ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মুনতাসীর মামুন

কেন শেখ হাসিনাকে হত্যা ও ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা বার বার করা হয়?

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ২২ আগস্ট ২০১৫

কেন শেখ হাসিনাকে হত্যা ও ভাবমূর্তি নষ্টের চেষ্টা বার বার করা হয়?

শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে ২১ বার। কোন হত্যা প্রচেষ্টার মামলারই সুরাহা এখনও হয়নি। এর মধ্যে ২১ আগস্ট ২০০৪ সালের প্রচেষ্টায় টার্গেট ছিল শেখ হাসিনাসহ দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এই ঘটনায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন ৪ দলীয় জোট সরকার, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, গোয়েন্দা বিভাগ ও প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তির সম্পৃক্ততার বিষয়টি এখন স্পষ্ট। গতকালের পর আজ পড়–ন দ্বিতীয় কিস্তি... তিন. এই সব হত্যা প্রচেষ্টার বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠেÑ ১. তিন রাজনৈতিক দলের নেতা শেখ হাসিনা, খালেদা জিয়া ও গোলাম আযম/মতিউর রহমান নিজামীর মধ্যে একমাত্র শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে বারবার। ২. গোলাম আযম/মতিউর রহমান নিজামী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ৩০ লাখ খুন ও ৬ লাখ ধর্ষণ, অজস্র আহত, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের জন্য দায়ী। বিএনপি বঙ্গবন্ধু হত্যার বেনিফিশিয়ারি এবং সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের নায়ক বঙ্গবন্ধুর বিরোধী যে কারণে জাতীয় শোক দিবসকে ঠাট্টা করার জন্য খালেদা জিয়া ১৫ আগস্ট কেক কাটেনÑ যেন হত্যা একটি মহাআনন্দের কাজ। মানবতাবিরোধী বিচারের বিপক্ষে বিএনপির অবস্থান। এক কথায় তারা খুনের সমর্থক। ৩. গোলাম আযম/নিজামী ও খালেদার বিরুদ্ধে কখনও হত্যার প্রচেষ্টা নেয়া হয়নি। প্রথম দু’জনের বিরুদ্ধে বিচার হয়েছে। একজন মারা গেছেন। আরেকজন তার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছেন। ৪. হরকাতুল জিহাদ বা হুজি কয়েকবার শেখ হাসিনাকে হত্যার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। এরা জামায়াতের প্রভাবাধীন জঙ্গী গ্রুপ। খালেদা জিয়ার সময় এদের উদ্ভব ও বিকাশ। ৫. এই সব হত্যা প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোন মামলা হয়নি। মামলা হলেও তদন্ত হয়নি, তদন্ত হলেও বিচার হয়নি, কোন কোনটির বিচার শুরু হলেও দু’যুগে তার নিষ্পত্তি হয়নি। ৬. দেখা যাচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাঁকেই বারবার হত্যার প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি এর সঙ্গে সরাসরি জড়িত। কিন্তু, তাদের গায়ে আঁচড়টিও লাগেনি। চার. ১৯৭১ সাল থেকে যারা নিজেদের বাঙালী বলে মনে করেন, বাঙালী সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করেন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করতে চান, বঙ্গবন্ধু থেকে ব্লগার অভিজিত, শেখ হাসিনা থেকে তৃণমূলে বিশ্বাসী মানুষকেই গত ৪৩ বছর হত্যা করা হয়েছে, হত্যার প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে, জেল-জুলুম-নির্যাতনের মুখোমুখি করা হয়েছে। এমনকি হরিদাস পাল মুনতাসীর মামুন বা শাহরিয়ার কবিরও এর মুখোমুখি হয়েছেন। কোন ক্ষেত্রেই কেউ বিচার পাননি। একমাত্র বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হয়েছে, তাও খুনীদের একাংশ পলাতক। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্য পরিকল্পনায় কারা ছিল তা উদ্ঘাটনেও কোন কমিশন হয়নি। বলা যেতে পারে ১৯৪৭ থেকে যে দ্বন্দ্বের শুরু তার নিষ্পত্তি এখনও হয়নি, যদিও আমরা ভেবেছিলাম ১৯৭১ সালে তার নিষ্পত্তি হয়েছে। বাঙালী মুসলমান সেই ২০০ বছর ধরে আত্মপরিচয় সঙ্কটে ভুগছে। তার সত্তা দ্বিখ-িত। বঙ্গবন্ধু ২৫ বছর চেষ্টা করে বাঙালীকে ঐক্যবদ্ধ করে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়েছিলেন। কেননা দূরদর্শী ছিলেন তিনি, অনুধাবন করেছিলেন, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। জিয়াউর রহমান ঐ ঐক্য ভেঙ্গে জাতিকে দ্বিখ-িত করেছিলেন এবং দ্বিখ-িত জাতির একাংশের হয়ে ক্ষমতা দখল করেছেন। একই কাজ করেছেন এরশাদ। জিয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আগেই নিহত হন। এরশাদের সময় থেকেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা প্রচেষ্টা নেয়া হয়। অর্থাৎ, জিয়ার যোগ্য