ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুনতাসীর মামুন

কেন শেখ হাসিনাকে হত্যা ও ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা বার বার করা হয়?

প্রকাশিত: ০৪:১১, ২১ আগস্ট ২০১৫

কেন শেখ হাসিনাকে হত্যা ও ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা বার বার করা হয়?

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার কথা মনে হলে, প্রথমেই আমার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের কথা মনে হয়। তিনি ছিলেন আমার বাবার বন্ধু, ইতিহাসের ছাত্র। আমার বাবাও ছিলেন ইতিহাসের। আমিও। আমি তাঁকে ডাকতাম চাচা বলে। খুবই স্নেহ করতেন আমাকে। দূর সম্পর্কের এক ধরনের আত্মীয়তাও আছে আমাদের। ১৯৭২ সালে, ধানম-িতে আমি যে বাসায় থাকতাম তার উল্টোদিকের বাসায় থাকতেন তিনি ও তাঁর স্ত্রী আইভি রহমান। দুটি ছেলে-মেয়ে বিকেলে লনে খেলা করত। তাদের একজন পাপন এখন এমপি। এত সুখী দম্পতি খুব কম দেখা গেছে। গ্রেনেড হামলায় তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর জিল্লুর রহমান একেবারে ভেঙ্গে পড়েন শারীরিক ও মানসিকভাবে। গ্রেনেড হামলার পর যে ছবি টিভিতে বারবার দেখিয়েছে, তা’হলো আইভি রহমান রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। কিন্তু অনিন্দ্যস্নিগ্ধ মুখটি অক্ষত, চাহনি নিষ্পলক। গ্রেনেড বর্ষণের আগের মুহূর্তে তাঁকে ট্রাকে উঠতে বলা হয়েছিল, তিনি ওঠেননি। আরেকটি তরুণী, টানাটানা চোখ, অবাক চাহনি, নিস্পন্দ। দূরে দুই যুবকের লাশ। ঐ দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। আইভি রহমান ছাড়া যাঁর জীবন ছিল অসম্পূর্ণ সেই জিল্লুর রহমানেরও সেদিন এক ধরনের মৃত্যু হয়েছিল। ঐ দিন বিকেলে আমি গাড়ি করে যাচ্ছি, উল্টোদিক থেকে গাড়িতে আসছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। আমাকে দেখে মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘সব শেষ, নেত্রীকে শেষ করে দিচ্ছে’, এরকম কিছু একটা। উদভ্রান্ত চেহারা। গাড়ি চলে যায়। আমি তখনও বুঝতে পারিনি, নিজ গন্তব্যে গেলাম। খোঁজখবর করতে লাগলাম, অস্পষ্ট চিত্র। বিকেলে টেলিভিশনে এর ভয়াবহতা বোঝা গেল। পরবর্তীকালে শুনেছি, বিএনপি আশঙ্কা করছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মানুষজন নেমে আসবে। তাদের অফিস, নেতৃত্বাধীন দোকানপাট পুড়িয়ে দেবে, তছনছ করে দেবে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি দেখে তারা নিশ্চিত হয়েছে এবং পরবর্তীকালে গ্রেনেড হামলা মামলা অন্যদিকে নিয়ে গেছে। বিএনপি চিন্তিত ছিল কেন? কারণ, অনেকেই জানত এটি বিএনপি-ই করিয়েছে। যদিও প্রমাণ তখনও কেউ করেনি। কিন্তু নিজামী-খালেদা ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর তাদের কর্মকা-ে ধারণা হয়েছিল তারা শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। না, কেউ নামেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় ও ধরনে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল অনেকে, ভয়ও পেয়েছিল। ঠিক ১৯৭৫ সালেও তাই হয়েছিল। রাজনৈতিক দল এককেন্দ্রিক হয়ে গেলে এবং সামষ্টিক নেতৃত্ব গড়ে না উঠলে, এ ধরনের ঘটনায় দলীয় নেতাকর্মীরা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। গ্রেনেড হামলায় নিহত হয়েছিলেন ৩৯/৪০ জন আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থক। আহত হয়েছিলেন প্রায় ৪০০। ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ট্রাকের ওপর শেখ হাসিনা বক্তৃতা শুরু করলে বঙ্গবন্ধু এ্যাভিনিউর চারদিকের উঁচু ভবন ও গুলিস্তানের রাস্তা থেকে গ্রেনেড বর্ষণ শুরু হয়। শেখ হাসিনার চারপাশে নেতারা তাঁকে ঘিরে মানবঢাল তৈরি করেন। তারপর গাড়িতে উঠিয়ে সরিয়ে নেন। তাঁর গাড়িতেও গুলিবর্ষণ করা হয়েছিল। কানে তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন তা এখনও সারেনি। পরদিন গেছি বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের দেখতে। মেডিক্যালে এক কক্ষে দেখি অনেক নারী কর্মী আহত হয়ে গাদাগাদি করে শুয়ে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন অনেকে। এর মাঝে আমাকে একজন প্রশ্ন করলেন, ‘নেত্রী ঠিক আছেন তো’? নেত্রীর প্রতি তৃণমূলের এই ভালোবাসা একেবারে অকৃত্রিম, এতে কোন খাদ নেই, চাওয়া পাওয়ার ব্যাপার নেই, অথচ এরা সব সময়ই নেতাদের দ্বারা উপেক্ষিত। আওয়ামী লীগ এরাই বাঁচিয়ে রেখেছেন। নেত্রী একটু কথা বললে, হাসলে মাথায় হাত রাখলেই খুশি। এই মনোভাব উপরের দিকের অধিকাংশেরই নেই। এবং এ কথাটি অতি সত্যি। সেখানে সবকিছু চলে লেনদেনের ভিত্তিতে। এই হামলার পর আমিও গেছি একদিন সন্ধ্যায় বিরোধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে। ফিরে আসার সময় তাঁর সামনে মাথা নিচু করে কথা বলে বিদায় নিচ্ছি। তিনি মাথায় হাত রাখলেন, চোখে পানি। আসলে এই অশ্রুজলে জিজ্ঞাসাটা ছিলÑ কেন তাঁর পরিবার ও তাঁর প্রতি বিরোধীদের এত আক্রোশ? কেন তাঁকে বারবার হত্যার চেষ্টা? এই জিজ্ঞাসা শুধু তাঁর নয়, আমাদের অনেকেরই। আমরা কি কখনও ভেবেছি কেন তাঁকে বারবার হত্যার চেষ্টা করা হয়? অন্য অনেক নেতাও তো ১৯৭৫ সালের পর সৃষ্টি হয়েছেন। কই খালেদা জিয়া, গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী বা হেজাবিদের বিভিন্ন নেতা, যাদের অনেকে ১৯৭১ সালের খুনখারাবিতে মেতেছিলেন, তাদের কাউকে কখনও হত্যার প্রচেষ্টা নেয়া হয়নি? এমনকি বীর মুক্তিযোদ্ধারাও কখনও মানবতাবিরোধী কোন নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। পাঠক, আওয়ামী লীগের সমর্থক না হোন নিজেকেই একবার এ প্রশ্নটি করুন দেখি। দুই. ১৯৭৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি ঢাকায় থাকতেন তবে নিশ্চিত হত হতেন। বেঁচেছিলেন বলে আজ আমরা নিশ্চিন্ত হয়েছি খানিকটা হলেও। বঙ্গবন্ধুকে খুনের সময় খুনীরা হাসিনার কথা তেমন ভাবেননি। তারপর তিনি ভারতে থেকেছেন এবং জিয়ার আমলের শেষের দিকে দেশে ফিরতে পেরেছেন। জিয়া তাঁকে আসতে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কারণ তখন তার পাকিস্তানীকরণের পরিকল্পনা সবার জানা হয়ে গেছে এবং তিনি যে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চান বা বিভক্ত করে রাখতে চান তাও অজ্ঞাত নয়। তিনি ভেবেছিলেন গৃহবধূ হাসিনা এসে চুপচাপ গৃহকর্মে নিয়োজিত থাকবেন, ভয়ে কথাবার্তা বলবেন না, আওয়ামী লীগের সংস্পর্শে থাকলেও আওয়ামী লীগাররা তাঁকে দলের নেতৃত্বে পৌঁছুতে দেবে না। জিয়ার ইমেজ তাতে উজ্জ্বল হবে। শেখ হাসিনা এসেই আওয়ামী লীগের হাল ধরলেন। ১৯৮১ থেকে ধরলে তাঁকে কমপক্ষে ২১ বার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। কয়েকটি বিবরণ দেয়া যাক : ১. ১৯৮৭ সালের ১০ নবেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সমাবেশ চলাকালে জিরো পয়েন্টে তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। নূর হোসেন এতে শহীদ হন। জেনারেল এরশাদ তখন ক্ষমতায়। ২. ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন জনসভা করতে। জনসমাবেশ করতে যাওয়ার সময় মিছিলে হামলা হয়। তাঁর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয় বৃষ্টির মতো। ১৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। যিনি এই গুলি চালানোর দায়িত্বে ছিলেন তিনি এখন চট্টগ্রামে পুলিশের একজন বড় কর্তা। চট্টগ্রামে এক সভায় দু’জন বক্তা এ কথা উল্লেখ করে আক্ষেপ করেছিলেন। সেই মামলার বিচার আজ ২৭ বছর পরও শেষ হয়নি। আমাদের পুলিশ কত দক্ষ! এবং আওয়ামী লীগ কত সফল! সেই সময় জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায়। ৩. ১৯৮৮ সালের ১৫ আগস্ট ফ্রিডম পার্টির অস্ত্রধারীরা ধানম-ির ৩২ নম্বরে গ্রেনেড ও গুলি ছোড়ে শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য। তিনি বেঁচে যান। সেই