ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা স্মরণে আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী

পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডে জিয়া আর গ্রেনেড হামলায় খালেদা জড়িত

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২২ আগস্ট ২০১৫

পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডে জিয়া আর গ্রেনেড হামলায় খালেদা জড়িত

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলার জন্য সরাসরি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে দায়ী করে বলেছেন, ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে যেমন জিয়াউর রহমান জড়িত ছিল, ঠিক তেমনি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্র তারেক রহমানরা জড়িত। এ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের বিচার হতেই হবে, নইলে আবারও এ ধরনের ঘটনা ঘটবে। শুধু ২১ আগস্টই নয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরে এবং ২০১৩ ও ২০১৫ সালে যারা মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাদেরও বিচার করা হবে। খুনীরা কেউ রেহাই পাবে না। জড়িতদের শাস্তি পেতেই হবে। শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ভয়াল-বীভৎস্য ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা স্মরণে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, যারা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়, আন্দোলনের নামে মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেÑ তারা আর যা-ই হোক গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জনগণের কল্যাণে বিশ্বাস করতে পারে না। মানুষকে খুন করেই এরা (বিএনপি-জামায়াত জোট) আনন্দ পায়, খুনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। দেশের মানুষের ভাল হোক, সুখে থাকুক তা তারা চায় না। ভয়াল ২১ আগস্ট উপলক্ষে শুক্রবার দুপুরের পর থেকেই হামলারস্থল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে হামলায় শহীদের পরিবার এবং দীর্ঘ ১১ বছর ধরে গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত ও পঙ্গুত্ব জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা আহতদের উপস্থিতিতে সেখানে রীতিমতো আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ১১টি বছর পেরিয়ে গেলেও আহতদের চোখে-মুখে ওই ভয়াল হামলার বীভৎসতার আতঙ্কের ছাপ ছিল স্পষ্ট। বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থলে এসেই প্রথমে সেখানে স্থাপিত শহীদদের অস্থায়ী স্মৃতিস্তম্ভে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সকল শহীদদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। এরপর বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ আগস্টের শহীদ, জাতীয় চার নেতা, ২১ আগস্টের শহীদসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন নগর আওয়ামী লীগের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক সুফী সুলতান আহমেদ। প্রধানমন্ত্রীর পর ক্ষমতাসীন ১৪ দলের নেতারাও শহীদ স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদনকালে মন্ত্রিপরিষদ সদস্যবৃন্দ, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, সংসদ সদস্যসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। ড. হাছান মাহমুদ ও অসীম কুমার উকিলের পরিচালনায় আলোচনা সভা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় শহীদদের পরিবার এবং পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে থাকা আহত নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় শহীদ পরিবারের সদস্যদের কান্নায় পুরো অনুষ্ঠানের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করার পর সবার শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার জড়িত তার নানা উদাহরণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ আগস্ট আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমাবেশ ও শোক র‌্যালির কর্মসূচী করছিলাম। সেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সমাবেশে আমরা সন্ত্রাসী হামলার শিকার হলাম। আমাকে হত্যার জন্যই এ হামলা চালানো হয়েছিল। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তিনি বলেন, যে গ্রেনেড যুদ্ধে ব্যবহার হয়, সেই গ্রেনেড দিয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে হামলা চালিয়ে আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২ নেতাকর্মীকে হত্যা করা হলো। গ্রেনেডের স্পিøন্টারে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে, পঙ্গুত্ব নিয়ে শত শত নেতাকর্মী জীবনযাপন করছেন। তিনি বলেন, হামলার পর আলামত সংগ্রহ না করে তৎকালীন সরকার সকল আলামত একে একে ধ্বংস করে দেয়। সিটি কর্পোরেশনের পানির গাড়ি এনে রক্তগঙ্গা বইয়ে যাওয়া স্থানগুলো ধুয়ে সব আলামত নষ্ট করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড সংরক্ষণ না করে সেগুলোও ধ্বংস করা হয়। শুধু তাই নয়, আক্রান্তদের উদ্ধার না করে উল্টো আহতদের যাতে হাসপাতালে নিতে না পারে এবং ঘাতকরা নির্বিঘেœ পালিয়ে যেতে পারে সেজন্য হামলার পর পুলিশ বেপরোয়া লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। এমনকি ওই হামলার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের দেশের বাইরে চলে যেতেও সহায়তা করেছিল তখনকার জোট সরকার। হামলার পর ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জোট সরকারের নানা কর্মকা-ের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতারা বলতে শুরু করে আওয়ামী লীগ নিজেরাই এ গ্রেনেড হামলা চালিয়েছে। আমি নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়ে নিজেই মেরেছি! আমি আবার গ্রেনেড মারতে শিখলাম কবে? আসলে নিজেরা অপকর্ম করে অপরের কাঁধে দোষ চাপাতে বরাবরই ওস্তাদ বিএনপি নেত্রী। গ্রেনেড হামলার পর প্রতিবাদ-সমাবেশ এমনকি সংসদেও আমাদের কথা বলতে দেয়া হয়নি। ২১ আগস্টের হামলা পূর্বপরিকল্পিত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে সংসদে বিএনপির নেতারা বলেছিল, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর যে পরিণতি হয়েছে, আমারও নাকি একই পরিণতি হবে। