ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আহমেদ উল্লাহ

রূপময়ী বর্ষা

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ২০ আগস্ট ২০১৫

রূপময়ী বর্ষা

ফসলের মাঠ, বিলের জলে ফুটে থাকা শ্বেত-হলুদের শাপলাগুলো যেন বর্ষা-শাড়ির জমিনে আঁকা আলপনা। গোধূলি লগনে অস্তগামী সূর্যটি যেন কিশোরীর ললাট রাঙ্গানো লাল টিপের শোভায় মাতিয়ে তোলে গ্রামটিকে! তিতাস নদীটি আরেক স্বর্গীয় সৌন্দর্য নিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে জয়পুর গ্রামের পাশঘেঁষে। বহুদূর থেকে ঢেউগুলো গলাগলি করে এসে আছড়ে পড়ে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে। নদীর ঢেউগুলো ঝুমকাপরা নর্তকীর মতো রুনুঝুনু বাদ্য বাজিয়ে নৃত্যে মেতে ওঠে! নদীটি যেন গ্রামের এক অনন্য আশীর্বাদ। নদীর বুক বেয়ে নিত্য ছুটে চলে অগণিত বিচিত্র নৌযান। বাউলের মনোহরী সুর ধরে মাঝি-মাল্লারা যখন পালতোলা নৌকা বেয়ে যায়, তখন মনে হয় গ্রামটি যেন স্বর্গ থেকে ছিন্নœ হয়ে এসেছে। বিকেল হয়ে এলেই বর্ষার নবীন জলের ঢেউয়ে ঢেউয়ে কিশোর-কিশোরীরা মহানন্দে ভেসে বেড়ায় নৌকায় চড়ে। কেউবা শাপলা কুড়াবার নেশায় মত্ত হয়ে বিলের বুকে পাড়ি জমায়। গাঁয়ের এমন রূপময়ী বর্ষা যেন প্রকৃতির এক অনন্য দান। বাস্তবে উপলব্ধি না করলে বিশ্বাস হওয়ার নয়। গ্রামের কদমগাছগুলো তখন ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। আর পাড়ার ছেলেমেয়েদের হিড়িক পড়ে যায় কদমতলে! মাঝে মাঝে গভীর রাতে বাতাসে ভেসে আসে ছাতিমের অনাঘ্রাত সুঘ্রাণ! বর্ষার পূর্ণিমা চাঁদের অপরূপ জ্যোৎ¯œা ভাবুককে ঘর থেকে টেনে নিয়ে আসে বাইরে। নদীর তীরে বসে কেউবা বাঁশি বাজায়, কেউবা বিচ্ছেদের সুরে গান ধরেÑ ‘মনোমাঝিরে দেহতরী ভিড়বে কবে ঘাটে; ভবসিন্ধুর ঢেউ-তুফানে পড়েছি সংকটে ॥’ গ্রামের কৃষকদের তখন কাজ থাকে না। পুরো বর্ষাটাই তাদের অবসরকাল। এ সময়ে গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় বসে বাউলের আসর, পল্লীগীতি এবং যাত্রাপালা। এমনকি সয়ফুল মুল্ক বদিউজ্জামানের কিচ্ছার ধুম পড়ে যায়। রাত জেগে কৃষাণ-কিষাণিরা হাসি-কান্নায় দুলে দুলে উপভোগ করে এসব গ্রাম্য নাটক। কখনও সুযোগ পেলে চোরের দল এসে ঘরের সিঁদ কেটে হানা দেয় কৃষকের ঘরে। সে ভয়ে অনেকেইে রাত জেগে পাহারা দেয় সঞ্চিত খাদ্যের। বর্ষার বৃষ্টিমুখর দিনগুলো যদিও বড়ই বিরক্তিকর, তবুও ঘরে বসে গরম খিচুড়ির স্বাদ আস্বাদন করার আনন্দটা বড়ই উপভোগ্য! তাছাড়াও রয়েছে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। প্রতিবছর কাঁঠালিয়ায় আয়োজন হয় জমজমাট নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচিত্র গড়ন-বরণের নৌকা নিয়ে এসে হাজির হয় প্রতিযোগীরা। নদীর দুই কূল থাকে লোকে লোকারণ্য! অসীম আনন্দে গ্রামের মানুষ উপভোগ করে নৌ-দৌড় প্রতিযোগিতা। গ্রামে বর্ষার এমন নান্দনিক রূপলীলা বিশ্বে বিরল। বর্ষায় গ্রাম তো গ্রাম নয়, যেন অদেখা কোন এক নন্দন পার্ক! মন বলেÑ মরেও যেন আবার ফিরে আসি এমনই কোননা কোন এক গ্রামের পাশঘেঁষা নদীর তীরে! গাঁয়ের পাশঘেঁষে নৌকায় চড়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দে মেতে ওঠে, আসলেই মনে হয় এ যেন এক অন্যরকম স্বর্গ! অন্যরকম বাংলাদেশ! হোমনা, কুমিল্লা থেকে
×