ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

র‌্যাবের দীর্ঘ অনুসন্ধানে চাঞ্চল্যকর তথ্য;###;বিএনপিপন্থী আইনজীবীত্রয় বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক এ্যাকাউন্টে গোপনে অর্থায়ন করেছেন;###;এ অর্থায়নে গড়ে উঠেছে শহীদ হামজা ব্রিগেড;###;এ ব্রিগেডের মাধ্যমে জঙ্গী প্রশিক্ষণ হতো- যার তাত্ত্বিক নেতৃত্ব দিচ্ছিল হাটহাজারী আবু

সুপ্রীমকোর্টের ৩ আইনজীবী গ্রেফতার ॥ জঙ্গী অর্থায়ন ফাঁস

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২০ আগস্ট ২০১৫

সুপ্রীমকোর্টের ৩ আইনজীবী গ্রেফতার ॥ জঙ্গী অর্থায়ন ফাঁস

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম ভিত্তিক দুর্ধর্ষ জঙ্গী সংগঠন ‘শহীদ হামজা ব্রিগেড।’ দেশী-বিদেশী গোপন অর্থায়নে এ সংগঠনের পতাকাতলে জঙ্গীপনায় উদ্বুদ্ধদের একটি অংশ সমবেত হয়ে ক্রমশ ডালপালা বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। এ সংগঠনের তৎপরতা নিয়ে র‌্যাবের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর ঘটনা। হামজা ব্রিগেডকে এগিয়ে নেয়ার তৎপরতার সঙ্গে জড়িত অনেকের ব্যাংক একাউন্ট পর্যালোচনা শেষে সুপ্রীমকোর্টের এক ব্যারিস্টারসহ তিন আইনজীবীর অর্থায়নের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হওয়ার পর চট্টগ্রাম র‌্যাব সেভেন মঙ্গলবার রাতে ঢাকার ধানমণ্ডি থেকে এ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা, এ্যাডভোকেট হাসানুজ্জামান লিটন ও এ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপন। ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বিএনপির সাবেক হুইপ ও এমপি এবং দলের বর্তমান কেন্দ্রীয় তথ্য গবেষণা সম্পাদক সৈয়দ ওয়াহিদুল আলমের জ্যেষ্ঠ কন্যা। এছাড়া শাকিলা ফারজানা বিএনপি সমর্থিত আইনজীবী ফোরামের যুগ্ম সম্পাদক। গ্রেফতারকৃত এ্যাডভোকেট হাসানুজ্জামান লিটন ও এ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপন তার সহকারী বলে র‌্যাব সূত্রে জানানো হয়েছে। এ তিন আইনজীবীকে গ্রেফতারের পর রাতেই র‌্যাবের কড়া প্রহরায় রওনা দিয়ে তাদেরকে বুধবার সকাল নাগাদ চট্টগ্রাম র‌্যাব সেভেন সদর দফতরে নিয়ে আসা হয়। এরপর তাদের সরাসরি বাঁশখালী আদালতে সোপর্দ করা হয়। র‌্যাবের পক্ষ থেকে গ্রেফতারকৃতদের ৭ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করা হলে আদালত ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে। এর পাশাপাশি গ্রেফতারকৃতদের জামিন প্রার্থনা করা হলে বাঁশখালি সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সাজ্জাদ হোসেনের আদালত তা নাকচ করে দেন। এর আগে বুধবার দুপুর বারোটা নাগাদ র‌্যাবের পক্ষ থেকে সাংবাদিক সম্মেলন আয়োজন করে এদের গ্রেফতারের বিস্তারিত বর্ণনা দেন র‌্যাব সেভেনের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ তিন আইনজীবীকে বাঁশখালীর লটমনি পাহাড় থেকে গত ২২ ফেব্রুয়ারি জঙ্গী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে বিপুল অস্ত্র উদ্ধারের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। জঙ্গী সংগঠন হামজা ব্রিগেড নেতাদের এ্যাকাউন্টে অর্থায়নের যে তথ্য মিলেছে তা নিয়ে পরবর্তীতে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। র‌্যাব সেভেন প্রধান জানান, হামজা ব্রিগেডের বিভিন্ন নেতার পৃথক পৃথক এ্যাকাউন্টে মোট ১ কোটি ৩৮ লাখ ৭০ হাজার টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে। আদালত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে উদ্ঘাটিত হয় অর্থায়নের বিষয়টি। এরমধ্যে এ তিন আইনজীবীর মাধ্যমে হামজা ব্রিগেড নেতাদের এ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। তাদের সঙ্গে আল্লামা লিবাদি নামের দুবাইয়ের