মামলার খবর কেউ জানে না। জেনারেল এরশাদ সেই সময় ক্ষমতায়। ৪. ১৯৯১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সংসদীয় উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে গেলে তাঁকে গুলি করা হয়। অল্পের জন্য বেঁচে যান। এটি নিয়ে মামলা হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। ক্ষমতায় সেই সময় খালেদা জিয়া। ৫. ১৯৯৪ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সময় ট্রেনে করে যাওয়ার সময় ঈশ্বরদীতে তাঁর কামরা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। মামলার খবর জানা যায়নি। খালেদা জিয়া তখন ক্ষমতায়। ৬. ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের জনসভায় তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। মামলার কোন খবর নেই। ক্ষমতায় তখন খালেদা জিয়া। ৭. ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে এক অনুষ্ঠান থেকে বের হওয়ার সময় গুলি করা হয় তাঁকে। মামলার খবর নেই। ক্ষমতায় তখন খালেদা জিয়া। ৮. ২০০০ সালের ১৩ জুলাই ফরিদপুরে শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ হয়। একজন নিহত ও সাতজন আহত হন। এই সময়ই এ কারণে হুজির নেতা মুফতি হান্নান ও মুফতি কামাল উদ্দিন ও ফ্রিডম পার্টির নবাব শরিফকে গ্রেফতার করা হয়। ক্ষমতায় তখন শেখ হাসিনা। উল্লেখ্য, খালেদা-নিজামী ক্ষমতায় আসার পর ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা’ দেখিয়ে ঐ তিনজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ৯. ২০০০ সালের ২০ জুলাই গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় হেলিপ্যাড ও জনসমাবেশস্থ’ল থেকে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা উদ্ধার করা হয়। ঐ বোমা বিস্ফোরিত হলে পুরো সমাবেশস্থল নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। হুজি এই পরিকল্পনা করেছিল। হুজি জামায়াতসংলগ্ন বলে পরিচিত। শেখ হাসিনা তখন ক্ষমতায়। ১০. ২০০১ সালের ৩০ মে খুলনায় রূপসা সেতু উদ্বোধনে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৭ মে সেতুর কাছে দুটি নৌকায় ১৫ জন হুজি সদস্য ধরা পড়ে। মামলা হয়েছিল কিন্তু খালেদা-নিজামী ক্ষমতায় আসার পর আসামিরা সবাই জামিনে বেরিয়ে যান। তদন্ত আর নিশ্চয়ই হয়নি। ১১. ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক আমলে শেখ হাসিনা সিলেটে নির্বাচনী প্রচারে যান। হুজি তখন তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে। দু’জন জঙ্গী মারা যায়। মামলা হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। বিএনপি-জামায়াত সমর্থক লতিফুর রহমান তখন ক্ষমতায়। ১২. ২০০৩ সালের ৩০ আগস্ট সাতক্ষীরার কলারোয়াতে জনসভা করতে যাচ্ছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর গাড়িবহরে বিএনপি-জামায়াতকর্মীরা যৌথভাবে আক্রমণ করে। মামলার খবর জানা যায়নি। ক্ষমতায় তখন খালেদা জিয়া ও মতিউর রহমান নিজামী। ১৩. ২০০৪ সালের ২ এপ্রিল বরিশালের গৌরনদীতে গুলিবর্ষণ করে জামায়াত-বিএনপির ক্যাডাররা। এ বিষয়ে মামলা হয়েছিল কিনা জানা যায়নি। তখন ক্ষমতায় ছিলেন খালেদা জিয়া ও নিজামী। ১৪. ২০১১ সালে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার যারা জঙ্গীবাদ অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের পক্ষে তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার এক চক্রান্ত করে যার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মেজর ডালিম [বিস্তারিত, প্রথম আলো ৩.৭.২০১৫] এই ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হয় ও জড়িতদের শাস্তি দেয়া হয়। ১৫. ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। [কালের কণ্ঠ, ২০.৮.২০১৪ ও প্রথম আলো ২১.৮.২০১৪] আরও আছে যা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। চলবে...
×