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াও বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী কেন আমি নাকি কোনদিন বিরোধী দলের নেতাও হতে পারব না। বিএনপি নেত্রী ও দলটির নেতাদের কথায় প্রমাণ হয়, আগে থেকেই এ হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সরকারে থেকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আমাকে এবং আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। ২১ আগস্টের আগে ১৭ আগস্ট তৎকালীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের ৬৩টি জেলায় একসঙ্গে পাঁচ শতাধিক স্থানে বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গী-সন্ত্রাসীরা। তিনি বলেন, গ্রেনেড হামলায় আহত আইভি রহমানকে ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসার নামেও অনেক রহস্যজনক ঘটনা ঘটেছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া যখন সিএমএইচে দেখতে যান, তখন আইভি রহমানের ছেলে-মেয়েদের পাশের ঘরে তালাবদ্ধ করে আটকে রাখা হয়েছিল। এর পেছনে রহস্য কী ছিল, আমরা তা জানি না। দেখতে যাওয়ার সময় ছেলে-মেয়েদের সান্ত¡না না দিয়ে উল্টো ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হলো কেন? এর জবাব কে দেবে? বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে জিয়াউর রহমান জড়িত উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আত্মস্বীকৃত খুনী ফারুক-রশীদরা সাক্ষাতকার দিয়ে বলেছে যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার আগে তারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করেছিল। এ সময় জিয়াউর রহমান তাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে পারলে তাদের (বঙ্গবন্ধুর খুনী) সঙ্গে সে (জিয়া) থাকবে। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের সঙ্গে যেমন জিয়া জড়িত ছিল, তেমনি ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে তার স্ত্রী খালেদা জিয়া ও পুত্ররা জড়িত। শুধু ২১ আগস্টই নয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সন্ত্রাসীরা গ্রেনেড-বোমা ও গুলি করে আওয়ামী লীগের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া এমপি, আহসান উল্লাহ মাস্টার এমপিসহ অনেক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছিল। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বারংবার আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আমরা ক্ষমতায় থাকার সময়ও আওয়ামী লীগকে উৎখাত করে যারা তালেবান রাষ্ট্র বানানোর ঘোষণা দিয়েছিল, খালেদা জিয়া তাদের সমর্থন দিয়েছে। মানুষকে হত্যা করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করাই হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের চরিত্র। তিনি বলেন, আমরা দেশকে সবদিক থেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দেশের এ উন্নয়ন ও অগ্রগতি পছন্দ নয় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়ার। এ প্রসঙ্গে ২০১৩ সালে নির্বাচনপূর্ব এবং চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি থেকে ৯২ দিনব্যাপী বিএনপি-জামায়াত জোটের ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সরকারকে উৎখাত না করে ঘরে ফিরে যাবেন নাÑ এমন কথা বলে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ৯২ দিন ধরে নিজ কার্যালয়ে স্বেচ্ছা বন্দী থেকে হুকুম দিয়ে দিয়ে শত শত মানুষকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করিয়েছেন। আর লন্ডনে বসে ২১ আগস্ট হামলার সঙ্গে জড়িত তার কুলাঙ্গার পুত্র (তারেক জিয়া) নির্দেশ দিয়ে এসব অপকর্ম করিয়েছে। মানুষকে হত্যার মাধ্যমে তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করতে চেয়েছিল। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে এত নিরীহ-সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার পর এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া এর জন্য দুঃখ প্রকাশ কিংবা দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা চাননি। কারণ হত্যা-সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্রই হচ্ছে তার রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা মানবতা ও মানবাধিকারের কথা বলে তারাই বঙ্গবন্ধুর খুনীদের আশ্রয় দিয়েছে। আমরা খুনীদের ফেরত চাইলেও দেয়া হচ্ছে না। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, যারা ১৫ আগস্ট শিশু, অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ এত মানুষকে হত্যা করল তাদের আশ্রয় দিয়ে ওই দেশগুলো মানবাধিকারের কথা বলে কিভাবে? প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকতে দেশের মানুষের নয়, নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। জনগণের অর্থ-সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। আর আমরা জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে। এ সময় তিনি আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া এবং দেশবাসীর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, আল্লাহর রহমত ও দেশবাসীর দোয়ায় প্রাণে বেঁচে থাকার কারণে এখন দেশের সেবা করতে পারছি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশকে আমরা শান্তিময় উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলবই।
×