এক নাগরিকের প্রদত্ত অর্থের সন্ধানও মিলেছে। র‌্যাব প্রধান জানান, ব্যাংক এ্যাকান্ট পর্যালোচনায় বেরিয়ে এসেছে হামজা ব্রিগেড নেতাদের এ্যাকাউন্টে দু’দফায় ২৫ ও ২৭ লাখ টাকা করে ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা দিয়েছেন। এ্যাডভোকেট হাসানুজ্জামান লিটন ৩১ লাখ ও এ্যাডভোকেট মাহফুজ চৌধুরী বাপন দিয়েছেন ২৫ লাখ টাকা করে। এসব অর্থ নগদেই জমা হয়েছে। এত বিপুল পরিমাণ অর্থ হামজা ব্রিগেডের নেতাদের এ্যাকাউন্টে জমা হওয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হওয়ার পর অর্থায়নকারীদের পরিচয় নিশ্চিত হয়েই র‌্যাব মঙ্গলবার রাতে ঢাকা ধানম-িতে অভিযান চালিয়ে এই তিনজনকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রামে নিয়ে আসে। গ্রেফতারকৃতদের সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করা হয়নি। তবে প্রজেক্টরের মাধ্যমে তাদের ছবি দেখানো হয়েছে এবং জঙ্গী সংগঠন হামজা ব্রিগেডের জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত থাকার কিছু প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, গ্রেফতারকৃত ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জ এলাকার ব্যবসায়ী মোঃ বাহার উদ্দিনের স্ত্রী। এ্যাডভোকেট হাসানুজ্জামান লিটন কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা থানার কুচিয়ামোড়া গ্রামের মৃত আবদুর রাজ্জাকের পুত্র। তিনি মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার সি ব্লকের ১২নং লেনের ২ নম্বর বাসায় থাকেন। এছাড়া এ্যাডভোকেট মাহফুজুর রহমান চৌধুরী বাপন মিরপুর-২ এর বড়বাগ এলাকার ৩১/৩বি এর বাসিন্দা মৃত মফিজ উদ্দিনের পুত্র। জঙ্গী সংগঠন হামজা ব্রিগেড নিয়ে তথ্য ॥ জঙ্গী সংগঠন শহীদ হামজা ব্রিগেড আত্মপ্রকাশ করে ২০১৩ সালের নবেম্বরে। গ্রীন ব্লু এবং হোয়াইট এ ব্রিগেডের তিনটি সামরিক উইং রয়েছে। প্রতিটি উইংয়ে ৭ জন করে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সদস্য রয়েছে। তিনটি সামরিক উইংয়ের দুটির প্রধান মোঃ মাসুদ ওরফে ডন এবং মোঃ আজিজ ওরফে তারেক ২০১৩ সালের ৪ এপ্রিল গ্রেফতার হয়। এ জঙ্গী সংগঠনের সদস্যদের অধিকাংশ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ছাত্র। গত ১২ এপ্রিল হাটহাজারী আবুবকর মাদ্রাসা ও ২১ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর লটমনি পাহাড় ও ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর হালিশহর এলাকা থেকে এ পর্যন্ত যে ২৪জন গ্রেফতার হয়েছে এরা সবাই হামজা ব্রিগেডের সদস্য। র‌্যাবের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, হাটহাজারী আবু বকর মাদ্রাসাটি এ সংগঠনের তাত্ত্বিক ও বাঁশখালীর লটমনির গহীন পাহাড়ে সামরিক প্রশিক্ষণের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছিল। এ সংগঠনটি আত্মপ্রকাশের পর থেকে র‌্যাব সেভেনের একটি চৌকস দলের আদ্যোপান্ত উদ্ঘাটনে তৎপরতা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর সাধনপুর ইউনিয়নের দুর্গম লটমনি পাহাড়ে আবিষ্কৃত হয় জঙ্গী আস্তানা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। র‌্যাবের অভিযানে উদ্ধার হয় একে-২২ রাইফেলসহ বিপুলসংখ্যক অস্ত্র, গোলা বারুদ ও সামরিক সরঞ্জাম। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৩টি একে-২২, ছয়টি বিদেশী পিস্তল, একটি রিভলবার, তিনটি দেশে তৈরি বন্দুক, ৬টি একে-২২ ম্যাগাজিন ও ৭৬১টি গুলি। এছাড়া আরও উদ্ধার হয় ৩টি চাপাতি, ২টি ওয়াকিটকি, মার্শাল আর্টের সরঞ্জাম, জঙ্গল বুট ও ৩৮ সেট প্রশিক্ষণলাভের পোশাক। এর আগে ১৯ ফেব্রুয়ারি হাটহাজারীর আল মাদ্রাসাতুল আবু বকর থেকে গ্রেফতার করা হয় ১২ জঙ্গী। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে বেরিয়ে আসে বাঁশখালীর জঙ্গী প্রশিক্ষণের এ কেন্দ্রের তথ্য। বাঁশখালীর এ আস্তানা থেকে গ্রেফতার হয় মোঃ মোবাশ্বের হোসেন, মোঃ আবদুল খালেক, আমিনুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান ও আমীর হোসেন নামের ৫ জঙ্গী। এদের বাড়ি ফরিদপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলে। আস্তানাটি গড়ে তুলেছিল মৌলানা মোবারক নামের এক জঙ্গী নেতা। তার সহযোগী ছিল আজিজ। এদের এখনও ধরা যায়নি। হাটহাজারীর আল মাদ্রাসাতুল আবু বকর থেকে জঙ্গীদের গ্রেফতারের সময় বেশকিছু জিহাদী ও জঙ্গী বিষয়ক বই, সফট কপি, অডিও ভিডিও উদ্ধার হয়। হাটহাজারী উপজেলার আলীপুরের সুলতান আহমেদ সড়কের এসকে সখিনা ভবনের চতুর্থ তলায় মাদ্রাসাটির অবস্থান। এ মাদ্রাসা থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গীরা হচ্ছে আবদুর রহমান ইবনে আসাদ উল্লাহ, ওসমান গনি, মোস্তাকিম বিল্লাহ মাশরুর, মোঃ নাবিল হোসাইন, মোঃ সিরাজুল মুস্তফা সোলায়মান, শামীম হোসাইন ইসমাইল, মাহমুদুল হাসান, মোঃ ইউসুফ, সফিকুল ইসলাম শেখ সালাউদ্দিন, রফিকুল ইসলাম যুবায়ের, আবদুল কাইয়ুম শেখ মানসুর ইসলাম ও হারুনুর রশীদ। এ ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ ২৮ ফেব্রুয়ারি নগরীর হালিশহর এলাকা থেকে গ্রেফতার হয় কয়েকজন জঙ্গী। ৫ ব্যাংক এ্যাকাউন্ট ॥ র‌্যাবের অনুসন্ধানে এ পর্যন্ত শহীদ হামজা ব্রিগেড নামের সংগঠনটির বিভিন্ন সদস্যের নামে ৫টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য মিলেছে। র‌্যাব সেভেনের সিও জানিয়েছেন, এসব এ্যাকাউন্ট নিয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। তিনি জানান, সুনির্দিষ্ট কোন এ্যাকাউন্ট থেকে জঙ্গীদের কাছে টাকা যেত না। তবে হুন্ডির মাধ্যমে আসা নগদ টাকা এসব ব্যাংক এ্যাকাউন্টে রাখা হতো। হুন্ডির মাধ্যমে এ জঙ্গী সংগঠনকে কারা কারা অর্থায়ন করে আসছে তার তদন্ত চলছে। প্রসঙ্গত, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশে বিভিন্ন সংগঠনের কাছে বিদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থের যোগান আনছে নিয়মিত। এ অর্থের মাধ্যমে এরা গোপন ঘাঁটি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তুলেছে এবং এর বিস্তৃতি ঘটছে। এছাড়া এ অর্থ দিয়ে এরা চোরাপথে অস্ত্র যোগাড় করছে। র‌্যাব সূত্রে জানানো হয়, বাঁশখালীর লটমনি জঙ্গী আস্তানা থেকে যে একে-২২ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছে তা দেশের কোন নিরাপত্তা বাহিনী ব্যবহার করে না। ওই আস্তানা থেকে গ্রেফতারকৃত জঙ্গী মোজাহের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছিল, ভারতের মিজোরাম সীমান্ত দিয়ে একে-২২ রাইফেল চীন থেকে আনা হয়েছে। প্রতিটি রাইফেল প্রায় পৌনে তিন লাখ টাকা এবং প্রতিটি পিস্তল প্রায় সোয়া এক লাখ টাকা হারে কেনা। ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর ॥ গ্রেফতারকৃত তিন আইনজীবীকে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বাঁশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ সাজ্জাদ হোসেনের আদালতে সোপর্দ করা হয়। র‌্যাবের পক্ষে আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমান্ড প্রার্থনা করা হয়। র‌্যাবের পক্ষে এএসপি রুহুল আমিন আদালতকে জানান, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রয়োজনীয় তথ্য উদ্ঘাটন করার জন্য রিমান্ড প্রয়োজন। এ সময় আসামি পক্ষের আইনজীবীরা রিমান্ডের বিরোধিতা করেন এবং জামিন প্রার্থনা করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত আসামিদের জামিন নাকচ করে দিয়ে ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ সময় আসামি পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন এ্যাডভোকেট এআরএম তকসিমুল করিম।
×