উত্তরসূরি তিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের শুধু সরকারী পদ দিয়ে সাহায্যই নয়, ঘাতক ফারুককে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেরও সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। আমরা এসব কথা বিস্মৃত হই। পুলিশ দেখা যাচ্ছে সব সময়ই নিজেদের কোড অব কনডাক্ট মানেনি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা প্রভাবশালী মহল যা বলেছেন সেই অনুযায়ীই কাজ করেছেন। না হলে শেখ হাসিনার প্রাণনাশের ২১টি প্রচেষ্টার একটিও নিষ্পত্তি হয়নি কেন? নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করলেও তা কোথাও না কোথাও আটকে যায়। কেন? শাহরিয়ার কবির একটি কথা বারবার লিখেছেন, প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জামায়াত। অনেক সময় আমিও বলেছি, এটি বাড়াবাড়ি। কিন্তু, সাম্প্রতিক ঘটনায় বিশ্বাস করতে হচ্ছে যে, এ কথায় সত্যতা আছে। গরিবরা এ রাষ্ট্র এনেছিল। এখন অর্থবিত্ত ক্ষমতা এ রাষ্ট্রকে গ্রাস করেছে। যে কারণে, ৭ বিলিয়ন ডলার বিদেশে থাকা প্রমাণিত হলেও সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ত্বরিত কোন ব্যবস্থা নেয়া যায় না। কোথায় যেন সব আটকে যায়। প্রতিক্রিয়ার এই ধারা ১৯৪৭ সাল থেকেই ছিল। ১৯৭১ সালেও ছিল। এখনও আছে। এই ধারাকে ১৯৭৫-এর পর পুষ্ট করেছেন জিয়া এরশাদ খালেদা। এই ধারার ব্যক্তিরা প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক। তাদের কাছে রাষ্ট্র জিম্মি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিও তাদের কাছে বাঁধা অনেক ক্ষেত্রে। তাদের লক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে পদানত করা এবং শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে না পারলে এ ধারাকে পদানত করা সম্ভব নয়। সবাইকে তারা কিনতে পারছে বা পারবে হয়ত, কিন্তু শেখ হাসিনাকে নয়, এ জন্যই তাঁকে হত্যা করতে হবে। পাঁচ. শেখ হাসিনা ফিনিক্সের মতো। ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার পরও আবার স্বমূর্তিতে জেগে উঠেছেন। সমস্ত পরিবার তাঁর হত্যা করা হয়েছে। তাঁকে ২১ বার হত্যার চেষ্টা হয়েছে, তিনি নির্বিকার। কোন মানুষের পক্ষে এসব সহ্য করে বেঁচে থাকা মুশকিল। এ কারণেই বোধহয় এ প্রবাদের সৃষ্টিÑ রাখে আল্লাহ মারে কে! শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসীন হয়েই পিতার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন যাতে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। আমরা জানি এতে প্রচুর প্রতিবন্ধকতা; কিন্তু জানি তিনি ফিনিক্স। সে জন্যই সুখে-দুখে আমরা তাঁর সঙ্গে আছি। কিন্তু তাঁর প্রশাসন, তাঁর দল কি সব সময় তাঁর সঙ্গে থাকে? থাকে না। এই না থাকাটা প্রতিক্রিয়ার পক্ষে যায়। আজ পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে সব হত্যা প্রচেষ্টার বিচার কেন হলো না? কেন যারা হত্যা প্রচেষ্টায় থাকে তারা জামিন পায়? কেন চট্টগ্রাম হত্যা প্রচেষ্টার মামলার বিচার শেষ হয় না? কেন গ্রেনেড হামলার বিচার এখনও ঝুলে থাকে? এ হত্যা প্রচেষ্টার মামলাগুলোর সমন্বয় করে দ্রুত বিচার করার জন্য কি তিনি আগ্রহী নন? তিনি কি তাঁর দল, মন্ত্রী-উপদেষ্টাদের মধ্যে কাউকে এ দায়িত্ব দিতে পারেন না? এসব হত্যা প্রচেষ্টার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্যতম হচ্ছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। এটা ভাবা যায় যে একজন প্রধানমন্ত্রী, সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা এর সঙ্গে জড়িত হতে পারে? পুলিশ এ মামলা নিয়ে কত রঙ্গতামাশাই না করেছে। একটি ঘটনার উল্লেখ করি। মুফতি হান্নানকে যখন বারবার রিমান্ডে আনা হচ্ছে, তখন তিনি বলছিলেন, আমাকে নিয়ে এত টানাহেঁচড়া কেন? এর নীলনকশা তো হয়েছে হাওয়া ভবনে। যে ভাবেই হোক শাহরিয়ার কবির তাঁর তথ্যচিত্রের জন্য তা রেকর্ড করেন। তদন্তকারী এক অফিসারকে শাহরিয়ার জিজ্ঞেস করেন, আপনি হান্নানের কথায় তো গুরুত্ব দিচ্ছেন না? তদন্তকারী কর্মকর্তা ক্রুদ্ধ হয়ে শাহরিয়ারকে চলে যেতে বলেন। তর্কাতর্কির পর সেই অফিসার বলেন, আমাদের তো চাকরি করতে হবে। বিএনপি এলে কী হবে? এই হচ্ছে পুলিশের মনোভাব। শাহরিয়ার কয়েকজন প্রভাবশালীর মাধ্যমে এই তথ্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পরে তাঁর তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হলে টিভিতে তা প্রচারিত হয় এবং তখন জানাজানি হয় যে, এই হত্যা প্রচেষ্টায় হাওয়া ভবন জড়িত। চলবে...
×