ে আনার জন্যও ব্যবহৃত হয়ে থাকে এই কাঁচা বেতের ফালি। জানি না এই রীতি এখনও প্রচলিত আছে কিনা। টোকিও, জাপান থেকে
×