ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বুড়িগঙ্গায় মাছ মিলছে, দূষণ কমেছে

প্রকাশিত: ০৫:০৯, ২২ আগস্ট ২০১৫

বুড়িগঙ্গায় মাছ মিলছে, দূষণ কমেছে

শাহীন রহমান ॥ দখল দূষণের ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা আজ মৃত। কিন্তু হঠাৎ করেই মরা নদীতে মিলছে মাছের সন্ধান। জেলেরা জাল পেতে বুড়িগঙ্গা থেকে প্রতিদিনই ধরছে মাছ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন বর্ষায় পানি বেশি হওয়ার কারণে দূষণের পরিমাণ অনেক কম রয়েছে। এ কারণেই এই মৌসুমে দেখা মিলছে মাছের। তারা বলেন, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা চার নদী সারা বছরই দখল, দূষণ মুক্ত করা গেলে নদীতে মাছ ফিরে আসত। জেলেরা ফিরে পেত তাদের জীবিকা। সরকার এ বিষয়ে আন্তরিক হলে বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বর্ষায় পানি বেশি হওয়ায় জেলেরাই এখন পানিতে জাল ফেলে মাছ ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত। বিশেষ করে বর্ষায় নদীতে পানির পরিমাণ বেশি হওয়ায় কামরাঙ্গিরচর পোস্তাগোলা এলাকায় অনেকেই মেতেছেন মাছ ধরার উৎসবে। তাদের জালে ধরা পড়ছে দেশীয় অনেক প্রজাতির মাছ। জেলেরা বলছে বুড়িগঙ্গায় মাছ পাওয়া তাদের কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতোই। কারণ পানিতে অন্য সময় এত পরিমাণ বিষাক্ত থাকে যে মাছ পাওয়া তো দূরের কথা নদীর ধারে যাওয়া কষ্ট। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবাহান বলেন, বুড়িগঙ্গার পানি সব অংশে দূষণের পরিমাণ এক নয়। কোথায় বেশি আবার কোথাও কম দূষণ রয়েছে। কিন্তু বর্ষায় পানি প্রবাহ বৃদ্ধির কারণে দূষণের পরিমাণ কমে যায়। ফলে এ সময় নদীতে মাছ পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেসব মাছ এখন জেলেরা ধরছে তা নদীর স্থায়ী মাছ নয়। নদী দিয়ে যাতায়াতের সময় জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। কিন্তু নদীতে সময় সময় মাছ পেতে হলেও পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ প্রতি লিটারে অবশ্যই ৫ মিলিগ্রামের বেশি থাকতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুম বাদে সারা বছরই বুড়িগঙ্গায় যে পানি থাকে তাতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে সর্বনিম্ন। পানি রং ধারণ করে একেবারে কুচকুচে কালো। বুড়িগঙ্গা পরিণত হয় আবর্জনার ভাগাড়ে। এ অবস্থায় নদীতে মাছসহ কোন জলজ প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। হাইকোর্টের এক রায়ে বলা হয়েছে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এই পানিকে আর পানি বলা যায় না। নদীতে পানির নামে যা আছে মানুষের স্বাস্থ্যেও জন্য অন্তত্য ক্ষতিকর। আদালতের রায়ে বলা হয়েছে নদী পানির দূষণ থেকে রক্ষা করা না গেলে বিপর্যয়ের শিকার হবে ঢাকা শহর। বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্মিলিত উদ্যোগে নদীর দূষণ রোধ করা গেলে অবশ্যই বুড়িগঙ্গা প্রাণ ফিরে পাবে। ফিরে আসবে জলজ প্রাণীসহ সব প্রজাতির মাছ। ফলে জেলে তাদের জীবিকা ফিরে পারে। বিশ্বের নদী দূষণের হাত থেকে রক্ষার অনেক উদাহরণ রয়েছে। লন্ডনের টেমস নদীর ভয়াবহ দূষণে চারবার মহামারি কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। এর ফলে নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রায় ৩৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তারপরও টেমস নদী দূষণমুক্ত হয়েছে। ফিরে এসেছে মাছ। পুনরুদ্ধার হয়েছে হার্ডসন নদী। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে এ নদী নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করলে বদলে যেতে পারে রাজধানীর অবয়ব। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন বর্জ্যরে দূষণে দূষিত বুড়িগঙ্গা মৃত। বর্ষায় পানির বেড়ে কিছুটা দূষণমুক্ত হলে বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই আবার পানির রং কালো আকার ধারণ করে। দখলদারদের লোভের কাছে প্রতিদিনই নদী হচ্ছে সংকুচিত । নাব্যতাও আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে দিন দিন। নদী দখলের চিত্র এতটাই মাত্রাতিরিক্ত যে, বুড়িগঙ্গার সংযোগস্থল এখন খালে পরিণত হয়েছে। তাই ধলেশ্বরীর পানি আজ আর ঢোকে না বুড়িগঙ্গায়। বিভিন্ন জরিপ থেকে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গা দূষণের ৬০ ভাগ আসছে শিল্পবর্জ্য থেকে। ৩০ ভাগ আসছে ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনসহ সরকারী প্রতিষ্ঠানের ডাম্পিং থেকে। আর মাত্র ১০ ভাগের জন্য দায়ী অসচেতন জনগণ। অথচ ঢাকার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত গুরুত্বপূর্ণ নদী বুড়িগঙ্গা। কথিত আছে প্রাচীনকালে গঙ্গা নদীর একটি প্রবাহ ধলেশ্বরী হয়ে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশেছিল। সময়ের পরিক্রমায় প্রাকৃতিক কারণে প্রবাহটির গতিপথ পরিবর্তন হয়। ফলে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গঙ্গার সঙ্গে যোগাযোগ। পরবর্তীতে বিচ্ছিন্ন প্রবাহটি বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। মূলত ধলেশ্বরী নদী থেকেই বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি হওয়া এ নদীটি এখন মানুষেরই অত্যাচারে আজ মরতে বসেছে। অথচ ১৮০০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক আবাসিক প্রতিনিধি জন টেইলর বুড়িগঙ্গা নদীর রূপ দেখে মুগ্ধ হয়ে লিখেছিলেন, বর্ষাকালে যখন বুড়িগঙ্গা পানিতে ভরপুর থাকে, তখন দূও থেকে ঢাকাকে দেখায় ভেনিসের মতো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক সময় বুড়িগঙ্গায় ইলিশ মাছে দেখা পাওয়া যেত। জেলেরা তাদের জীবিকার জন্য ব্যস্ত থাকত নদীতে মাছ ধরার কাজে। নদী পাড়ে মানুষের জীবিকার উৎস ছিল বুড়িগঙ্গা। কিন্তু কালের পরিমাক্রমায় সবই আজ স্বপ্নে পরিণত হয়ে পড়েছে। দুখল দূষণের বুড়িগঙ্গ আজ এত মৃত যে মাছ পাওয়া তো দূরের কথা শুষ্ক মৌসুমে নদীর ধারের কাছে যাওয়া যায় না। তাদের মতে বুড়িগঙ্গাকে আগের অবস্থায় নিয়ে আসতে হলে, মাছের আবাস ফিরে আনতে হলে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। এছাড়া বুড়িগঙ্গা খনন করতে হবে। অন্য নদী দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পানি আনে প্রবাহ বাড়াতে হবে। জোয়ার-ভাটা ঠিক রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। গৃহস্থালী বর্জ্য পানি প্রবাহে ফেলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ট্যানারিগুলো জরুরীভিত্তিতে স্থানান্তর করতে হবে।
×